অসময়ের সমাপ্তি (প্রথম ভাগ-দেখা) [উপন্যাস]

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ১৫ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:১২:৫১ রাত



দেখা

শান্ত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তাদের একে অন্যের দিকে তাকাতে বাধা নেই আজ, কথা বলারও না। তবু কথা নেই তাদের মুখে। দৃষ্টি বিনিময়ও নেই। একজন ধ্রুব, আরেকজন বিভা। ধ্রুবই বিভাকে ডেকেছিল। বিভা আসলো এবং কিছু নির্লিপ্ত মুহূর্তের পরিসমাপ্তির প্রহর গুনছিল। কিন্তু না, সমাপ্তি নির্লিপ্ত হল না। শেষ অবধি মুখ খোলে ধ্রুব।

‘তারপর, শুভ কামনা।’

‘ও আচ্ছা, তা তুই এটা বলার জন্যই আমাকে ডেকেছিস? তুই যে আমার শুভ কামনা করিস আমি তা জানি। এটা বলার কি আছে?’

ধ্রুব মুচকি হাসে, এ হাসি রহস্যময়। তারপর বলে,

‘তা কবে চলে যাবি।’

‘তুই জেনে কি করবি? আমি যেদিন খুশি যাব।’

‘ভালো। এখন কি চলে যাবি?’

‘হু। তোর তো কোন কাজ নেই। আমার অনেক কাজ। তো তুই আমাকে এই নদীর ধারে নিয়ে আসলি কেন?’

‘জানি না। মন চাইল তাই।’

‘ওকে! তাহলে এখন আমাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।’

‘এটা সম্ভব নয়, তুই এটা ভালো করেই জানিস।’

‘তুই এমন কেন বলতো, তোকে তো আমি আগেই বলেছিলাম। তুই শুনিস নি। এখন আমাকে কোনরূপ দোষারোপ করবি না!’

‘দোষ! কিসের দোষ?’

‘ইয়ারকি মারিস! তোর আর বুঝতে হবে না। আমি গেলাম।’

‘যা।’

বিভা পিছন ফিরে চলে যায়। ধ্রুব নদীর জলের খেলা দেখে, আজব এই খেলা, জলের দিকে তাকিয়েই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। পিছনে ফিরে তাকাবার ইতিহাসের সমাপ্তি অনেক আগেই ঘটেছে।

এটাই ছিল শেষ দেখা। তারপর অনেক দিবস-অনেক রজনী পার হয়েছে। সভ্যতার হয়েছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন নিয়ে আছে নানান কথা। কেউ বলে থাকে ইতিবাচক, আবার কেউ বলে সভ্যতা নাকি পিছন দিকে হাটছে। স্বাধীনতাকে অনেক দিন যাবত মানুষেরা সেচ্ছাচারিতা হিসেবে পেতে চেয়েছে। তবে তা কতটা ভুল ছিল তা হাড়ে হাড়ে বুঝছে বিশ্ব।

পরিবর্তন এসেছে বিভা আর ধ্রুবের জীবনেও। ধ্রুবের প্রহর গোনার দিন শেষ হবার অপেক্ষা মাত্র। বিভাই তাকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে ‘সে আসছে’ । এর আগেই হয়তো তাদের দেখা হবার কথা ছিল, কথা হবার কথা ছিল। কিন্তু সময় কোন কথার কথা মানে না। সময় মানে বাস্তবিকতা। এতদিনের অপেক্ষার চেয়ে এই কয়েকদিনের অপেক্ষার ভার বেশী ধ্রুবের কাছে। কেননা সময় রহস্যময়। তবে বাস্তবিকতা আরো রহস্যময়। সময় রহস্যময় এই কারনে যে সময় তোমাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাবে, অতীতের শিক্ষা দিবে, কিন্তু সময়ের অস্তিত্ব শুধু বর্তমানে। আর বাস্তবিকতা বর্তমানের বহিঃপ্রকাশ। অতীতের ইতিহাস অথবা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে ভাববার ফুসরত নেই বাস্তবিকতার। বর্তমানের অস্তিত্ব এতোই সীমিত যে একে ইচ্ছা মত সাজানো যায় না।

এবারের দেখায় কি হতে পারে এই চিন্তা ধ্রুবকে গ্রাস করে। চিরদিনই আশাকেই জীবন ভাবতে শিখেছে ধ্রুব। সে অবিশ্বাস করত জ্যোতিষীদের কথা, কিন্তু কেন যেন তার ক্ষেত্রে জ্যোতিষীদের উক্তি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। আত্মা তত্ত্বে তার ধারনাটাও আলাদা। সে মনে করে ভূত হচ্ছে খারাপ আত্মা। যে সকল আত্মা পৃথিবীতে রয়ে যায়, অর্থাৎ যারা অস্বাভাবিক ভাবে মারা যায় এবং দাফন অথবা লাশ পুড়ানো হয় না, তারা বিচরণ করে পৃথিবীতে। এই সব আত্মা সে সব জায়গায় বিচরন করে, যে সব জায়গায় জীবিত অবস্থায় বিচরন করত। অন্য কোন স্থানে তারা বিচরণ করতে অক্ষম, যেমনি ঘুমের মাঝে আত্মার বিচরন অপরিচিত প্রেক্ষাপটে ঘটে না। সে মনে করে বিশ্বাসই জাগতিক সব কিছুর স্রষ্টা, আর প্রেম বিশ্বাসের একটি রূপ মাত্র। তার চোখ দুটি তীক্ষ্ণ অথচ আবেগী। সব মেয়েরাই এই চোখের কাছে সবসময় দুর্বল হবে।

অন্যদিকে বিভা এখনকার দিনগুলোতে নির্বাক থাকতে বেশী পছন্দ করে। তার মনের রাসায়নিক ক্রিয়া বোঝার ক্ষমতা আছে কার- সে যে নারী, সে যে রহস্যময়ী। তার দৃষ্টি, কথা আর অনুভূতির জটিলতা ভেদ করা অসাধ্য। ইদানিং বেশ মার্জিত পোশাক পরে সে। এখনো তার চোখের চঞ্চলতা কমে নি অথবা কপালে ভাজও পরে নি। স্বপ্নে ভাসাবার মত সব উপাদানই তার ভিতর বিদ্যমান।

এবারের দেখাটা বেশ অন্য রকম। কোন দিন-ক্ষণ দেওয়া ছিল না। তাই অপেক্ষাটা কত বড় হবে তা জানা সম্ভব ছিল না। চিঠি পাবার পর দিনই ধ্রুব চলে গেছে সাক্ষাতের স্থানে। সেটা ছিল একটা সুন্দর ছোট্ট দ্বীপ। মাছ ধরার জন্য বেশ নাম আছে দ্বীপটার। সেখানে বাস করত গুঁটি কতক জেলের দল। সমুদ্রের বুকে মাছ ধরেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। অস্থায়ীভাবে থাকে এখানে তারা। তাদের মূল পরিবার থাকে বেশ দূরে একটি বড় দ্বীপে। মাছ ধরা শেষ হলে মাছ বেচতে তারা বড় দ্বীপে যায় এবং সপ্তাহ খানেক বাড়ীতে থেকে আসে। খুবই কঠিন এদের জীবন। প্রতিবারই তাদের মাছ ধরতে যেতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ঝড়-ঝাপটা তো আছেই তার সাথে আছে জলদস্যুদের উৎপাত। দেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এতে বিশ্বাস করে না তারা। আবার ট্রলারগুলোর আইনী বৈধতা না থাকায় তারা উধাও অথবা খুন হলেও তার কোন বিচার নেই। জীবনের সাথে যুদ্ধ করেই চলে তারা।

ধ্রুব দ্বীপে এসেছিল মাছ ধরার একটি ট্রলারে করে। ট্রলারটিতে আটজন ছিল জেলে। জেলেদের কাছ থেকেই জানতে পেরেছে ট্রলারটির মাছ ধরা সম্পর্কে। ট্রলারের মালিক অন্য একজন, তাদের ধৃত মাছের যে দাম হবে তা থেকে সত্তর ভাগই পাবে মালিক। বাকী ত্রিশ ভাগ তারা নিজেদের ভিতর ভাগ করে নেয়। তা দিয়েই তাদের সংসার চলে। মাঝখানে থাকে তাদের জীবন। জীবন নিয়ে ব্যবসা বলা যেতে পারে একে।

তাকে রেখেই ট্রলারটি মাছ ধরতে চলে যায়। সে সময় দ্বীপটিতে আরো চারটি ট্রলার ছিল। ৭-৮ দিন পর পরই ট্রলারের জেলেরা ছোট্ট দ্বীপটিতে বিশ্রাম নেয় এক দিনের জন্য, প্রতিদিনই ৫-১০ টি ট্রলার ভিড়তে দেখা যায় দ্বীপে । দ্বীপটিকে স্রষ্টার আশীর্বাদ মনে করে জেলেরা।

দ্বীপে আধিপত্য বিস্তার করত এক জেলে যার নাম আকরাম। সে এখন আর মাছ ধরে না। জেলেদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে দ্বীপে নৌকা ভিড়াতে অথবা বিশ্রাম করতে দেয় সে। তার আছে একটি বাহিনী যারা বেশ মায়া-মমতা হীন বলে পরিচিত। সাধারনত লাঠি দিয়ে দ্বীপ দখলে রাখে তার বাহিনী। অনেক সময় দ্বীপ দখলের জন্য আক্রমণ আসে। সে সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তারা। দ্বীপের মাঝের দিকে কিছু গাছ আছে। আকরাম দ্বীপের এই গাছ গুলোকে অনেক ভালোবাসে, তার অনুমতি বাদে গাছে কেউ হাত দিলে তাকে শাস্তি পেতে হয়।। এই দ্বীপই তার জীবন। একবার জলোচ্ছ্বাসে নাকি তার পরিবারের সবাই মারা গেছে, তার পর থেকেই এভাবে জীবন-যাপন করে। অনেক সময় ডাকাতদের কাছ থেকে ট্রলার উদ্ধারে অথবা বন্দী উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আকরাম। সেজন্য জেলে ও ট্রলার মালিকেরা তার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখে।

ধ্রুব দ্বীপে গিয়েই জেলেদের নির্দেশ মত আকরামের কাছে যায়। টাকার বিনিময়ে সে থাকার অনুমতি পায় এক মাসের। এই দ্বীপে ঘটে যায় ধ্রুবের জীবনের অনেক ঘটনা। এক মাসের সমাপ্তি ঘটে তবু বিভা আসে নি। সমুদ্রে জেলেদের সাথে সংগ্রাম করেছে ধ্রুব দিনের পর দিন অর্থ উপার্জনের জন্য। সে মাসে দুই বার (১২-১৫ দিন) নৌকার সাথে যেত এবং তাতে যে টাকা হত তা আকরামকে দিত। দ্বীপে থাকতে থাকতে আকরামের সাথে ভালো সখ্যটা সৃষ্টি হয় ধ্রুবের। একবার এক জেলের মুখে ধ্রুবের দ্বীপে থাকার কারণ শুনে ধ্রুবকে ডাকে আকরাম। আকরাম সব শুনে ব্যথিত হয় এবং ঘোষণা দেয় পরবর্তীতে ধ্রুবের কাছ থেকে অর্ধেক টাকা নিবে। ফলে তারপর থেকে ধ্রুব মাসে একবার মাছ ধরতে যেত এবং বাকী দিন অপেক্ষার প্রহর গুনতো। এভাবে ছয় মাস পার হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সব জেলেদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল ধ্রুবের কথা, সমুদ্রের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল তার কথা। কেউ কেউ তাকে পাগল মনে করতে লাগল। কেউ কেউ তাকে শ্রদ্ধা করতে লাগল। এভাবেই চলছিল দিন।

কিন্তু একবার যখন ধ্রুব মাছ ধরতে গেল, তারপর আর ফিরে আসল না। ট্রলারের কেউই ফিরে আসে নি। দ্বীপের সবাই ভেবে নিল জলদস্যুদের কবলে পড়েছে তারা। হয়তো তাদের সবাইকে হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আকরাম তার বাহিনী নিয়ে সমুদ্রে তল্লাশি করে কয়েকটা লাশ পাবার পর বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে গেল। তবে অনেকের লাশই আর পাওয়া গেল না। আসলে সবার লাশ কখনোই পাওয়া যায় না; এটাই সমুদ্রের নিয়ম, এটাই সমুদ্রের ইতিহাস। সমুদ্রে এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে কিন্তু আকরাম কখনো সেটা নিয়ে চিন্তা করে নি। তবে ধ্রুবের এই ঘটনায় ব্যথিত হল আকরাম। এর পিছনে মূল কারণ তার পরিবার। কেন জানি দ্বীপে ধ্রুব আসার পর থেকেই তার পরিবারের কথা বেশী মনে পড়তো।

বিষয়: সাহিত্য

২৮৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File