এক গল্প বলি-১

লিখেছেন লিখেছেন বাচ্চা ছেলে ২৫ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:০৭:৪৮ দুপুর

অন্ধকার রাত হুম হুম করে পা চালিয়ে বাড়ি ফিরছে আজমল। যতদুর চোখ যায় নিকশ কালো অন্ধকার কোথাও কোন মানুষের চিহ্ন নেই। দুরের এক গায়ে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। সব গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ এখনও পৌছেনি কিন্তু কিছু কিছু গ্রামে পৌছেছে। যে গ্রামটিতে আলো জ্বলছে তার পরের গ্রামেই মুদি দোকানী আজমলের বাড়ি। আজকে কেন জানি রাস্তাটা শেষই হতে চাইছে না। দিনকালও ভালো না। রাস্তায় কোন বিপদের কথা মাথায় না আসলেও বাড়িতে যুবতী মেয়েটা একা ভেবে ভয় হচ্ছে তার। মা মরা মেয়েটি একাই বাবার সংসারের হাল ধরেছে সেই বারো বছর বয়স থেকে। এখন রাজিয়ার বয়স ষোল। রাজিয়ার যখন পাঁচ বছর বয়স তার মা অজানা এক রোগে মারা যায়। তারপর অনেকের পীড়াপীড়িতে আজমল আরেকটি বিয়ে করে। যদিও তার বিয়েতে কোন মত ছিলো না। তথাপি ছোট মেয়েটির কথা ভেবে এবং তারও একজন দেখাশুনা করার লোকের অভাব।

মেয়ে রাজিয়ার যখন ছয় বছর বয়স পাশের গ্রামের রহমত মুন্সির মেয়ে খোদেজাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আজমল। খোদেজার আরেক ঘরে বিয়ে হয়েছিল। সেই স্বামী অতিরিক্ত মদ পান করায় লিভার ক্যান্সার হয়ে মারা যায়। বাসর ঘরে ঢুকেই স্ত্রীকে আজমল তার মা হারা মেয়েটাকে যেন কষ্ট দেয়া না হয় বলতে ভুল করে না। এরপর বেশ ভালোভাবেই চলছিল আজমল-খোদেজার নতুন সংসার। মেয়ে রাজিয়াকে সতিনের সন্তান না ভেবে নিজের সন্তানের মতোই আদর যত্ন করে।

দোকানে পূর্বের থেকে বেচা-কেনা বেড়ে গেছে অনেক। একাই আর সামাল দেয়া যাচ্ছে না। তাই ঠিক করা হয় দোকানে একটা ছেলে রাখা হবে যে আজমলকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। ইদানিং বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে তার। বাড়িতে মা-মেয়ে একাই থাকে। তাই দোকানের নতুন ছেলেটাকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দেয় আজমল।

প্রতিদিনের ন্যায় অনেক সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে বাড়ি ফিরলেও একদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে আজমল দেখতে পান মেয়ে রাজিয়াকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে তার মা খোদেজা। দৃশ্যটি দেখে প্রাণটা ভরে যায় আজমলের। তার দু’চোখে খুশির অশ্রু। সৎ মা বলতেই একটা বিরুপ ধারনা পাল্টে যায় আজমলের।

রাজিয়ার বয়স এখন দশ বছর। সবকিছু বুঝতে শিখেছে। পড়াশুনায় অনেক ভালো রাজিয়া। স্কুলের শিক্ষকরা রাজিয়ার বাবার দোকানে সদাই-পাতি কিনতে এসে যখন মেয়ের প্রশংসা করে তখন তা শুনে বুকটা গর্বে ভরে উঠে। তাই মেয়ের পড়াশুনার কোন সমস্যা যেন না হয় এজন্য স্ত্রীকে বিশেষ খেয়াল রাখতে বলেন আজমল।

ছোট বেলা থেকেই সেই ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস রাজিয়ার। ফজরের নামাজ পড়ার অভ্যাসটা অবশ্য পরপারে চলে যাওয়া মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। তারপর বাড়ির ছারপোষ থেকে শুরু করে গরুর খাবার দেয়া, খোয়ার থেকে হাস মুরগি বের করা সব কাজ করে রাজিয়া। এরপর রাতে রেখে দেয়া ঠান্ডা ভাত খেয়ে স্কুলে যায়।

অনকেদিন কোথায় বেড়াতে যায় না খোদেজা। বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার আবদার করলে আজমল জানায়, মেয়েটাও কোথাও যায় না তাকেও যেন নিয়ে যায়। মা-মেয়ে ফিরে আসার পর থেকেই স্ত্রী খোদেজার মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করে স্বামী আজমল। আগের মতো আর রাজিয়াকে ভাত বেড়ে দেয়া, গোসল করিয়ে দেয়া, চুলে তেল দেয়া এসব করে না খোদেজা। উপরন্তু রান্না বান্না সহ সব কাজ তাকে দিয়ে করানো হয়। একদিন কি এক কাজে দুপুরেই বাড়ি ফিরে আসে আজমল। বাড়ির ভেতর থেকে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। বুঝতে কষ্ট হয় না এটা তার মেয়ে রাজিয়ার গলা। মেয়েকে কাঁদতে দেখে বাবার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। কাছে গিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? মেয়ে কিছু না বললে আজমল একটু ভারি গলায় স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে রাজিয়ার কাঁন্নার কারন কি?

- কি আর হবে? তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।

খোদেজার গলায় এমন তীক্ষè স্বর আগে শোনেনি আজমল। আর কিছু জিজ্ঞেস না করে মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে যায় বাবা। সারা শরীরে লাল ফোলা জখম, কি অমানবিকভাবে মারা হয়েছে ভেবেই মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে আজমল। ঘর থেকে বের হয়ে খোদেজাকে আবার জিজ্ঞেস করে, কি এমন করেছে রাজিয়া যে এভাবে মারতে হবে? খোদেজা উত্তর দেয়, হয় তোমার মেয়ে নয়তো আমি এই বাড়িতে থাকবো। স্ত্রীর এই কথা শুনে অবাক হয়ে যায় আজমল। হুট করে এই কথা কেন? ঠিক বুঝতে পারছিল না কিছুদিন আগে যে খোদেজাকে তিনি দেখেছিলেন কিভাবে এত পরিবর্তন হলো? সতীনের মেয়েকে অতিরিক্ত আদর ভালোবাসার কারণে হয়তো কেউ ভুল বুঝিয়েছে, সতিনের মেয়েকে এত ভালোবাসার কি আছে !

দুপুরের পর আর দোকানে যায়নি আজমল। খোদেজা সেই বিকাল থেকে বিছানায় শুয়ে আছে। ঠিক মতো কথাও বলছে না। রাতে রাজিয়ার কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে। মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে রেগে গিয়ে খোদেজা বলে, সব নেকামো ঠিক হয়ে যাবে। তুমি খাবে কিনা বলো? ভাত বেড়ে দিচ্ছি। মা- হারা আদরের মেয়ে না খেয়ে জ্বরে কাপছে বাবা হয়ে কি করে খায়। সারা রাত মেয়ের মাথার কাছে বসে জল পট্টিদেয় আজমল।

এই ঘটনার পর থেকে প্রায়শই রাজিয়াকে নিয়ে নালিশ দিতে থাকে খোদেজা। বাড়ির সব কাজ নাকি তাকেই করতে হয়, রাজিয়া কোন কাজ করে না। কিন্তু চিত্র ভিন্ন। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সব কাজ কর্ম একাই করে রাজিয়া। খোদেজা আরও অভিযোগ করে আজমলকে জানায় মেয়েদের পড়াশুনা করার কি দরকার। ওকে একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিলেই তো হয়। রাজিয়ার বাবা বুঝতে পারে মেয়েকে আর এখানে রাখা ঠিক হবে না। এদিকে মেয়েটি পড়াশুনায় অনেক ভালো হওয়ায় আজমলের ইচ্ছা মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবে। এখানে থাকলে পড়াশুনা হবে না তাই পড়াশুনায় কোন ব্যাঘাত যাতে না ঘটে এজন্য রাজিয়াকে তার নানী বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

রাজিয়াকে তার নানীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার পর থেকে খোদেজার মধ্যে আরেকটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে আর আগের রুক্ষতা নেই। সংসারের সব কাজ এখন একাই করে তারপরও কোন অভিযোগ নেই।

- কোথায় গেলে? ভাত বেড়ে দিয়েছি খেতে এসো। সব ঠান্ডা হয়ে গেলো তো?

স্ত্রীর এমন সুরেলা কন্ঠ কয়েকদিন থেকে শুনে আসছে আজমল। এমন শুরেলা ডাক শুনে অবাক হয়না আজমল। কারণ রাজিয়াকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেওয়া। তথাপি এমন কিছু বলতে চাচ্ছে না, যাতে আবার অশান্তি সৃষ্টি হয়।

- একটা কথা বলবো?

- হ্যা বলো, একটা কেন কয়েকটা বলতে পারো।

- না, মানে.... বলতে চাইছিলাম। আমি সন্তান নিতে চাই।

- ভালো তো। সমস্যা কি? নেবে।

- সমস্যা হলো, বাড়িতে একটা কাজের মেয়ে রাখা দরকার। রাজিয়াকে কি ওর নানী বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনা যায় না?

কথাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না আজমল। সে কি ঠিক শুনেছে? না ঠিকই শুনেছে। কিন্তু নিজের মেয়েকে কাজের লোক হিসেবে ভাবতেই যেন আজমলের গা শিওরে উঠে। তথাপি খোদেজাকে বলে, আচ্ছা দেখি কি করা যায়। মেয়েকে বাড়ির চাকরানি করে রাখা কোন বাবার পক্ষেই সম্ভব না। তাই একজন কাজের মহিলাকে ঠিক করা হয় যে দিনের বেলা খোদেজাকে সংসারের কাজে সহযোগিতা করবে।

রাজিয়া নানী বাড়িতে বেশ ভালই আছে। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস ফাইভে সে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পায়। স্কুলের শিক্ষকরাও বেশ খুশি রাজিয়ার মতো ছাত্রী পেয়ে। কেননা শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম। বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র/ছাত্রীদের সরকার উপবৃত্তির টাকা দিয়ে থাকে। প্রথম উপবৃত্তির টাকা দিয়ে রাজিয়া তার বাবার জন্য একটা ফতুয়া কিনেছে। অনেক দিন হলো মেয়েকে দেখতে আসে না বাবা। তাই রাজিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেই বাবাকে দেখতে যাবে। কিন্তু একা সে কিভাবে যাবে? তাই তার মামাকে রাজি করিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে যায়। বাড়িতে না গিয়ে সোজা দোকানে যায় রাজিয়া। কেননা বাবা দিনের বেলা বাড়িতে থাকে না। রাজিয়া এও জানে তার মা তাকে দেখলে রেগে যাবেন তাই মামাকে আগেই বলে রেখেছিল শুধু বাবার সাথে দেখা করবে। বাজারে ঢুকেই এক দৌড় দেয় রাজিয়া। মামা পিছনেই রয়ে যায়।

অন্যমনস্ক আজমল হুট করে বাবা ডাক শুনে হকচকিয়ে উঠে। মেয়েকে দেখে কি বলবে ভাষা হারিয়ে ফেলে। রাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। রাজিয়াও চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। সেই ছোট্টটি আর নেই রাজিয়া। বাবার কান্নার কারণ ঠিকই বুঝতে পারে সে।

- মা আমার তুই একা কিভাবে এলি?

- একা কোথায় মামাও এসেছে। আমি বাজারে ঢুকেই দৌড়ে চলে এসেছি।

- দাড়া মা, আমি দোকান বন্ধ করি। বাড়িতে গিয়ে খেতে খেতে কথা হবে।

- না বাবা আজকে আর বাড়ি যাবো না। কাল পরীক্ষা আছে। মামাকে এই শর্তেই রাজি করিয়েছি তোমার সাথে দেখা করেই চলে আসবো।

- আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই।

- ওয়ালাইকুম সালাম। আব্বা-আম্মা (আজমল এর শ্বশুর শাশুড়ী) কেমন আছে?

- হ্যাঁ ভালো। তবে আম্মা শরীরটা ভালো না। একবার আপনাকে যেতে বলেছেন।

- তাহলে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছো থাকবে না?

- হ্যা দুলাভাই বাড়িতে দুইজন বৃদ্ধ মানুষ। কখন কি হয়? তাই তাদের একা রেখে বাহিরে থাকা ঠিক হবে না। রাজিয়া যদি থাকে তাহলে থাকুক। আমি না হয় চলে যাই।

রাজিয়া জানে সে বাড়িতে গেলে আরেক অশান্তি তৈরি হতে পারে। তাই সে মিথ্যা বলেছে তার কাল পরীক্ষা আছে।

কিছুদিন হলো দোকানের কাজের ছেলেটা আর আসছে না। দুপুরে খাবার নিতে বাড়িতে গিয়ে ছেলেটাকে খোদেজা কি যে বলেছে এরপর থেকেই আর আসছে না ছেলেটা। বাড়িতে এখন একাই থাকে খোদেজা। দোকান বন্ধ করে আজমল সন্ধ্যার দিকেই বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করে। তারপরও আসতে আসতে সেই রাত দশটা বেজে যায়। ঘরে ফিরে ঢেকে রাখা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়া এবং সকালে উঠে গোসল করে দোকানে যাওয়া এভাবেই চলতে থাকে আজমলের দিন। স্ত্রীর সাথে তেমন কথা বার্তাই হয় না। যখন ঘরে ফিরে আসে তখন খোদেজা ঘূমিয়ে পড়ে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে রান্না বান্নার কাজে ব্যস্ত।

শনিবার হাটবার। আজ বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হবে আজমলের। যাওয়ার সময় খোদেজাকে জানিয়ে দেয়, সে যেন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক দিন হলো মেয়েটাকে দেখে না। তাই একবার মেয়ের নানীর বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতে থাকে আজমল। হাটে নতুন নতুন জামা কাপড় উঠে। মেয়ের জন্য একটি লাল ফ্রক এবং এক জোড়া জুতা কিনে রওয়ানা হয় আজমল। সাথে কিছু মন্ডা মিঠাই ও তরি তরকারীও কিনে নেয়। অনেক দিন পর মেয়েকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে বাবা। মেয়েও বাবাকে পেয়ে অনেক খুশি।

- বাবা, মা কেমন আছে। কিছু বলছো না যে, মা কেমন আছে?

আজমল উত্তর না দিয়ে চুপ থাকে। যে মায়ের জন্য বাড়ি ছাড়া তার জন্য কত আকুতি মেয়ের।

- হ্যা ভালো আছে।

- তুমি একা ! মা’কে নিয়ে এলে না কেন?

- তোর মা’র শরীরটা ভালো না। তোর পড়াশুনা কেমন চলছে।

- হ্যা, আমার পড়াশুনা ভালো চলছে। মা’কে অসুস্থ রেখে তুমি কেন এসেছো। তাড়াতাড়ি খেয়ে বাড়ি যাও।

মেয়েকে মিথ্যো কথা বলেছে কিন্তু মেয়ে তা ধরতে পারেনি। রাজিয়া জানে না তার মা’কে বললেও সে আসতো না। খাওয়া শেষ করে এক প্রকার জোর করে বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় মেয়ে। কারণ মা’ বাড়িতে অসুস্থ একা। আজমল কিছু বলতেও পারছিল না। নিরুপায় বাড়ির পথে পা বাড়ায়। যেখানে প্রাণী আছে কিন্তু কোন প্রাণ নেই, হাসি নেই, নেই কোন উচ্ছাস, নেই কোন আনন্দ উল্লাস। মন না চাইলেও বাড়ি ফিরতে হয় আজমলকে। বাড়িতে ঢুকতেই শোয়ার ঘর থেকে পুরুষ মানুষের কন্ঠ শুনতে পায় আজমল। বাড়িতে কি তাহলে চোর ঢুকেছে! চুপটি করে ঘরের ছিটকিনি আটকিয়ে জোর গলায় চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকে আজমল। পাড়ার সবাই জড়ো হয়। ঘরের ছিটকিনি খুলে স্ত্রী খোদেজা ও মাতব্বরের ছেলে জয়নালকে বের করা হয়। কারো বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কি? তার স্ত্রী এমন কাজ করবে বিশ্বাস করতে পারছিল না আজমল। খোদেজাকে কিছুই না বলে সবাইকে চলে যেতে অনুরোধ জানায় আজমল। এলাকার মুরুব্বীরা খোদেজাকে নষ্টা পরিচয় দিয়ে তাকে গ্রাম ছাড়া করার দাবি জানালে অনেক বিনয় অনুরোধ করে স্ত্রীর ভুল শুধরানোর জন্য সুযোগ চায় স্বামী আজমল। অন্যের স্ত্রীর সাথে অনৈত্তিক সম্পর্ক গড়ার কারণে মাতব্বরের ছেলে জয়নালকে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং সতর্ক করা হয়।

খোদেজার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। মায়ের দেখাশুনার জন্য রাজিয়াকে ওর নানী বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেদিন রাজিয়া বাড়ি আসার পর ওর গরুগুলো ওকে দেখে সে কি খুশি। মাথা হেলে দুলে রাজিয়াকে স্বাগত জানায় তারা। পোষা প্রাণীগুলোর কাছে গিয়ে অনেক আদর করে তাদের কানে কি যেন বলতে থাকে রাজিয়া। এদিকে সে জানে না তার মায়ের কেলেংকারীর কথা। খোদেজার শরীরটা ইদানিং ভালো না থাকায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার জানায় খোদেজা গর্ভবতী। খবরটা শুনে আজমলের চোখে মুখে খুশির ফোয়ারা বইতে শুরু করে। সে ভুলে গেছে স্ত্রীর অতীতের কেলেংকারীর কথা। কিন্তু খোদেজা এই খবরে কিছুতেই খুশি হতে পারছিল না।

বাড়িতে গর্ভবতী স্ত্রী একা। মায়ের দেখাশুনা ও বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম একাই করতে হচ্ছে রাজিয়াকে। পড়াশুনা বন্ধ। বাবা হয়ে কিছুই যেন করার নেই আজমলের। সংসার নামক নতুন এক বিদ্যালয়ের ছাত্রী এখন রাজিয়া।

এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় বছর পেরিয়ে যায়। একদিন ভোরে খোদেজার পেটে ভিষন ব্যাথা অনুভব হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ডাক্তাররা জানায় পেটের বাচ্চাটিকে বাঁচাতে চাইলে মা’কে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হবে না। আজমল জানায় যেভাবেই হোক খোদেজাকে বাঁচানো হোক। খোদেজাকে জীবন রক্ষা হলেও সন্তান হারিয়ে আজমল হতবিহ¦ল হয়ে পড়ে। কিছুদিন হাসপাতালে রেখে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয় খোদেজাকে। মায়ের যেন কোনরূপ সমস্যা না হয় এদিকে সদা সজাগ রাজিয়া। এদিকে মেয়েটা ডাঙ্গর হতে চলেছে। তারও বিয়ে দেয়া দরকার। বাবা হয়ে এই চিন্তা সর্বদা ঘুরপাক খেতে থাকে আজমলের মাথায়।

শোবার ঘরের খাটের নিচে একটা ট্রাংক রয়েছে কাউকে কোনদিন সেই ট্রাংকে হাত দিতে দেয়নি আজমল। এমনকি স্ত্রী খোদেজা অনেকবার চেষ্টা করেও সেই ট্রাংকে কি আছে জানতে পারেনি। একদিন আজমল বলে ফেলে সেই ট্রাংকের রহস্য। রাজিয়ার মায়ের কিছু গহনা ও সারাজীবনের কিছু উপার্জন সেই ট্রাংকে রাখা আছে। এরপর থেকেই সেই ট্রাংকে খোদেজার লোলুভ দৃষ্টি পড়ে। সন্তান হারার পর থেকে খোদেজা কেন জানি অনেক বদমেজাজী হয়ে গেছে। রাজিয়ার সাথে সব সময় খারাপ আচরন করে। স্বামীর প্রতিও ভালোবাসা নেই বললেই চলে।

বাবা বাড়িতে না আসা পর্যন্ত জেগে থাকে রাজিয়া। তারপর বাবাকে খাইয়ে সে খায়। রাতের খাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে আজমল চিন্তা করতে থাকে মেয়ে বড় হয়েছে তার বিয়ে দিতে হবে। যে টাকাটা সে এতদিনে জমিয়েছে তা দিয়েই কণ্যার আকদ অনুষ্ঠানটা শেষ করবে। ভালো পাত্র পেলেই বিয়ে দেবে রাজিয়ার।

দোকানের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে আজমল। খোদেজা তার কাপড় চোপড় গুছানোতে ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করলে জানায়, সে তার বাবার বাড়ি যাবে। আজমল জানায়, কিছুদিন পরে গেলে হয় না? খোদেজা নাছোড়বান্দা সে আজই যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে রাজিয়াকেও সাথে নিয়ে যাও। ও অনেকদিন কোথাও যায় না। কথাটা শুনে খোদেজা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। রাজিয়াকে নিয়ে যেতে কোনভাবেই রাজি হয় না খোদেজা। এক পর্যায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভিষণ কথা কাটাকাটি হয়। আজমল কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় দোকানের উদ্দেশ্যে।

আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে আজমল। সকালে খোদেজার সাথে কথা কাটাকাটির কারণে দোকানে মন বসছিল না।

- রাজিয়া, রাজিয়া কোথায় গেলি মা।

- বাবা তুমি এসেছো?

- তোর মা কোথায়?

- মা তো চলে গেছে।

- চলে গেছে ! তুই আটকাতে পারিস নি।

- চেষ্টা করেছিলাম।

কথা শেষ করেই প্রায় দৌড়ে ঘরে যায় আজমল। যেই ট্রাংক খুলতে যাবে দেখে ট্রাংকের তালা আগে থেকেই ভাঙ্গা। এতদিনের সঞ্চিত টাকা ও রাজিয়ার মায়ের গহনাগুলো সব নিয়ে গেছে খোদেজা। মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ে আজমলের। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকাটা সে রেখেছিল। এলাকার মুরুব্বি চেয়ারম্যান মেম্বারদের ডেকে সলা-পরামর্শ করা হলে সবাই একবাক্যে স্ত্রীর পূর্বের কেলেংকারীর ঘটনা ও চুরি কারণে খোদেজার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার পরামর্শ দেয়। আজমল রাজি হয় না তাতে। খোদেজার বাবার বাড়িতে খোজ নেয়া হয়। জানা যায়, সে ওখানেও যায়নি। তাই সবার পরামর্শেই থানায় গিয়ে স্ত্রীর বিরুদ্ধে চুরির মামলা করে আজমল।

গ্রামে ঘটনা রটে যায় আজমলের বউ পালিয়ে গিয়েছে মাতব্বরের ছেলের সাথে। লজ্জায় আজমল আর দোকানেও যেতে পারছে না। কয়েকদিন বাড়িতেই চুপটি মেরে থাকার পর মেয়ে রাজিয়ার চাপে শেষে দোকানে খুলে আজমল। স্ত্রী খোদেজা ও মাতব্বরের ছেলে জয়নালের বিরুদ্ধে মামলা করার পর পুলিশ তদন্ত করতে আসে। বাড়িতে রাজিয়া একা থাকায় দোকানে যেতে বলা হলেও সাক্ষী হিসেবে রাজিয়ার জবানবন্দি রেকর্ড করে পুলিশ। অনেক প্রশ্ন করা হয় রাজিয়াকে। খুব কষ্ট হচ্ছিল তার সেসব উত্তর দিতে।

- তোমার মায়ের অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল তুমি কি তা জানতে?

প্রশ্ন শুনে রাজিয়ার মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো উপক্রম। সৎ মা হলেও মা। নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কথা শুনার পর কারও ভালো লাগার কথা না। রাজিয়া উত্তর দেয় সে এ সম্পর্কে কিছুই জানে না।

- যেদিন তোমার মা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তুমি কি দেখেছিলে টাকা পয়সা গহনা চুরি করতে?

- না। দোহাই আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না।

আজমলের মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে মেয়েকে বিয়ে দেবে। গচ্ছিত যা টাকা গহনা ছিল সব তো গেছে। এখন মেয়ের বিয়ে দিতে হলে জায়গা জমিন দোকান বিক্রি করতে হবে। ভিটে মাটি বাদে যে জায়গা জমি রয়েছে তা বিক্রি করে হয়তো লাখ দুই তিনেক টাকা হবে। একটা ভালো ঘরের খোঁজ এসেছে ছেলে মাস্টার্স পাশ সরকারী চাকুরীর কথা বার্তা চলছে। আজমল সাহেব সিদ্ধান্ত নেয় এখানেই মেয়েকে বিয়ে দেবেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরার পথে তিন জন যুবক পথ আগলে দাড়ায় আজমলের। কোন কিছু বলার আগেই এলোপাথারি কিল ঘুষি মারতে থাকে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একজন ছুরি চালিয়ে দেয় পিঠে। পিঠ বেয়ে অনরগল রক্ত ঝরতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারে কিছু লোক কাছে আসতেই যুবক তিনজন পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বলে, এ যাত্রায় বেঁচে গেলি পরেরবার আর বাঁচবি না। ধরাধরি করে আজমলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে রাজিয়াকে খবর দেয়া হলে পাশের বাড়ির এক চাচাকে নিয়ে রাতেই হাসপাতালে চলে যায়। বাবাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আজমল মেয়ের কান্না দেখে শান্তনা দেয় তেমন কিছু হয়নি। তাছাড়া এটা হাসপাতাল এখানে এভাবে কান্নাকাটি করলে আমাদের বাবা-মেয়েকে শেষে বের করে না দেয়। একটা ইস্ফিত হাসি দিয়ে কথাগুলো বলে আজমল। এবার রাজিয়া কান্না থামায়। তার প্রশ্ন কিভাবে হলো? আজমল নিজেও জানে না আসলে ঐ তিন যুবক কি কারণে তাকে আক্রমন করেছিল। তারা যদি টাকার জন্য আক্রমন করে থাকতো তাহলে তার কাছে যে টাকা ছিলো তা না নিয়ে হত্যার জন্য ছুরিকাঘাত করার কারন কি? আজমলের মনে পড়ে যায় ছেলেগুলো পালিয়ে যাওয়ার সময় কি বলেছিল ! হয়তো মাতব্বরের ছেলে জয়নাল লোক লাগিয়ে এসব করেছে। কেননা তার বিরুদ্ধেও থানায় মামলা করা হয়েছে যার দরুন সে এলাকায় ঢুকতে পারছিল না।

কিছু দিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়িতে নিয়ে আসা হয় আজমলকে। বাবার সেবা যত্নে কোন কমতি রাখে না মেয়ে। অল্পদিনেই সুস্থ হয়ে উঠে আজমল। একদিন বাবা-মেয়ে খেতে বসে আজমল রাজিয়াকে বলে, মা তোকে যখন পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো তখন তোর এই বুড়া বাবাকে মনে পড়বে তো?

- আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও গেলে তো।

- তা কি হয়? মেয়ে হয়ে জন্মেছিস স্বামীর ঘরই তোর শেষ ঠিকানা।

- অত শত বুঝি না। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না, ব্যাছ।

- একটা ভালো ঘর পেয়েছি। ছেলে মাস্টার্স পাশ। একটা সরকারী চাকুরির কথা বার্তা চলছে। তুই ওখানে বেশ ভালো থাকবি।

- আমি কি তোমার বোঝা হয়ে গেছি যে, আমাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচো? তোমাকে কে দেখবে আমি চলে গেলে।

- আমাকে দেখার লোকের অভাব? তোর বিয়ের পর একটা ফুটফুটে নাতী হবে সে আমাকে দেখবে।

- হু... এখনও বিয়েই হয়নি উনি আছেন নাতী নাতনি নিয়ে।

- ছেলেটাকে আমি দেখেছি। আমার দোকানে একদিন এসেছিল। দুইজনকে বেশ মানাবে।

বাবার এ কথা শুনে এবার একটু লজ্জা পায় রাজিয়া। কিন্তু বাবার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে বিয়ের সম্পর্কটাকে কেনজানি সহজভাবে নিতে কষ্ট হয়। কোন কিছুর অভাব ছিলো না তথাপি তার মা খোদেজা তার বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। যে বাবা হিসেবে এত ভালো মানুষ স্বামী হিসেবেও খারাপ হওয়ার কোন কারন রাজিয়া খুজে পায় না।

খোদেজা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাতব্বরের ছেলে জয়নালকেও আর এলাকায় দেখা যায় না। সবাই ধরে নিয়েছে দুইজন একসঙ্গে কোথাও পালিয়ে গেছে। এদিকে থানায় মামলা হওয়ায় তাদের নামে পরোয়ানা জারি হয়। একদিন বাড়িতে পুলিশ আসে আজমলকে খুজতে। রাজিয়া জানায় বাবা তো বাড়িতে নেই, বাজারে গিয়ে খোজ নিন। বাজারে গিয়ে পুলিশ আজমলের হাতে হ্যান্ডকাপ পড়ায়। জিজ্ঞেস করা হয় তার অপরাধ কি? পুলিশ জানায় আজমলের বিরুদ্ধে থানায় তার স্ত্রী খোদেজা নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলা করেছে। আজমল কিংকর্তব্যবিমুঢ় শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে চেয়ে থাকে। এই খবর গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রাজিয়া শুনে তো পাগলপ্রায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সেই ছোট বেলা থেকেই মেয়েটিকে অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

কোর্টে আজমলকে চালান করা হলে আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করে। রাজিয়া যার এখন স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় সে এখন কোর্টের বারান্দায় ঘুরছে বাবার জামিনের জন্য। একজন উকিলকে ধরা হয় বাবার জামিনের জন্য। জামিন আজ হবে কাল হবে এভাবে ছয় মাস পার করে দেয় উকিল সাহেব। তারপর একদিন আজমল জেল হাজত থেকে জামিনে মুক্তি পায়।

রাজিয়া জানতো না তার বাবা আজ মুক্তি পাবে। জানলে আগেই জেল গেটে চলে যেতো। চুলায় রান্না। গোয়াল ঘরে গরুগুলো বাধা, তাদের খাবার দিচ্ছে রাজিয়া। বাহির থেকে কে যেন রাজিয়া রাজিয়া বলে ডাক দিচ্ছে। ডাকটা কানে পৌছা মাত্র বুকটা ধক করে উঠে রাজিয়ার। বাবার গলা না? চুলায় রান্না রেখে এক দৌড়ে দরজায় গিয়ে দেখে, ঠিকই তো বাবা ফিরে এসেছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাজিয়ার বুক ফাঁটা কান্নার আওয়াজে পাড়ার সবাই জড়ো হয়ে যায়। সবাই এ দৃশ্য দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। কেউ শাড়ির আচল কেউবা গামছা দিয়ে নিজের চোখের জল মুছতে থাকে

শুক্রবার বাবা বাড়িতেই থাকে। তাই আজকে বাড়িতে ভালো রান্না বান্না হবে। একটা মুরগি ধরা হয়েছে। আজমল যখন জেলে তখন রাজিয়ার মামা-মামি মামাতো ভাই সবাই এখানেই চলে আসে। ছোট ভাই গিফারীকে নিয়ে মুরগি ধরা হলো। জবাই করার জন্য বাবাকে ডাক দিলো রাজিয়া। আজমল দেখে আসছে রাজিয়া তার শৈশবে যখনই মুরগি জবাই করতে হতো, সবসময় তার কাছে এসে মুরগির ডানা ও পা ধরে বলতো, “আব্বা মুরগিটা যেন বেশি কষ্ট না পায়”।

রাজিয়ার রান্নার হাতটা অনেক ভালো। ছোট বেলা থেকেই রান্না বান্না করে আসছে। বাবা কতদিন হলো ভালো কিছু খায় না। জেলের রুটি ডাল মোটা চালের ভাত খাওয়ার ফলে বাবার শরীরটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে আগের থেকে। আজমল অবশ্য ঠিক এ কারণে নয়, মেয়ে বাড়িতে একা এই দুশ্চিন্তায় তার আধাপাকা চুলের মাথাটা সাদা চুলে ভরে গেছে।

নতুন করে আজমল শুরুর চিন্তা ভাবনা করছে। তার প্রথম কাজটাই হলো রাজিয়াকে বিয়ে দেয়া। রাজিয়া জানলে রেগে যাবে এটা খুব ভালো করেই জানে আজমল। তথাপি আজকে সবার সঙ্গে খেতে বসে কথাটা তুলতেই হবে। সবার সামনে হয়তো মেয়ে বাবার কথা ফেলতে পারবে না।

- দুলাভাই আমরা তো অনেক দিন এখানে থাকলাম। আজ চলে যাবো ভাবছি।

- কেন যাবে। তোমরা বরং এখানে একবারে থেকে যাও। তুমি না হয় আমার দোকানে বসো। আমি আর পারবো না।

- তা কি হয় দুলাভাই। গিফারীর পড়াশুনা। পুকুরের মাছগুলো আছে না সব চুরি হয়ে গেলো, খোজ নিতে পারি নি ঠিকমত। এখন রাজিয়ার একটা বিয়ে দিতে পারলেই হয়।

মামার কথাটা রাজিয়ার কানে পৌছা মাত্র রাজিয়া যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। আজমল অবশ্য খুশি হয়েছে, কথাটা নিজে তুলতে চাইলে রাজিয়ার মামা তা তোলায়।

- মামা তোমরা থামবে। আমি কিন্তু বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।

- তাই কি হয় মা। তোর বাবার বয়স হয়েছে শরীরটাও ভালো না।

- রাজিয়া মা আমার তুই বুঝতে পারছিস না কেন? সেই দুর্ঘটনার পর থেকে পিঠের ব্যাথাটা আজ অবধি খুব কষ্ট দিচ্ছে। বলা তো যায় না কখন কি হয়।

বাবার মুখ চেপে ধরে রাজিয়া। তার ধারনা মৃত্যুর কথা মুখে আনতে নেই। সত্যিই তো আজমলের মৃত্যুর পর রাজিয়ার দেখাশুনা কে করবে।

- বাবা তুমি থামবে। আমি কি বলেছি আমি বিয়ে করবো না। তোমাকে কে দেখবে আমি চলে গেলে।

- আমার দেখার লোকের অভাব পড়লো দেশে। তোর এই বুড়া বাপের কথা ভাবতে গিয়ে তুই কি তোর জীবনটাই শেষ করে দিবি।

- দুলাভাই, ভালো একটা ঘরের কথা আগে একবার আপনাকে বলেছিলাম। ছেলে শিক্ষিত। বাবা-মা দু’জনে চাকুরি করে। উচ্চবংশীয় পরিবার। আপনি চাইলেই কথা বলতে পারি।

- গিফারীর আব্বা তুমি না হয় কথা বলো। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

বর্তমান বাজারে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে এখন অনেক টাকা খরচ। তাছাড়া ছেলের নাকি একটি সরকারী চাকুরীর কথা বার্তা চলছে। কিছু টাকা দিতে পারলেই চাকুরীটা হবে। মেয়ের সুখের কথা ভেবে আজমল রাজি হয়ে যায়। খোদেজা বাড়ি থেকে টাকা গহনা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সম্পদ বলতে আর শুধু তার ২ বিঘা জমি ও বসত বাড়ির ভিটাটাই রয়েছে। জমিগুলো বিক্রি করে যে টাকাটা পায় তা দিয়েই মেয়ের বিয়ে দেয়ার কথা ভাবতে থাকে আজমল।

রাজিয়ার কিছুদিন ধরে মনের ভিতরে একটা খুশি খুশি ভাব থাকলেও কপালে চিন্তার ভাজ। তার বিয়ে হওয়ার পর যখন সে চলে যাবে তার বাবাকে কে রেধে খাওয়াবে। বাবার কাপড় চোপড় কে ধুয়ে দেবে। লালু শালুদের কে দেখবে। লালু শালু রাজিয়ার দুইটি পোষা গরু।

আজকে রাজিয়াকে দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ। বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে একজন অপরজনকে দেখে পছন্দ হওয়ার পরই বিয়ে দেয়া উচিত। এই বিষয়টি আজমল অগ্রাধিকার দেয়। ইতিপূর্বে আজমল ছেলেকে দেখেছে তার পছন্দ হয়েছে। মেয়ে যেহেতু দেখেনি তাই একবার তার ছেলেকে দেখা উচিত ঠিক তেমনি ছেলেরও। বাড়িতে অনেক রান্না বান্না হয়েছে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজিয়া চুলা ধরায়। দুপুর অবধি চলতে থাকে বিভিন্ন প্রকারের রান্না। নিজেই ভাবি বরকে রেধে খাওয়াবে, রাজিয়ার ভাবতেই লজ্জা করছে।

ছেলে পক্ষ থেকে ছেলের মা ছেলে তার ফুফু ছেলের বন্ধু ও এক দুলাভাই এসেছে। রাজিয়াকে হাল্কা পাউডার ও স্নোতে যেন এক অন্য রাজিয়াকে দেখতে পায় আজমল। সেই ছোট্ট রাজিয়া আজ কত বড় হয়েছে। দু’দিন বাদে মেয়ে পরের ঘরে চলে যাবে। আজমলের চোখ দিয়ে নিরবে লোনা জল ঝরতে থাকে। মেয়ে বাবার নিরব কান্নার সঙ্গি হয়। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে।

- মা কি করছিস। বাড়িতে কত মেহমান এভাবে কাঁদলে যে মানুষ খারাপ বলবে।

- বাবা আমি কি তোমার এতই বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম।

ঘরে ছেলে পক্ষের সবাই বসে আছে। রাজিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে সবাইকে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। একবারও মাথা তুলে হবু স্বামীকে দেখার সাহস হয় না রাজিয়ার। বাবার পছন্দই রাজিয়ার পছন্দ এই কথাটি বাবাকে এর আগে বললেও আজমল মেয়ের কথার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেই ছেলেকে দেখার সুযোগ করে দেয়। তাছাড়া আজমল নামাজ রোজা করেন। মুসলিম বিশ্বাসে অধিক বিশ্বাসী। আশপাশ কোথাও ওয়াজ মাহফিল হলেই চলে যান। একদিন এক ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে জানতে পারে, বিয়ের পূর্বে ছেলে মেয়ের পূর্ণ অধিকার আছে একজন আরেকজনকে দেখার। তাদের পছন্দেই যেন বাবা-মা সন্তাদের বিয়ে দেয়।

অনেক প্রশ্ন করা হয় রাজিয়াকে। সে কতদুর পড়াশুনা করেছে। রান্না বান্না পারে কিনা? আরো টুকটাক অনেক কিছু। পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে ছেলের মা ও ফুফু রাজিয়ার মাথার চুল পর্যন্ত খুলে দেখে। রাজিয়া রুপে গুনে এক অনন্য সৃষ্টি। হালকা পাতলা ছিপছিপে গড়ন। চোখের ভুরুগুলো রাজিয়ার অসাধারন। চোখগুলো তার মায়ার সাগর। মাথার চুল খুলে দেখতে গিয়ে ছেলের মা ও ফুল তো অবাক কেননা রাজিয়ার মাথার চুলগুলো কোমড় বেয়ে যেন হাটুতে ঝুলছে। এরপর রাজিয়াকে একান্ত ছেলের সাথে কথা বলতে দেয়া হয়। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

(চলবে)

বিষয়: সাহিত্য

১৯১৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

379074
২৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ০৯:৪৯
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : অন্যরকম লেখা। খুব সাধারণ লেখা কিন্তু অসাধারণ লেগেছে।
379080
২৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১১:৩৪
কুয়েত থেকে লিখেছেন : অসাধারণ ভালো লেগেছে লেখাটি অনেক ধন্যবাদ
379082
২৫ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১১:৪০
সত্যের বিজয় লিখেছেন : অনেক ভাল লেগেছে ভাই।কি বলব পড়তে পড়তে যেন হারিয়ে গেছি অতীতে
379091
২৬ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১২:৪৩
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : ভালো লাগলো / ধন্যবাদ /
380203
২৭ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০২:৪৫
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File