একজন দুর্গাপ্রসাদ দেশমুখ এর ইসলাম ধর্ম গ্রহনের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন বাচ্চা ছেলে ২১ নভেম্বর, ২০১৩, ০৭:০১:৩৯ সন্ধ্যা
১৯৮১ সাল দক্ষিণ ভারতের মিনাক্ষীপুরমের বিপুল সংখ্যক হরিজন যে বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করে তখনকার সে সম্মিলিত ধর্মান্তর গ্রহণের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলি মারমুখো ভূমিকা গ্রহন করার পর কিন্তু সাধারন মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ মোটেই কমেনি বরং আরও বৃদ্ধি পায়।
মিনাক্ষীপুরমে বছরের পর বছর খরা ও দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় লোকগুলোকে জীবন ধারনের মত সামান্য ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিল স্থানীয় কিছুসংখ্যক মুসলমান। সাহায্যকারী ঐ লোকগুলোর আর্থিক অবস্থাও খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। এতদসত্ত্বেও তারা নিছক মানবিক অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্দশাগ্রস্ত লোকগুলির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে সাহায্য পর্যাপ্ত না হলেও তাতে ছিল ভালবাসা ও আন্তরিকতার পরশ। মিনাক্ষীপুরমবাসীরা কিন্তু গরিব মুসলমানদের সে সাহায্যে অভিভূত হয়নি। ওরা অভিভূত হয়েছিল মুসলমানদের আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ দেখে। ওরা তখন অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিল যে, তারাও মানুষ। তাদের মানুষের কাতারে স্থান দেওয়ার মত লোকও দুনিয়াতে রয়েছে।
শ্রী দুর্গাপ্রসাদ দেশমুখ একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক, একটি জনপ্রিয় দৈনিক ‘হিন্দু সেনানী’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।
মি: দেশমুখ সেদিন বলেছিলেন, “উচ্চ বর্ণের শোষকদের থেকে আত্মরক্ষা করার লক্ষ্যে দক্ষিণ ভারতের বিপুল সংখ্যক দলিত শ্রেণীর লোক ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহন করছে। এ ধর্মান্তরের ফলে সংশ্লিষ্ট লোকগুলি নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছে। আগে যেখানে তাদের দিকে চোখ তুলে চাওয়ার মতও কেউ ছিল না, বর্তমানে সে লোকগুলিই উন্নতর জীবনের সন্ধান লাভ করেছে।
নও মুসলিম সে লোকগুলির পরিবর্তিত জীবনযাত্রাকে নজীর হিসাবে তুলে ধরে হিন্দুধর্ম ব্যবসায়ীদের সারা ভারতে একটা তুমুল তান্ডবের সৃষ্টি করেছিল। এই বলে তারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল যে, মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের দ্বারা বশীভূত করে এসব লোককে ধর্মত্যাগে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। আর এভাবেই নাকি ভারতকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় রুপান্তরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই? উচ্চবর্ণের ঘৃণার আগুনে দগ্ধ হয়ে যেসব হরিজন শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের পরিচয় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাকুল, সেই বিপুল জনতার জন্য ওরা কী করছে?
এ ঘটনাটিকেই পুজি করে ভারতের ধর্ম ব্যবসায়ী কট্টর সাম্প্রদায়ীকতাবাদী হিন্দু সংগঠনগুলি আকাশ-পাতাল এক করে ফেলার আয়োজন করেছিল। উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে বয়ে আসা পেট্রোডলারের এক প্লাবন তারা প্রত্যক্ষ করেছিল। আর কল্পিত এ প্লাবনের মুকাবিলা করার কঠোর সংকল্প ঘোষনা করে। তারা হুজুগপ্রিয় হিন্দু জনগনের নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা চাঁদাও সংগ্রহ করে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় গেলো সেই বিপুল অর্থ? দেশের কোথাও কোন দলিত হরিজন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কি একটি টাকাও ব্যয়িত হয়েছে? একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী সে বিপুল অর্থ হরিলুট করেছে।”
প্রসঙ্গত মিঃ দেশমুখ সেসময় প্রশ্ন করেছিলেন, “দু’চারজন দলিত লোক ইসলামে দীক্ষিত হলে পর হিন্দু সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আর্ত চীৎকার জুড়ে দেন। অথচ তাদের চোখের সামনেই যখন বিত্ত ও ক্ষমতাবর্গী উচ্চবর্ণের শোষকেরা দলিত হরিজনদের দলবদ্ধভাবে পুড়িয়ে মারে, তখন ওরা মুখ খোলে না কেন? অত্যাচারীর কৃপায় আহত অপঘাত মৃত্যুর চাইতে কি ধর্মারন্তর গ্রহন বেশী গুরুতর ঘটনা?
শ্রী দুর্গাপ্রসাদ দেশমুখ তার নিজের শহর আগ্রার ভাংমন্ডি এলাকায় অবস্থিত তাল-হাবিবুল্লাহ মসজিদে উপস্থিত হন বিনোদ কুমার নামক তাঁর এক সঙ্গীকে সাথে নিয়ে। ইমাম সাহেবের নিকট সরাসরি তিনি তাঁর অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করেন এবং দু’জনেই এক সাথে কালিমা পাঠ করে ইসলামে দীক্ষিত হন। তাঁর নাম রাখা মুহাম্মদ দাউদ খান এবং তাঁর সঙ্গী বিনোদ কুমারের নাম রাখা হয় মুহাম্মদ আকরাম।
শ্রী দুর্গাপ্রসাদের ন্যায় একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক এবং একটি জনপ্রিয় হিন্দী দৈনিকের প্রধান সম্পাদকের ইসলাম গ্রহন স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যেও মারাত্মক উদ্বেগের সৃষ্টি করে। উত্তর প্রদেশের গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত শুরু করে। মিঃ দেশমুখের ন্যায় উত্তর প্রদেশের একজন বিরাট সামাজির ব্যক্তিত্বের ইসলাম গ্রহন ইতিমধ্যেই নানা ধরনের গুজবের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসনের একটি অংশ এ মর্মে একটি হাস্যকর গুজব ছড়াচ্ছে যে, বোম্বের বিখ্যাত ধনী-ব্যবসায়ী এবং আন্তর্জাতিক চোরাচালানের সম্রান নামে খ্যাত হাজী মস্তান নাকি উত্তর প্রদেশের দলিত হরিজনদের ধর্মারন্তরিত করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার একটি বিরাট পরিকল্পনা গ্রহন করেছে।
ধর্মান্তরিত হবার পর মি: দেশমুখ@দাউদ খান বলেছিলেন, “সমাজে সর্বাপেক্ষা সুবিধাভোগী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের অন্তঃসারশূণ্য জাত্যাভিমান এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের প্রতি অমানবিক হিংস্রতা আজ হিন্দু ধর্মকেই গণ-বিবেকের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত শ্রেণী আজ উচ্চবর্ণ ধর্মব্যবসায়ীদের শোষনের যাতাকল থেকে মুক্ত হয়ে আসতে চায়। দলিত শ্রেণীর কেউ ইসলাম গ্রহন করলে উচ্চবর্ণ হিন্দুরা দারুণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র একসাথে নড়ে উঠে। ওদের ধারনা ইসলামের সামাজিক সাম্য ও মৈত্রীর সাথে যদি দলিত শ্রেণীর পরিচয় গভীর হয়ে পড়ে, তবে এই ভারতের বুকেই আর একটা অবিশ্বাস্য গণ-বিপ্লব সংগঠিত হয়ে যাওয়াটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়।”
তিনি আরো বলেন, “ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর আমাকে কি ধরনের সামাজিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে এটা আমি বুছি। ইতিমধ্যেই চারদিক থেকে হুমকি আসতে শুরু করেছে। কয়দিন আগেও যারা সমীহ করে কথা বলত, আজ তারা যেন অপরিচিত হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। আমার ইসলাম গ্রহন কোন আকস্মিক হুজুগের ব্যাপার নয়। অনেক পড়াশোনার পরই আমি ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় লাভ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি। ”
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি ইসলাম গ্রহন করলেন? এ সম্পর্কে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,
“আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান ভারতে সর্বাপেক্ষা বেশি বিপন্ন মনুষ্যত্ব। একটা ঘ্রণ্য জাত্যাভিমানের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে এদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দ্রুত নিশ্চিত ধ্বংসের পথে অগ্রহর হচ্ছে। এ লোকগুলি নিম্নবর্ণের হরিজন নামে পরিচিত। এরা নিজেদের হিন্দু ধর্মের অনুসারী রূপে পরিচিত করেও নিম্নতম ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত। মন্দিরে প্রবেশ করে আরাধ্য দেবতার পায়ে একটা ফুলের অর্ঘ্য নিবেদন করার অধিকার থেকেও এরা বঞ্চিত। ফলে সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও এরা এমন এক পর্যায়ে অবস্থান করছে যে, অনেক ক্ষেত্রে জীবনকে সুন্দরভাবে উপলব্ধী করার সুযোগ থেকেও এরা বঞ্চিত।
আমি সচেতনভাবেই বিশ্বাস করি যে, এ অগনিত অসহায় জনগোষ্টীকে একমাত্র ইসলামই মুক্তি দিতে পারে। আমি লক্ষ্য করেছি, হরিজনদের মধ্যে যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করেছিল, এক-দুই পুরুষ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও ওদের সেই অচ্ছুৎ পরিচয় দূর হয়নি। মানসিক দিক দিয়েও ওরা খুব একটা উন্নত হতে পারেনি। বরং একটা হীনমন্যতা বোধে তাড়িত হয়েই ওরা এখনও অনেকটা অপাংক্তেয় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
অপরদিকে ইসলামী সমাজ যে কোন জনগোষ্টি থেকে আগত তাদের একজন মুসলমান ভাইকে সমমর্জাদায় বুকে জড়িয়ে ধরতে দ্বিধা করে না। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পূর্ব পরিচয় যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদি কারও মনে সংশয় থাকে, তবে মিনাক্ষীপুরম গিয়ে দেখে আসতে পারেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে যারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন, আজ তাদের দেখলে, তাদের আচার প্রত্যক্ষ করলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, এ লোকগুলিই মাত্র ৫/৬ বছর আগে জীবনে অচ্ছুৎ রূপে গ্রহন হত।”
তিনি আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, “বিশ্বাস করুন, আমি দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা এবং সবকিছু দেখা-শোনার পরই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছি। কালেমা পাঠ করার পর থেকেই আমি মনে যে নতুন বল এবং উত্তাপ অনুভব করছি, সেটা প্রকাশ করাই হবে আমার প্রধান কাজ। আমি আমার মত লক্ষ লক্ষ মানসিক দ্বিধাগ্রস্থ বুদ্ধিজীবীর কাছে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরতে চাই।
বর্তমান ভারতীয় মুসলিম সমাজের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা হচ্ছে শক্তিশালী তথ্য মাধ্যমের অভাব। আমি এ ময়দানের একজন কর্মী। তাই আমার অভিজ্ঞতা আপাতত মুসলমানদের এ প্রয়োজনটুকু মিটানোর ক্ষেত্রেই নিয়োজিত করতে চাই। ইতিমধ্যেই আমার মনে এ বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের জন্য কিছু কাজ করার তওফীক আমাকে অবশ্যই দিবেন।”
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন