মুক্তিযুদ্ধের গোপন উপাখ্যান
লিখেছেন লিখেছেন বাচ্চা ছেলে ১০ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:১৮:১৫ দুপুর
মুক্তিযুদ্ধের গোপন উপাখ্যান শীর্ষক লেখায় এবার আপনাদের সামনে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। ইতিহাস জানতে যাদের আগ্রহ তারা পড়ে দেখতে পারেন -
মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ :
মুজিব বাহিনী নেতা চন্তুষ্টয়ের অন্যতম রাজ্জাকের ভাষ্য অনুযায়ী মুজিব বাহিনী তখনো যুদ্ধ শুরুই করেনি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একেবারে সামনাসামনি না পড়ে গেলে তারা যুদ্ধ করে না। এও সঠিক সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং হাসানুল হক ইনুরা তখনো যুদ্ধে নামেননি কিন্তু ‘র’ যুদ্ধে নেমে পড়ে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপের মাধ্যমে। যুদ্ধ শুরু করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। (পৃষ্ঠা-১০৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফশিলী হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান কুরিয়ানা, ডুমরিয়া, ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির যোদ্ধারাই শুধু নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত সকল বামপন্থী সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনুদের কাছে বামপন্থী এবং শত্রু চর। অতএব শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুখ্য লড়াই হয়ে দাঁড়ায় বামপন্থী নির্মূল করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয় এবং আগষ্ট মাসে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেই শুরু করে দেয় বামপন্থী নির্মূল অভিযান। সম্মুখ যুদ্ধে না নেমে তারা বেছে নেয় গুপ্তহত্যা প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও নেমে পড়ে সরাসরি লড়াইয়ে। শুধু বামপন্থী নির্মূলই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেও অস্ত্র তুলে ধরে তারা। এমন কি মুজিব বাহিনীর সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক হাসানুল হক ইনু গ্রুপের বামপন্থী চিন্তাচেতনার অনুবর্তী মহযোদ্ধাদেরও হত্যা করে নির্দ্বিধায়। (পৃষ্ঠা-১০৫-১০৬, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
একই ভাবে গুপ্ত হত্যার শিকার হন আজকের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার সৈয়দ কামেল বখত। নেহাৎ ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান তার জ্যৈষ্ঠ সৈয়দ দীদার বখত। সৈয়দ কামেল ছিলেন কাজী জাফর মেননের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির সাতক্ষীরা এলাকার নেতা। জ্যৈষ্ঠ সৈয়দ দীদার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত একজন মুক্তিযোদ্ধা। (পৃষ্ঠা-১০৬, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
কেবল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা এবং কখনো মুক্তি বাহিনীর সদস্যরাই শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল না, নিজেদের বাহিনী তথা মুজিব বাহিনীর ভেতরকার সমাজতন্ত্রকামীরাও তাদের আক্রমণের তালিকায় এসে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন এলাকায় দু’গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। হত্যাকান্ড ঘটাতেও পেছপা হয় না শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ। এই গ্রুপের লোকজন হত্যা করে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা ১৯৭০ সালে ১২ আগষ্টে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের উত্থাপক স্বপন চৌধুরীকে। তিনি ছিলেন সিরাজুল আলম খান- আব্দুর রাজ্জাক- হাসানুল হক ইনুদের চট্টগ্রাম এলাকার মুজিব বাহিনীর নেতা। যুদ্ধের শেষভাগে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার আগে তিনি প্রতিরোধ করেন এবং আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার পচিয় পেয়ে সতর্ক হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ খবরা খবর সংগ্রহের আশায় তাকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য রাঙ্গামাটি হাসপাতালে নিয়ে রাখে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই রাঙ্গামাটি মুক্ত হয়ে যায়। স্বপন চৌধুরী ঐ তারিখে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরেও হাসপাতালে ছিলেন। কিন্তু পরদিন তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে স্বপন চৌধুরীর ধরা পড়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনু বলেন : “আমাদের বিশ্বাস শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের লোকজন তাকে পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। তাকে গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়। তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। যে নার্স তার চিকিৎসায় ছিলেন তিনিও ১৯৭২ সালেই গায়েব হয়ে যান। কেননা, স্বপন চৌধুরীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিলেন ওই নার্স।” (পৃষ্ঠা-১০৭-১০৮, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
এখানে অনিবার্য কারণে এসে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি বামপন্থী দল সংঘটিত হত্যাকান্ড বিষয়ক ঘটনাবলি। এ ঘটনার উল্লেখ এই কারণে আসে যে, তা না আনলে ওই দলটি তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের কাছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে ভুল ধারনা দেয়ার চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে এ দলটি কোন কোন পত্রিকায় ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের হত্যাকান্ডকে পাশাপাশি অনিবার্য কারণে এসে পড়ে আবদুল হক- মোহাম্মদ তোয়াহার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সংঘটিত পেড়োলী হত্যাকান্ড)। (পৃষ্ঠা-১০৮, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
এ ঘটনা উল্লিখিত হচ্ছে এই কারণে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন চলছিল, সে সময় মুজিব বাহিনী যে হত্যাকান্ড পরিচালনা করে, তার সঙ্গে আবদুল হকের ‘বিপ্লবী’ বাহিনীর হত্যাকান্ডের মূলগত কোন পার্থক্য নেই। তবে এরা হত্যা করেছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে আর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনী হত্যা করেছে ‘র’- এর প্ররোচনায় তাদের রাজনৈতক প্রতিপক্ষ স্বাধীনতা যোদ্ধাদের। কিন্তু তাদের মাধ্যমে ‘র’- এর পক্ষে পুরো পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না মুজিব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশের সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার অনুবর্তী হয়ে পড়ার কারণে- যাদের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান- আবদুর রাজ্জাক এবং হাসানুল হক ইনুরা। (পৃষ্ঠা-১১০, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অস্থিরতা ‘র’- সিআইএ মুখোমুখি :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে কোন এক সময় ‘লা মদকে দেয়া তার ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চে। তাতে শেখ মুজিব বলেন : “পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কি এটা বোঝেন না যে, আমিই হলাম একমাত্র লোক যে পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিজম থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। যদি তারা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন তবে আমি ক্ষমতাচ্যুত হবো এবং আমার নামে ‘নকশালরা’ নেমে পড়বে। যদি বেশি ছাড় দেই, আমি কর্তৃত্ব হারাব। মুশকিলে আছি আমি” (পৃষ্ঠা-১১১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
প্রশ্ন : তাজউদ্দীন আহমদ শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী হবার জন্যই এই ষড়যন্ত্রটি করেছিলেন?
আব্দুর রাজ্জাক: আমার ধারণা, তিনি মনে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর ফিরে আসবেন না। সুতরাং তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে থাকবেন। এবং এই বুদ্ধিটি অন্য জায়গা থেকে দেয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন : বুদ্ধিটা কে দিয়েছিলেন?
আব্দুর রাজ্জাক : আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের আমিরুল ইসলাম অথবা আরও কেউ এর পেছনে ছিলেন।
প্রশ্ন: সেটা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন?
আব্দুর রাজ্জাক: পরবর্তীকালে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে তারা আমেরিকান লবির লোক। আর এই আমেরিকান লবি কিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধকে দেখেছে, সে তো বুঝতেই পারেন। এবং আজ আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, তারা প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টির মত পার্থক্যটা প্রথমে ওখান থেকেই শুরু হয়।
প্রশ্ন: এখানে প্রচার আছে যে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমেরিকার কোন সম্পর্ক ছিল না। এটা কিভাবে সম্ভব?
আবদুর রাজ্জাক: এখানেই কথা। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তখন আমেরিকার কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এই ব্যক্তিকে- এই আমিরুল ইসলামকে তিনি চিনতে ভুল করেছিলেন। তারপরেই এখান থেকে তার সঙ্গে (তাজ উদ্দীন আহমদ) আমাদের চরম সতানৈক্য শুরু হয়ে যায়।
প্রশ্ন: মঈদুল হাসান তার মূলধারা ‘৭১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আপনারা অর্থাৎ মুজিব বাহিনী নেতারা নাকি এই রকম প্রচারণা চালিয়েছেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকলে দেশ স্বাধীন হবে না। তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবের গ্রেফতার হবার কারণ-
আব্দুর রাজ্জাক: তিনি একজন বিভ্রান্ত মার্কসবাদী এটা প্রমাণিত এবং আজকেও হচ্ছে। এক সময় মার্কসবাদী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীকালে যা দেখা যাচ্ছে তাতে তো তিনি বিভ্রান্তই বটে। তাজউদ্দীন আহমদের ওপর ভর করেছিলেন। তাকে দক্ষিণ দিকে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মতই তিনি একজন মঈদুল হাসানের পরিচয় তো এখন পরিষ্কার আমাদের কাছে যে তিনি আমেরিকান লবির লোক। দক্ষিণপন্থী লবির লোক। যদিও ভাব-ভঙ্গিটা প্রগতিশীল। এ রকম অনেকেই কিন্তু ধরা পড়েননি। যেমন এনায়েতুল্লাহ খান বহুদিন ধরা পড়েননি। এখন তো পরিষ্কার এ ধরনের মার্কিনপন্থী কমিউনিস্ট বাংলাদেশ অনেকেই আছেন। তার মধ্যে মঈদুল হাসানও একজন। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের ওপর ভর করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টিকারীদের মধ্যে তিনিও একজন। মঈদুল হাসান ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এরাই মূল ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রশ্ন: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনী সদস্যরা আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং কমিউনিস্টদের হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আপনি কি বলেন?
আব্দুর রাজ্জাক: এ অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা কমিউনিস্টদের হত্যা করার নির্দেশ দেইনি। আমাদের চারজনের বৈঠকে এ ধরনের কোন প্রশ্ন ওঠেনি। কোন সিদ্ধান্ত নেবার প্রশ্ন আসলে আমাদের চারজনের বৈঠক হতো। হ্যাঁ, আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যদি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করে তাহলে প্রথমে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবো। এড়াতে না পারলে প্রতিরোধ করবো। কিন্তু কমিউনিস্ট বাহিনীর সঙ্গে কোন সংঘর্ষ হয়নি। আর কমিউনিস্ট বাহিনী তো ভেতরে ঢুকতেই পারেনি। আমাদের বাহিনী ট্রেনিং নিয়ে নিচ্ছে। কমিউনিস্ট বাহিনী আসলে যুদ্ধে যেতেই পারেনি। আমাদের বাহিনী ট্রেনিং নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। কাজ কেবল শুরু করেছি। আমরা তা সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে পারিনি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল- মুজিব বাহিনী প্রথমে ভেতরে ঢুকবে। তারপর অন্ত্রশালা তৈরী করবে। এরপর আশ্রয় গড়ে তুলবে। তারপর সংগঠন গড়ে তুলবে,- মুজিব বাহিনীর সংগঠন। এরপর থানা কমান্ডার করবে। থানা কমান্ড করার পার প্রথম কার্যক্রমটা হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী অর্থাৎ রাজাকারদের ওপর হামলা চালাবে, তাদের সরবরাহ লাইনের ওপর হামলা চালাবে। গেরিলা কৌশল ওদের দূর্বল করে দেবে। সর্বশেষ হলো, ওরা যখন দূর্বল হয়ে পড়বে, তখন পাকবাহিনীর ওপর আঘাত হানো। আমরা তখন এ কাজই করছি। প্রাথমিক কাজ আমাদের মোটামুটি হয়ে গিয়েছিল। সংগঠন আমাদের গড়ে ওঠেছিল। আমাদের রিক্রুমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা যেখানে যেতে পেরেছে, সেখানেই থানা কমান্ড হয়ে গেছে। আমরা জনগণের সাথে মিলে যুদ্ধ করছি। কিছু কিছু রাজাকারও খতম হচ্ছে। কিন্তু মুল জায়গাটা মানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে না পড়লে, যুদ্ধ করিনি। দু’চার জায়গায় সামনে পড়েগেছি, লড়াই হয়েছে। আমরা তো যুদ্ধ শুরুই করিনি। আমাদের তো পাঁচ বছরের পরিকল্পনা। প্রথম বছরে কি করব, তৃতীয় এবং চতুর্থ বছরে কি করবো। তারপর সরকার গঠন করবো। এই ছিল আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা। আমরা যদি সফল হতাম তাহলে কোন ঘাস থাকতো না, আগাছা ধাকতো না। সমাজদেহ থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতাম। প্রতিবিপ্লবীর থাকতে হতো না। মটিভেট হয়ে এদিকে আসতে হতো।, নচেৎ নিশ্চিহ্ন হতে হতো।
প্রশ্ন: তার উদ্দেশ্যটা কি ছিল বলে মনে করেন?
আবদুর রাজ্জাক: ইতোমধ্যে আমি খবর পেয়ে গেছি যে তিনি ট্রটস্কি লাইন অনুসরণ করছেন এবং ভারতে যতদিন ছিলেন, যুদ্ধে তিনি যাননি। কলকাতাতেই অধিকাংশ সময় ছিলেন। ওখানে তার যে ক্যাম্প ছিল- শিলিগুড়ির পাংগা ক্যাম্প, সে ক্যাম্পেই ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মণি আর মান্নানকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি এসে কলকাতাতেই থাকতেন। কলকাতায় কোথায় কি করতেন, কাউকে জানতে দিনে না। পরবর্তীকালে খবর পাওয়া গেল তিনি নকশালদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এসইউসি’র (সোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার) সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জয়প্রকাশ নারাণয়, (সোসালিস্ট নেতা) যিনি মুখে বলতেন সমাজতন্ত্রের কথা, আসলে দক্ষিণপন্থী লোক ; তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এসব খবর পরবর্তীকালে পেয়েছি।
অথচ এই সিরাজুল খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “অস্ত্র জমা দিও না সব। যেগুলোর রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতিবিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে। সমাজতন্ত্রের দিকে যেতে হবে।” এটা আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। (১৯৮৯ সালের ২ জুন প্রদত্ত আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা-৮৯, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের’ এবং সিআইএ, মাসুদুল হক)
আমাদের বিরুদ্ধে তো অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন। যেমন অধ্যাপক আবু সাঈদ লিখেছেন, ‘ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস’- নামে একটি বই। আমাদের বিরুদ্ধে যিনি যেখানে যা বলেছেন, সেটাই তার ‘ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস’- এ স্থান পেয়েছে ; বইটা তার নিজস্ব মতামত নয় এবং তা সত্য কি মিথ্যা সেটা যাচাই করেননি। কেউ যাচাই করছেনও না। যেমন ধরুন, আমি একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের যারা, আমাদের রাজনীতি তাদের অপছন্দ। তাদের একজন আমাদের সম্পর্কে কিছু লিখলেন এবং সেটাই ফ্যাক্ট হয়ে গেল, এটা তো ঠিক নয়। যেমন আপনি আজকে আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছেন যাচাই করার জন্য, এই যাচাই তো কেউ করেন না। আমাদের দুর্ভোগ্য, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লেখালেখি হচ্ছে এটা কি ঠিক? আজকে যাদের বয়স উনিশ, তারা তো বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস জানলো না। কারণ, যে যা লেখেন সেখানে নিজেকে মুখ্য করেই লেখেন। এতে সত্যিকারের ইতিহাস হারিয়ে যায়। (চলমান)
পর্ব- ১
পর্ব-২
বিষয়: বিবিধ
২০৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন