ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-(শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৮ মার্চ, ২০১৩, ১১:৫৫:৫০ সকাল
নিউজ পেপার নিয়ে বসলেও রিসাবের চোখ রিনিলার দিকে। একমনে বাচ্চাদের ড্রেসের ডিজাইন করছে। এতদিন শুধু শুনেছে যে মাতৃত্বের অনুভূতি একটি মেয়েকে আমূল বদলে দেয়। সেই বদলের মাত্রা যে কতখানিক সেটা রিনিলাকে দেখে বুঝতে পারছে। যেদিন ডাক্তার রিপোর্ট পজেটিভ জানালেন সেদিন সেই মুহুর্তেই যেন নতুন এক রিনিলার জন্ম হয়েছে। যার জীবনের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসা-পরিকল্পনা সবকিছুই এখন অনাগত সন্তানকে ঘিরে ঘুরছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজে ডিজাইন করে নিজ হাতে বানাবে বাচ্চার জন্য ড্রেস। গত কয়েকদিন ধরে সব ভুলে সেই কাজেই ব্যস্ত রিনিলা। নিউজ পেপার রেখে রিসাব বলল-
-ইনশাআল্লাহ! তোমার বাবু খুব সৌভাগ্যবান হবে।
-(অবাক কণ্ঠে)একথা বলছো কেন?
-(হেসে) কারণ সে দুনিয়াতে আসার আগেই তার মা তার জন্য ছোট্ট এক ভুবন সাজিয়ে ফেলছে। আর ডেকোরেশনের কাজে ব্যবহার করছে মায়ের মনের সমস্ত স্নেহ-মমতা-স্বপ্ন-ভালোবাসা।
-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! চেষ্টা করছি জানি না কতটুকু পারছি বা পারবো। তবে আমাদের বাবুকে স্বাগতম জানানোর জন্য অনেক পরিকল্পনা আছে আমার। আমি জেনেছি যে মায়ের কাছ থেকে সমস্ত তথ্য বাচ্চার ডিএনএ লেভেলে চলে যায়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি লাখ লাখ তথ্য ভরে দেবো আমার বাবুর ডিএনএতে ইনশাআল্লাহ। কুরআন-হাদীস-তাফসীর-ইসলামের ইতিহাস-সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অবাধ বিচরণ করবো আমার ছোট্ট বাবুকে সাথে নিয়ে। আইডিয়াটা কেমন বলো তো?
-(হেসে) তুমি সত্যিই পাগলী বুঝলে।
-মোটেই তা নই আমি। শোন আমি বাচ্চাদের উপর লেখা বিখ্যাত বইগুলো পড়তে শুরু করে দিয়েছি ইতিমধ্যেই। জানো সহজাতভাবেই বাচ্চাদের উপর মায়ের প্রভাব বেশি। তাই মাই পারে সন্তানদের অনন্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। প্রেগনেন্সির সময় উৎফুল্ল থাকতে হয়, সৎ চিন্তা করতে হয়। আমি যাতে সারাক্ষণ উৎফুল্ল থাকতে পারি এবং ভালো ভালো চিন্তা করতে পারি তার রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।
-(হেসে) ইনশাআল্লাহ! আমি চেষ্টা করবো যথাযথ দায়িত্ব পালনের। অনেক সুন্দর হয়েছে বাবুর ড্রেসগুলো। অবশ্য মায়ের মমতার রং আর ভালোবাসার তুলির ছোঁয়ায় আঁকা হয়েছে সুন্দর না হয়ে তো পারেই না।
-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! একটা বাণীতে পড়েছিলাম যে, কারো মনে যদি পাপ না থাকে তাহলে বাইরের পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমি দুনিয়াকে থেকে তো পাপকে দূর করতে পারবো না কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করতে চাই আমার সন্তানের মনকে পাপ শূন্য করে গড়ে তুলতে। আর তার বীজ এখনই বপন করতে হবে আমাদেরকে। কারণ চুপটি করে বসে আড়ি পেতে আমাদের সব কথাই শুনছে দুষ্টু বাবুটা।
-(হেসে) আমি তো ভয় পাচ্ছি বাবুকে পেয়ে না তুমি আবার আমাকে ভুলে যাও। লক্ষণ দেখে তো তাই মনেহচ্ছে।
-(হেসে) তাহলে বলতে হবে তুমি দৃষ্টিবিভ্রাটে আক্রান্ত হয়েছো। স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত রূপ হয়ে একটি শিশু পৃথিবীতে আসে। এতে তো ভালোবাসা-আকর্ষন কমার কথা নয় বরং বাড়ার কথা। একটা ম্যাজিকাল ব্যাপার কি জানো? আমরা দুজন কাছে থাকি বা দূরে, কিন্তু আমাদের সন্তানের মধ্যে আমরা সবসময় একাকার হয়ে মিশে থাকবো। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদেরকে আর আলাদা করতে পারবে না।
-(হেসে) এসব ভাবনা তোমার মাথায় আসে কোত্থেকে বলো তো! তোমার বাবু তো তোমার ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলছে দিন দিন।
-আলহামদুলিল্লাহ! বাবুকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল রিসাব। কিন্তু কয়েকদিন আগে নসীম হিজাজীর মরণজয়ী বইটা পড়ার পর থেকে আমার স্বপ্নে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সব স্বপ্নকে ছাপিয়ে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে এক বীর মুজাহিদের মা হবার স্বপ্ন। তুমি কি অবাক হচ্ছো আমার কথা শুনে?
-না। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোমার স্বপ্নটা।
-আমিও এখন সাবেরার মতো স্বপ্ন দেখি আমার প্রিয় পুত্র দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে বীর পদভারে। দুশমনের ঘোড়া আর হাতী তার নির্ভীক হামলার সামনে দাঁড়াতে না পেরে আগে আগে সরে যাচ্ছে। আমার নওজোয়ান ছেলে তাদের অনুসরণ করে ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গর্জন মুখর দরিয়ার বুকে। বারবার সে এসে যাচ্ছে দুশমনদের নাগালের ভেতরে। তারপর শেষ পর্যন্ত আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত হয়ে কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। তারপর জান্নাতের হুরদল শারাবন তহুরার জাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের প্রতীক্ষায়।
থমকে গেলো রিসাব কিছুক্ষণের জন্য। এমন কিছু শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। অপলক নির্বাক তাকিয়ে রইলো রিনিলার দিকে। মনেহচ্ছে মুখ না রিনিলার অন্তর কথা বলছে আজ। চোখের অশ্রুই জানান দিচ্ছে এতক্ষণ যা বলেছে সত্যিই সে এমন স্বপ্ন দেখছে তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে। রিনিলাকে কাছে টেনে নিয়ে রিসাব বলল, আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমার স্বপ্ন পূরণের পথকে সুগম করে দেন।
-( চোখ মুছে হেসে) আমিন। আমিও এখন আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি যে, “ওগো যমিন-আসমানের মালিক! মুজাহিদের মায়েরা যখন হাজির হবেন তোমার দরবারে, তখন আমি যেন কারো পেছনে না থাকি। এই বাচ্চাকে তুমি এমন যোগ্যতা দান করো, যেন সে পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ঐতিহ্য কায়েম রাখতে পারে।
-তুমি আজ আমাকে আবারো মুগ্ধ করলে রিনিলা। এখনকার যুগের বেশির ভাগ মায়েদের সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন মানেই হচ্ছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়তো বিজ্ঞানী। বীর মুজাহিদ সন্তানের আশা কেউ করে না।
-নসীম হিজাজী একটা জায়গায় লিখেছিলেন-“ আপন বাচ্চাকে বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায় যে মায়েরা, সিংহের মোকাবিলা করবার স্বপ্ন তারা কি করে দেখবে? নীড়ের আশেপাশে উড়ে বেড়ায় যেসব পাখী, কি করে পরিচিত হবে তারা আকাশচারী ঈগলের উড়ে বেড়ানোর সাথে!” সত্যিই তো তাই কি করে দেখবে এমন সপ্ন? কি করে পরিচিত হবে মুক্ত আকাশের সাথে?
-ঠিক বলেছ। ইনশাআল্লাহ! আমরা আমাদের সন্তানকে বিড়ালের ভয় দেখাবো না। নীড়ের পাখী হয়ে না বরং আমরা ওকে বিশাল বিস্তিত আকাশে মুক্ত ডানা মেলে যাতে উড়ে বেড়াতে পারে সেই শিক্ষা দেবো। শিশুদের আচার আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে পারিপ্বার্শিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাব অত্যন্ত বেশি। তাই আমরা যদি বীর মুজাহিদের পিতা-মাতা হতে চাই তাহলে সেই পরিবেশ আগে তৈরি করতে হবে ওর জন্য।
-হ্যা পরিবেশ থেকে যদি শিশুরা অন্যের প্রতি দয়া, সুবিবেচনা, শ্রদ্ধা-সম্মান ইত্যাদির বদলে ক্রোধ, অন্যের কথা না মানা, সহিংস আচরণ দেখে, তাহলে তারাও ধীরে ধীরে এসবই রপ্ত করে। তাদের মানসিকতা নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এমন যাতে নাহয় সেজন্য আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
-আমাদের সন্তান আমাদের জান্নাত হবে না জাহান্নাম তা আমরা জানি না কিন্তু আমাদের মৃত্যুর পর যাতে সাদাকায়ে জারিয়া হতে পারে সেই আলোকে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা আমাদেরকে করতে হবে।
-ইনশাআল্লাহ! আমরা সেই চেষ্টা করবো। আজ থেকে আমাদের জীবনের নতুন মিশন হলো এই জান্নাতি পাখীটা যাতে আবারো জান্নাতে ফিরে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করা।
-চলো আমরা একসাথে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি।
সালাত শেষে রিসাব আর রিনিলা একসাথে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলো-"হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের জন্য চক্ষু শীতল কারী । এবং আমাদের করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণ যোগ্য।"
আজ আমি এই সিরিজটির সমাপ্তি করছি। যদিও সমাপ্তি বলে আসলে কিছু নেই। সমাপ্তি হচ্ছে নতুন শুরুর নামান্তর মাত্র.................
বিষয়: বিবিধ
২৮২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন