ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৯
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৫ মার্চ, ২০১৩, ১২:১২:১২ দুপুর
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেলো রিসাবের। অফিসে এসে রিনিলার আবদার মাখা চিরকুট পেয়েছে সে। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতের কাজ সেরে বেড়োতে যাবে এমন সময় ছোটবেলার বন্ধু এবং বর্তমান কলিগ নাবিলের ফোন এলো যে জরুরী কিছু কথা বলতে চায় রিসাবকে। আধঘণ্টা পর বের হলেও রিনিলার হাতুড়ির বারি খাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে তাই আসতে বললো নাবিলকে কথা বলার জন্য। পাশাপাশি রুম অথচ দশ মিনিট পেড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু নাবিলের কোন খবর নেই। ছয় মাস হলো বিয়ে করেছে নাবিল নিশ্চয়ই সেই ব্যাপারেই কিছু বলবে ভাবছিল রিসাব। নাবিল আসার পর সালাম ও কুশলাদী বিনিময় শেষে রিসাব বলল, আমাকে আসলে এখনি বেড়োতে হবে, তাই চলো কথা শুরু করি আমরা। নাবিল বলল,
-বউকে নিয়ে খুব বিপদে আছি আমি। ছয়মাস যেতে না যেতেই ওর অবজেকশন শুরু হয়ে গিয়েছে। পান থেকে চুন খসতেই রাগ-অভিমান তারপর শুরু করে কান্নাকাটি। কি করি বলো তো এখন?
-(হেসে) অকারণে নিশ্চয়ই এসব করছে না তোমার বউ? আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে বউ অবজেকশন করতে পারে এমন কি কি কাজ করছো?
-একদম সময় দেই না ওকে এটাই হচ্ছে সব অবজেকশনের মূল কারণ। চাকরীর পাশাপাশি ব্যবসায়ী আমি তাই নানারকমের ব্যস্ততা তো থাকবেই। না বুঝে যদি এটাকে ইস্যু করে সংসারে অশান্তি তৈরি করে তাহলে আমার কি করণীয় বলো?
-(হেসে) সমাধান করতে এসে তুমিও তো দেখছি অবজেকশন শুরু করলে। আসল ব্যাপার কি জানো মানুষের ভেতর বাস করে জটিল জটিল সব আবেগ। এ কারণে নারী-পুরুষ চিরকাল ধরে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একজন পুরুষের জীবনে আবেগ সরাসরি কাজ করে না আর নারীদের মাঝে আগাগোড়াই আবেগ কাজ করে। আর অসম্ভব আবেগপ্রবণ বলেই নারীরা একটুতেই রাগ-অভিমান বা কান্না করে। তোমার স্ত্রী যা করছে সেটা তাই খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
-আগের মতো ভালোবাসি না, ওকে কোন গুরুত্ব দেই না এইসব কথা স্বাভাবিক?
-(হাসতে হাসতে) তুমি এখন আর আমার কথা শোন না, তুমি অনেক বদলে গিয়েছো, তুমি কখনো আমাকে সময় দাও না। এগুলো তো মেয়েদের সবচেয়ে প্রিয় আর কমন ডায়লগ। এসব কথাকে তো সিরিয়াসলি নেবার কিছু নেই।
-কিন্তু আমার বউ তো সিরিয়াসলিই এসব বলে।
-দেখো স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ঔদার্য, সহনশীলতা, ধৈর্য্য ও ছাড় দেবার প্রবণতা ছাড়া একটি সুশৃঙ্খল পরিবার গঠন কখনোই সম্ভব নয়। আর যে কোন সমস্যাতে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে দুরিদর্শিতার পরিচায়ক। দাম্পত্য জীবনে তাৎক্ষনিকতার আশ্রয় নিয়ে বোকামি করা মোটেই ঠিক নয়।
-তাহলে আমাকে এখন কি করতে হবে সেটা বলে দাও।
-সবার আগে বউকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। একথা তো আমরা সবাই জানি যে ফুলের বুকে যদি মৌমাছি বসে, তাহলে সেই ফুল হয়ে ওঠে মধুময়। একই ফুলে যদি ভোমরা বা বোলতা বসে তাহলে কি ফুল বিষময় হয়ে উঠবে? না বরং ফুল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অটুট থাকবে। পার্থক্য শুধু যে যার কাঙ্ক্ষিত জিনিস চেছে নেয়। অর্থাৎ, ফুলে কোন দোষ নেই, দোষ হলো গ্রহীতার। এই কথা তোমাকে এরজন্য বললাম কারণ যে কোন পরিবেশেই আপন প্রত্যাশার বাস্তবায়ন সম্ভব।
-তুমি বলতে চাইছো সংসার হচ্ছে সেই ফুল এটাই তো? কিন্তু এটা ওকেও বুঝতে হবে তাই না?
-সবসময় সবকিছু যে দুজন একসাথেই বুঝে বা মেনে চলতে হবে এমন আইন জারি করা কিন্তু আবার ঠিক নয়।
-আমি ঠিক বুঝিনি তোমার কথাটা।
-(হেসে) আচ্ছা চলো তোমাকে একটা গল্প বলি আগে। একজন শিক্ষক পাখী শিকারের শিক্ষা দিচ্ছিলেন ছাত্রদের। তিনি ছাত্রদের বললেন, আমি যতক্ষণ না বলবো তোমরা তীর-ধনুক পাখীটির দিকে তাক করে থাকবে কিন্তু তীর ছুঁড়বে না। তারপর শিক্ষক ছাত্রদের একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন। প্রথম ছাত্রকে বললেন, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো? সে উত্তর দিলো আমি বন, গাছ ও পাখীটি দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয়জনকে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর দিলো আমি গাছ ও গাছের ডালপালা এবং পাখীটি দেখতে পাচ্ছি। তৃতীয়জন উত্তর দিলো আমি গাছের ডালপালা, পাখীটি এবং পাখীটির চোখ দেখতে পাচ্ছি। চতুর্থজন উত্তর দিলো আমি শুধু পাখীটির চোখ দেখতে পাচ্ছি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কি বুঝলে?
-কিছুই বুঝলাম না।
-(হেসে) এই গল্পটা আমাকে রিনিলা বলেছিল সংসারের সুখকে কেন্দ্র করে। পাখীর চোখটি হচ্ছে সংসারের সুখ আর বন, গাছ এবং গাছের ডালপালা এসব হচ্ছে অন্যান্য আবেগ। স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টি যদি শুধু সুখের দিকে থাকে তাহলে বাকি সব আবেগকে খুব সহজেই সামলে উঠা যায়।
-কিন্তু যে কোন একজনের দৃষ্টি থাকলে তো সুখ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
-সবক্ষেত্রে একই সাথে দুজনের দৃষ্টি একই দিকে থাকাও কিন্তু সম্ভব না। কেন্দ্রবিন্দুতে দৃষ্টি দুজনেরই থাকতে হবে কিন্তু যখন যার পক্ষে লক্ষ্যে তীর ছোড়া সহজ হবে তখন সে ছুঁড়বে। দেখো পরিবার-আপনজন, নিজের পরিচিত গণ্ডি পেড়িয়ে একটা মেয়ে স্বামীর ঘরে আসে। যৌথ পরিবার হলে তো বিভিন্ন রকম মানুষের বিভিন্ন প্রকার মেজাজ মরজির সম্মুখীন হতে হয়। এটা যে কত বড় একটা ত্যাগ তা কিন্তু কোন ছেলের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। নাই বা পারলাম বুঝতে কিন্তু সাপোর্ট অন্তত দিতে পারি তাই না?
-হ্যা আমি বুঝতে পারছি এখন।
-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! আর সময় দেবার ব্যাপারে বলবো দুজন মানুষের জীবন যখন একে অপরের সাথে জুড়ে যায় তখন অজান্তেই দুজনের মধ্যে তৈরি হয় প্রত্যাশা। একে অপরের থেকে বিশেষ কিছু মুহুর্তের চাহিদা জায়গা করে নেয় মনে। এরজন্য নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহুর্তগুলো আকর্ষনীয় করে তোলার চিন্তাটা মাথায় রাখা উচিত।
-ঠিক কিভাবে বলবে কি?
-ব্যস্ততা বা ক্লান্তির কারণে একে অপরের প্রতি নিরাসক্ত না থেকে যদি কাছাকাছি এসে একে অন্যের আলিঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া যায় কিছুক্ষণের জন্য। অর্থাৎ, লং এন্ড রিলাক্সিং হাগ এক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। যা ক্লান্তি বা বিরক্তি ম্যাজিকের মতো কাটিয়ে দেয়। তারসঙ্গে সম্পর্কে যোগ হয় অনন্য সমীকরণ। আশা করি তোমাকে বোঝাতে পেরেছি।
-আলহামদুলিল্লাহ! আমি বুঝতে পেরেছি আমার করণীয়।
-(হেসে) একজন যখন করণীয় বুঝে যথাযথ পালনের চেষ্টা করে, অপরজন কিন্তু তখন চুপ করে বসে থাকতে পারে না। এখন যেমন আমার করণীয় হচ্ছে যতদ্রুত সম্ভব বউয়ের আদেশ মতো তার কাছে পৌঁছানো। সময় এবং সুযোগ থাকার পরও নিজের ঢিলেমির কারণে আমি আমার বউকে অপেক্ষা করাতে চাই না।
-(হেসে) ইনশাআল্লাহ! এখন থেকে আমিও এভাবেই চিন্তা করবো।
চলবে.............(ইনশাআল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
২০১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন