ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৮
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২১ মার্চ, ২০১৩, ০২:০৫:২১ দুপুর
চা-নাস্তা নিয়ে বারান্দায় এসে ননদ তিয়ান্নাকে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু মন খারাপ হয়ে গেলো রিনিলার। তিন মাস হয়েছে বিয়ের অথচ এখনো ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি তিয়ান্না স্বামীর সাথে। আসার পর থেকেই মুখ ভার করে রেখেছে। তিয়ান্নাকে আজ কিছু কথা বলতে হবে মনেমনে ঠিক করে রেখেছে রিনিলা। পাশে বসে হেসে বলল, এই নাও তোমার গরম গরম পাকোড়া আর জিনজার টি। তোমাদের সব ভাই-বোনদের পছন্দ কি একই রকম নাকি? তোমার ভাইয়াও বিকেলের নাস্তায় এসবই পছন্দ করে। তিয়ান্না হেসে বলল-
-কারণ তোমার হাতের পাকোড়া আর জিনজার টি একবার যে খাবে, সে অন্য কোন নাস্তা আর গলধঃকরন করতে পারবে না।
-(হেসে)আলহামদুলিল্লাহ! জেনে খুশি হলাম। এক কাজ করো আজ রাতে থেকে যাও। ফোন করে তোমার হাসবেন্ডকেও অফিস শেষে এখানে চলে আসতে বলো। তোমাদের পছন্দের সব খাবার রান্না করবো আজকে। তোমাদের উসিলায় আমারো একটু রিচফুড খাওয়া হয়ে যাবে। তোমার ভাইয়ার সাথে রোজ রোজ ঘাস-লতা-পাতা খেতে খেতে মুখ পচে গিয়েছে।
-আমি তো কয়েকদিন থাকতেই এসেছি ভাবী। কিন্তু ওকে আসতে বলতে পারবো না।
-তিয়ান্না তুমি তো জানো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলার স্বভাব আমার নেই। তাই সরাসরিই জানতে চাইছি যে, আসলে তোমাদের সমস্যাটা কোথায় বলো তো? আমি তো বিয়ের দেড় বছর হয়ে গিয়েছে তারপরও তোমার ভাইয়াকে ছাড়া কোথাও একা থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। অথচ তুমি প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও একা বেড়াতে চলে যাও।
-আমার ওই বাসার সবকিছু অসহ্য লাগে ভাবী। ওকেও......!
-(হেসে) আরিফী ভাইয়া ধীর-শান্ত-পড়ুয়া স্বভাবের ছেলে আর তুমি হচ্ছো দুষ্টু-চঞ্চল-আমুদে স্বভাবের মেয়ে। এককথায় তোমরা হচ্ছো তেল আর জল। বিয়ে নামক ঝাঁকুনি যন্ত্রে পড়ে তেলজল অবশ্য মিক্সাপ হয়ে যায়। কিন্তু সেজন্য সার্বক্ষনিক একটি ঝাঁকুনির প্রয়োজন হয়। আর এই ঝাঁকুনির নাম হলো বোঝাপড়া, ত্যাগ আর ভালোবাসা।
-(হেসে) তুমি অদ্ভুত সব কথা বলো ভাবী।
-তিয়ান্না আরিফী ভাইয়া হয়তো তেমন ছেলে নয়, যেমন কাউকে তুমি তোমার জীবনসাথী হিসেবে চেয়েছো। কিন্তু উনি অবশ্যই এমন একজন পুরুষ যার হাতে নিশ্চিন্তে নিজেকে তুলে দেয়া যায়। আরিফী ভাইয়া হয়তো তোমাকে খুব আনন্দ দিতে পারবেন না, ঠিক তেমনি উনি তোমাকে কখনোই দুঃখী হতে বা কষ্ট পেতে দেবেন না। তাই কি চেয়েছ আর কি পেয়েছ সেই হিসেবে না গিয়ে, যা পেয়েছ তাই নিয়ে সুখী হতে চেষ্টা করো।
-মেয়ে হয়েছি বলে কি চাওয়া-পাওয়ার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে কিনা সে বিবাচনাও করতে পারবো না ভাবী?
-আমি ছেলে-মেয়ে তর্কে যেতে চাই না। আমি শুধু বলবো তত্ত্বকথা, ফিলোসফি এসব দিয়ে জীবন চলে না। জীবনে কম্প্রোমাইজ করতে হয়, সেক্রিফাইস করতে হয়, এডজাস্ট করতে হয়। মানুষ যদি পণ্য দ্রব্য হতো তাহলে নাহয় ইনগ্রিডিয়েন্ট পড়ে গুনাগুণ যাচাই বাছাই করে নেয়া যেত। সেই সিস্টেম যেহেতু নেই সেহেতু জীবনের পথে একসাথে চলতে চলতে একে অন্যকে জেনে বুঝে নিতে হবে।
-আমি চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না ভাবী।
-কারণ তুমি সবকিছুকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছো। সংসার জীবনটা আসলে জটিল কিছু না। আমরাই অকারণ, অনর্থক কন্ডিশন দিয়ে সবকিছু জটিল করে তুলি। আর এমন করে আমরা নিজেরাই নিজের কষ্টের কারণ হই। তোমার কষ্ট তো এটাই যে আরিফী ভাইয়া তোমার মনের মতো না তাই না? ইস্যু না করে এটাকে মেনে নাও তাহলেই দেখবে জটিলতা অনেক কমে গিয়েছে। কারণ নিজের কষ্টটাকে বুঝে সেটাকে মেনে নিতে পারলে সেটা আর কষ্ট দিতে পারে না।
-(হেসে) তোমার কথা শুনলে মন সত্যি ভালো হয়ে যায় ভাবী।
-আলহামদুলিল্লাহ! সেদিন চানক্যের একটা শ্লোক পড়েছিলাম-“ আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুনানি সমানি চৈতাদি নৃনাং পশুনাম, জ্ঞানী নরানামধিকো বিশেষ্য।” অর্থাৎ, আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন পশু এবং মানুষের মধ্যে সমভাবেই বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ জ্ঞানী আর এখানেই তার বিশিষ্টতা। জীবনের প্রতি পদে পদে আবেগ এসে আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে। এর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে।
-আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি ভাবী। এখন কি করবো আমি বলে দাও।
-(হেসে) ভুল বুঝতে পারার পরের ধাপ হচ্ছে ভুলকে শুধরানো। সুতরাং সেটাই করতে হবে এখন তোমাকে।
-(হেসে) ইনশাআল্লাহ! আমি তাই করবো ভাবী।
-জানো কখনো কখনো জীবনের ডিসিশন নেয়াটা অনেক জটিল হয়ে যায় আমাদের জন্য। জটিল তার অর্থ এই নয় যে বুদ্ধি দিয়ে জীবনের ডিসিশন নিতে হবে। বুদ্ধির প্রয়োগ করতে হবে জীবনকে উন্নত করার জন্য। কিন্তু জীবনকে সাজানোর জন্য করতে হবে আবেগের সঠিক প্রয়োগ। কঠোরতা নয় কোমলতা দিয়ে সংসারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইগো দিয়ে নয় মায়া দিয়ে সাথীকে বিবেচনা করতে হবে।
-(হেসে)তুমি আর ভাইয়া সবসময় এক সুরে বাজো। সেদিন ভাইয়াও আমাকে বলেছিলো যে, বুদ্ধি দিয়ে সঙ্গীকে বোঝার চেষ্টা করা ঠিক নয়, সঙ্গীকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে চেতনা দিয়ে। আমি আসলেই বোকা ভাবী নয়তো কেন ভুলে গেলাম যে, সংসার তখনই সুখের হয় যখন নিজে কিছু পাওয়ার মধ্যে নয় বরং কিছু দেবার মধ্যে মনের আনন্দ নিহিত থাকে।
-সত্যিই তাই। নিজে আনন্দ পাওয়ায় চেয়ে অন্যকে আনন্দ দিতে পারাটা হচ্ছে প্রকৃত আনন্দময়তার লক্ষণ। এখন যখন তুমি বুঝেই গেছো তখন এই নাও মোবাইল ফোন করে জামাইকে আসতে বলো। আমিও তোমার ভাইয়াকে ফোন করে বলে দেখি আগে আসতে পারবেন কিনা।
-(হেসে) যদি ভাইয়া না বলে তোমার মন খারাপ হবে না? সত্যি করে বলবে।
-(হেসে) আমি হয় সত্যি বলি নয়তো এড়িয়ে যাই কিন্তু মিথ্যা কখনোই বলি না। হ্যা মন খারাপ হবে কিন্তু আমি জানি যে ব্যস্ততা না থাকলে কখনোই তোমার ভাইয়া আমাকে কোন ব্যাপারে না করে না। তাছাড়া পরিবারের সবার সাথে সময় কাটাতে উনারও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কিন্তু ব্যস্ততার কারণে নিজেকে বঞ্চিত করতে হয় এই আনন্দ থেকে। স্বামীর অপরাগতা যদি স্ত্রী না বোঝে তাহলে কে বুঝবে বলো?
-হ্যা তাই তো! আমি আসলে এভাবে ভেবে দেখিনি কখনো। আমি তো অনেক ভুল আচরণ করেছি আরিফীর সাথে। খুব লজ্জা লাগছে সেসব ভেবে। ভুল সংশোধনের জন্য কি করতে হবে আমাকে ভাবী?
- (হেসে) আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি অন্যায় বা ভুল করেও যখন কেউ নিজের সাপোর্টে যুক্তি পেশ করে। কিন্তু তুমি এই কাজটি করোনি তাই অনেক ভালো লাগছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি শুধু নিজের ভুলটা মেনে নেবার মতো উদারতা থাকে তাহলে দাম্পত্য মনোমালিন্য সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। আমি যেমন অনেক সুখী হতে চাই। খুব সুন্দর একটা জীবন যাপন করতে চাই। তাই নিজের ভুলকে মেনে নিয়ে আমি সেই পথকেই সুগম রাখতে চেষ্টা করি। আর আমি মনেকরি ভুল সংশোধনের জন্য এই গুণটিই যথেষ্ট। আসলে ভুল করতে করতেই তো মানুষ সতর্ক হয় তাই না?
- আমি বুঝতে পেরেছি ভাবী।
- ঠিকআছে তোমরা কথা বলো আমি রান্নার আয়োজনে যাই।
ননদকে হাসিমুখে মোবাইল হাতে নিতে দেখে মনেমনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে রান্নার আয়োজনে ছুটল রিনিলা।
চলবে............(ইনশাআল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
২৭৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন