ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৭

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৩ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৩৩:৩৭ রাত



বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে রিনিলা। বৃষ্টি তার ভীষণ পছন্দ কিন্তু আজ বৃষ্টির ফোটা তার মনকে আনন্দিত করছেনা। কারণ তার মন জুড়ে বইছে কষ্টের ঝড়। বৃষ্টির সমান তালে তার চোখ বেয়েও ঝরছে অশ্রু। ফোনে কথা বলার সময় বোনের সাথে সামান্য মনোমালিন্য হয়েছে। পরিবারের কারো সাথে মতের অমিল খুব বেশি কষ্ট দেয় তাকে। কষ্টের খণ্ড খণ্ড মেঘেরা জমাট বাঁধা বেদনা হয়ে ভাসছে মনের আকাশ জুড়ে। পেছন থেকে কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখল রিসাব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আলতো করে রিনিলাকে কাছে টেনে নিলো রিসাব। পুরো পৃথিবীতে এরচেয়ে শান্তি আর স্বস্থির আশ্রয় আর একটিও নেই রিনিলার কাছে। এই মানুষটির মধ্যে আল্লাহ এতোখানি ক্ষমতা দিয়েছেন যে দুনিয়ার সমস্ত বেদনা থেকে মুহুর্তে তাকে টেনে বের করে নিতে আসতে পারে সে। তারপরও কেন জানি সবকথা রিসাবকে বলতে মাঝে মাঝে দ্বিধা লাগে। কি না কি ভাববে এমন চিন্তা মনে আসে। স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো সে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর রিসাব বলল, মন খারাপ? রিনিলা হাসল কিন্তু কোন জবাব দিলো না। রিসাব হেসে বলল, আমি শুনেছিলাম রোদ আর বৃষ্টির সংস্পর্শে আকাশে রংধনু ওঠে। এখন তো মনেহচ্ছে হাসি আর কান্নার সংস্পর্শে কোন কোন মানুষের চেহারাতেও রংধনু ওঠে। কিন্তু তারপরও আমি তোমার চোখে অশ্রু দেখতে চাই না। কি হয়েছে মন খারাপ?

-(হেসে) না মন ঠিক আছে।

- (হেসে) তুমি হয়তো জানো না চোখ যে মনের কথা বলে এটা তোমার জন্য পারফেক্ট লাইন। তোমার মনের কথাগুলোকে আমি তোমার চোখের দীঘিতে ভেসে বেড়াতে দেখতে পাই। আমি খেয়াল করছি তুমি তোমার পরিবারের ব্যাপারগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে চাওনা। তুমি হয়তো ভাবছো দরকার কি এসব বলে। কিন্তু বুঝতে পারছো না যে এরফলে আমাদের মাঝে আড়াল তৈরি হচ্ছে। লজ্জা, ভয়, দ্বিধা-সংকোচ কিংবা অপ্রয়োজনীও মনেকরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা গোপন করার কারণেই ধীরে ধীরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে পর্দা সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি আমাদের দুজনের মাঝে কোন পর্দার জন্ম হোক তা চাইনা। তাছাড়া বিয়ে মানে শুধু দুজন মানুষের মিলন না। বিয়ে দুটি পরিবারের মধ্যে সেতুবন্ধন। পরিবারকে দূরে রেখে আমরা কখনোই আমাদের সম্পর্ককে পুর্নতা দিতে পারবোনা। আমাদের সংসারে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে যেমন আমরা দুজন মিলে সমাধানের চেষ্টা করি, পরিবারের ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। আমি অন্তত তাই চাই। কিন্তু তোমার সাহায্য ছাড়া এমনটা কখনোই সম্ভব হবেনা।

- আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আর কখনো মনে কিছু চেপে রাখবো না আমি। সত্যিই তো এভাবেই অদৃশ্য পর্দা সৃষ্টি হয়ে যায় সম্পর্কের মাঝে। যারফলে অনেক কিছু অদেখা-অজানা থেকে যায়। যা সম্পর্কের ভীতকে দুর্বল করে দেয়।

- আলহামদুলিল্লাহ! তুমি বুঝতে পেরেছো দেখে স্বস্থিবোধ করছি।

- তুমি বিরক্ত হয়েছো খুব আমার আচরণে?

- (হেসে)না। তবে আমি চাইবো তুমি আমার কাছে কিছু গোপন করবে না। অন্তত এমন কোন কিছু তো অবশ্যই নয় যার ফলে আমাদের দাম্পত্য জীবন বা পারিবারিক জীবনের উপর কোন প্রভাব পড়তে পারে। দেখো এক একটা সম্পর্ক তার দৃষ্টিকোন থেকে মানুষকে দেখে এবং বিবেচনা করে। ব্যাপারটা অনেকটা অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো। তাই কারো একটা কথা বা আচরণ তোমার কাছে হয়তো খুব ভুল বা অন্যায় মনে হতে পারে কিন্তু আমি হয়তো অন্যভাবে দেখবো। দুজন মিলে আলোচনা করলে বিষয়টা সহজও তো হয়ে যেতে পারে তাইনা?

-(হেসে)তুমি প্রতিটা ব্যাপার এতো সুন্দর করো কি করে চিন্তা করো বুঝিনা আমি।

-আলহামদুলিল্লাহ! আমি এমনটা পারি কারণ পারিবারিক বন্ধনগুলো আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপুর্ন। ফুটবল খেলা তো নিশ্চয়ই দেখেছো তুমি। খেলার সময় কিন্তু একজন খেলোয়াড় সারা মাঠেই খেলে কিন্তু তার লক্ষ্য কিন্তু সারা মাঠ থাকেনা। তার লক্ষ্য হচ্ছে গোলপোষ্ট। যেভাবেই হোক বলটাকে গোলপোষ্টের কাছে নেয়ার জন্যই সে নানাভাবে চেষ্টা করে। এবং এক্ষেত্রে বিপরীত পক্ষের সমস্ত বাঁধাকে সে শক্তি দিয়ে নয়, কৌশলে মোকাবিলা করে। কারণ শক্তি প্রদর্শন করতে গেলেই রেফারি হলুদ কার্ড বা লাল কার্ড দেখাবেন। আমাদের জীবনটাও কিন্তু এমন একটি খেলার মাঠের মতো। পার্থক্য শুধু জীবনে আছে অসংখ্য লক্ষ্য। পারিবারিক সম্পর্কগুলোর হক আদায়কেও আমি একটা লক্ষ্য হিসেবে দেখি। এক্ষেত্রে যখনই বিভিন্ন ধরণের বাঁধা আসে আমি সেসবকে কৌশলে মোকাবিলা করতে চেষ্টা করি। তোমাকেও এখন থেকে সেভাবে চেষ্টা করতে হবে। আর চেষ্টা করলে ফলাফল বেশির ভাগ সময়ই ইতিবাচক হয়। ঠিক তেমনি আমাদের মাঝে যাতে কোন আড়াল তৈরি না হয় সেটাকেও একটা লক্ষ্য হিসেবে দেখতে হবে আমাদেরকে।

- ইনশাআল্লাহ! আমি আজ থেকে এভাবেই চিন্তা করবো।

-তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি একটুতেই অনেক বেশি সিরিয়াস হয়ে যাই। এর কারণ আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। দেখেছো নিশ্চয়ই যখন গাছ ছোট থাকে তাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হয়। কিন্তু একবার সে বড় হয়ে গেলে গরু বা ছাগল তার কোন ক্ষতি করতে পারে না বিধায় ঘিরে রাখার দরকার পড়েনা। আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কটাও এখন ঠিক চারা গাছের মতো। সম্পর্কের মাঝে গোপনীয়তা নানাধরনের ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দিতে পারে আমাদের মধ্যে। যা আমাদের দাম্পত্যের চারা গাছের বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে মারাত্মকভাবে। তাই চলো আমরা আজ থেকে বন্ধু হয়ে যাই।

-দুঃখিত! আমি খুবই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। তাই ছেলে বন্ধুর অনুমতি নেই।(দুজনই হেসে ফেললো একসাথে।)

-তুমি কি ফ্রেন্ড মানে জানো রিনিলা?

-(হেসে) হ্যা জানি। এফ ফর ফিউ, আর ফর রিলেশন, আই ফর ইন, ই ফর আর্থ, এন ফর নেভার, এন্ড ডি ফর ডাই। ফ্রেন্ড মানে “ফিউ রিলেশন ইন আর্থ নেভার ডাই”। কোথায় যেন পড়েছিলাম বিয়ে মানে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মধ্যমে নতুন কিছু সৃষ্টি, স্বপ্ন পূরণ। বিয়ে মানে পারস্পরিক ভালোবাসা, দায়িত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সম্মান ও মূল্যায়ন। বিয়ে মানে বন্ধুত্ব। আর বন্ধুত্ব মানে একই দেহে ভিন্ন দুটি নাম।

- আমার কেন জানি সবসময় মনেহয় প্রতিটা সম্পর্কের অর্থ পরিষ্কার থাকা উচিত মানুষের কাছে। আর মনের ভেতর থেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় ইত্যাদির শেকড়গুলো উপড়ে ফেলতে পারলেই সম্পর্কের মধ্যের অকারণ জটিলতাগুলো এড়ানো সম্ভব হয়। আমরা যদি সত্যিই সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবন চাই, তাহলে আমাদের চাওয়া আর প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। নিজেদের মধ্যে গোপনীয়তা রেখে এটা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ বিয়ে বজায় থাকে বিশ্বাসের উপর। বিয়ে নিয়ে অসংখ্য বই পড়েছি আমি, লেকচার শুনেছি, নানাধরনের পরামর্শ পেয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছে, যে যতো ফর্মুলাই দিক না কেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই জীবনের গন্তব্য যদি এক না হয় সেক্ষেত্রে কোন পরামর্শই তাদেরকে সুখী করতে পারেনা।আসলে মানুষের মন যেহেতু খুব অস্থির তাই যেখানে শান্তি আর সুখ মিলে সেখানেই ছুটে যেতে চায়। সেক্ষেত্রে একমাত্র ধর্মবিশ্বাস ও সেইমতো আমল মানসিক অস্থিরতা দূর করতে পারে। শরীয়তের পরিপুর্ন জ্ঞান মানুষকে নানাবিধ সমস্যা থেকে দূরে রাখে এবং জীবনকে করে তোলে সুখী, সুন্দর ও সামাজিক।

-(হেসে) আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার পুরো বিষয়টা এতো চমৎকার ভাবে আমাকে বুঝিয়ে বলার জন্য। শুকরিয়া আদায় স্বরূপ আপনার জন্য চা নিয়ে আসি এখন।

রিনিলা উঠে যাবার পর রিসাব পাশ থেকে কাগজ আর কলম টেনে নিলো। ঝিরঝির বৃষ্টি আর ঝিকিমিকি জোছনার সংমিশ্রণে কাঁচা হাতেই এঁকে ফেললো একটা ছবি, সাথে রিনিলার জন্য লিখলো চার লাইন কবিতা.........



মনের আকাশ জুড়ে ঝরছে ঝরো ঝরো শ্রাবণ........

সমান তালে ছড়াচ্ছে জোছনা আলোর বিচ্ছুরণ.........

তবুও চলছে খেলা জোয়ার-ভাটা জয়-পরাজয়ের......

তোমাতে পেয়েছি সন্ধান নিবিড় এক আশ্রয়ের.........

চলবে..............(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

১৯৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File