ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৬

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৮ মার্চ, ২০১৩, ০৩:০৩:০৮ দুপুর



শ্বশুরবাড়িতে রিসাবের সবচেয়ে বেশি পছন্দ তার শ্বশুর সাহেবকে। অনেক বইপ্রেমী দেখেছে কিন্তু শ্বশুর সাহেবের মতো বইপ্রেমী দ্বিতীয়টি আর দেখেনি জীবনে। রিসাবের কাছে মাঝে মাঝে শ্বশুর সাহেবকেই জীবন্ত একটা বই মনেহয়। চাইলেই যে বইয়ের মধ্যে খুঁজে নেয়া যায় জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলোকে। বেড়াতে এলে তাই পুরোটা সময় প্রায় শ্বশুর সাহেবের সাথেই কাটায় রিসাব। বাবা নিশ্চয়ই লাইব্রেরীতে, তুমি যাও বাবার কাছে....বলেই রিনিলা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। ধীর পায়ে লাইব্রেরীতে এসে দাঁড়ালো রিসাব। দরজায় বড় বড় করে লেখা আছে শেখ সাদীর একটি বাণী-“ বিদ্যা শয়তানের সাথে লড়াই করার হাতিয়ার স্বরূপ।” দরজা নক করলে শ্বশুর সাহেব এসে প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে আমার জামাই বাবাজ্বি যে....এসো এসো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি আমি। প্রচন্ড একটা ভালো লাগার আবেশ ছেয়ে গেলো রিসাবের মন জুড়ে। হেসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন বাবা?

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! খুব ভালো আছি আমি। চলো ভেতরে গিয়ে বসবে। তোমাকে আমার বানানো চা পান করাবো আজ। জিনিসপত্র সব এখানেই আছে।

-(হেসে) চলুন আমি আপনাকে সাহায্য করছি বাবা।

-(চা বানাতে বানাতে) তুমি আমার মামনিটাকে নিয়ে গেলে আর আমারো ঘনঘন চা পান করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেলো। আমার মামনির কাছে যদি দশ মিনিট পর পরও চা চাইতাম, হাসিমুখে এনে দিতো। কিন্তু তোমার শাশুড়ির কাছে একবারের জায়গায় দুইবার চাইলেই শুরু করে চিৎকার। তাই নিজেই ব্যবস্থা করে নিয়েছি। তারপর বলো কেমন চলছে তোমাদের সংসার?

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! খুব ভালো চলছে বাবা।

-(হেসে) মেশক-আম্বর যেমন নিজেই সুগন্ধী বিস্তার করে, মালিককে বলে দিতে হয় না। তোমার ভালো থাকাটাও তেমন চেহারার উজ্জ্বল দেখে বোঝা যাচ্ছে।(কিছুক্ষন নিরবতার পর) আমার মেয়েটাকে আমি আমার ভেতর যতটুকু জ্ঞান ছিল তার আলোকে গড়তে চেষ্টা করেছি। যথাযথ আদর-ভালোবাসা দিতে পেরেছি কিনা জানি না, তবে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি শিক্ষা যথাযথ দিতে চেষ্টা করেছি।

-বাবা আমি তো রিনিলাকে দেখার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যদি আল্লাহ আমাকে বাবা হবার সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আমি চেষ্টা করবো আপনার মতো বাবা হবার। আদর-ভালোবাসা কতটুকু দিলাম সেই হিসাব না, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি শিক্ষা যথাযথ দিতে পারছি কিনা সেই হিসাব করবো।

-(হেসে) আমি যখন তোমার বয়সি ছিলাম হযরত আলী রাঃ এর একটা বাণী পড়েছিলাম- “জ্ঞান ধন-সম্পদ অপেক্ষা উত্তম। জ্ঞান তোমার হেফাজত করে, আর তুমি ধন সম্পদের হেফাজত কর। জ্ঞান শাসক আর ধন-সম্পদ শাসিত। ধন ব্যয় করলে হ্রাস পায় আর জ্ঞান ব্যয় করলে বেড়ে যায়।” এরপর থেকে জ্ঞানার্জন-ই আমার জীবনের মিশন। এই মিশনটা আমি আমার মেয়েটার মধ্যেও ঢুকাতে চেষ্টা করেছি।

-প্রতিটি মানুষ প্রতিটি বাবা-মা যদি আপনার মতো করে চিন্তা করতে পারতো, তাহলে হয়তো আমাদের পৃথিবীটা অন্যরকম হতে পারতো।

-আবুল আসওয়াদ রঃ বলেছেন- “জ্ঞানের চেয়ে বেশী সম্মানের কোন বিষয় নেই। বাদশাহ জনগণের শাসক হয়ে থাকে এবং জ্ঞানীরা বাদশাহদের শাসক হয়ে থাকে।” আমি তাই জ্ঞানী হতে চেষ্টা করেছি। নিজেকে আর পরিবারকে বদলাতে চেষ্টা করেছি সেই আলোকে। এখন থাক এসব কথা।

-(হেসে) আমি তো আপনার এসব সুন্দর সুন্দর কথা শুনতেই এসেছি বাবা।

-(হেসে) তোমার কোন ধরণের বই বেশি পছন্দ সেটা কিন্তু জানা হয়নি এখনো। জানো তো নিশ্চয়ই মানুষের পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে তার রুচিবোধ আর মানসিক অবস্থা বোঝা যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা রোমাঞ্চ প্রিয় হয় বলেই তারা গোয়েন্দা বা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী পছন্দ করে। তরুণ-তরুণীরা স্বভাবতই রোমান্টিক উপন্যাস পছন্দ করে। বাস্তববাদীরা পছন্দ করে রাজনৈতিক বা প্রবন্ধের বই।আবার আমার মত যা পাই তাই খাই পাঠকও অনেক আছে।

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! আমিও আপনার মত যা পাই তাই খাই ধরনের পাঠক। তবে ইতিহাস আর ভূগোলের বই একটু বেশি পছন্দ আমার। আমার বাবাও খুব বই পড়তে পছন্দ করেন। ছোটবেলায় আমাকে বলতেন, বেশি বেশি বই পড়ো, কারণ বই পড়া মানুষের আত্মাকে উন্নত করে, চিন্তা শক্তি বাড়ায়, বিবেককে শক্তিশালী করে। আর বিবেক শক্তিশালী হলে অন্যায্য কাজ করতে তোমার আত্মা তোমাকে বাঁধা দেবে।

-(হেসে) একদম ঠিক বলেছেন বেয়াই সাহেব। আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষনেও দেখেছি যারা বই পড়ে তাদের ভাষা এবং চিন্তা-ভাবনা অনেক বেশি পরিপক্ক ও পরিশুদ্ধ হয়। চা হয়ে গিয়েছে, দেখো কেমন হলো...!

-(চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে) মাশাআল্লাহ! অনেক মজা হয়েছে বাবা। আপনার কাছে চা বানানো শিখতে হবে। আমার রান্না মোটামুটি ভালো হলেও, চা খুবই পচা হয়।

-(হেসে) আমি রিনিলার কাছে শুনেছি তুমি রান্না করতে খুব পছন্দ করো।

-(হেসে) জ্বি বাবা। আসলে ছোটবেলায় মা যখন খুব অসুস্থ থাকতেন, রান্নার দায়িত্বটা তখন বাবা আর আমরা ভাইবোনরা মিলে পালন করতাম। ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছি রান্না করাটাকে। তাছাড়া আমি মনেকরি ছেলেমেয়ে উভয়েরই টুকটাক রান্না করার অভ্যাস থাকা উচিত। শখ করে না হলেও অন্তত বিপদে পড়লে যাতে কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

-(হেসে) আমিও তোমার সাথে একমত। রিসাব সব বাবা-মায়েরাই জামাইয়ের কাছে মেয়ের ভালো গুণসমূহকে জানতে চায়। আমি যদি তোমার কাছে জানতে চাই রিনিলার সবচেয়ে কোন জিনিসটা তোমার ভালো লাগে...জবাব দেবে?

-(হেসে) অবশ্যই জবাব দেবো বাবা। আমার কাছে রিনিলার যে জিনিস গুলো আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সেগুলো হচ্ছে, আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যর প্রতি দায়িত্বশীলতা, কে কি দিচ্ছে সে হিসাব না করে নিজের কতটুকু দেয়া উচিত আর কতটুকু দিতে পারছে সেই হিসাব করে সবসময়। যে কোন ব্যাপারে যুক্তি সহকারে যাই কিছু বলা হোক না কেন কোন রকম তর্ক ছাড়া রিনিলা সেটা মেনে নেয়, যদি কথাটা ওর বিপক্ষে যায় তবুও। ভুলের জন্য দুঃখিত হয় খুব স্বাভাবিক ভাবে। কখনো কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়ে না। অন্তত কারো সামনে তো অবশ্যই না। যদি কখনো আমি ওর কষ্ট দেখে ফেলি, তখনো দুর্বল না হয়ে স্মার্টলি বলে, জানি না কেন আজ আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না।

-আলহামদুলিল্লাহ!তোমার কথা শুনে আমার প্রান জুড়িয়ে গেলো বাবা। আমি এমন কিছুই শুনতে চাচ্ছিলাম আমার মেয়ের সম্পর্কে। আসলে অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন যদি বাস্তব জীবনে করা যায় তাহলে চরিত্রে দয়া, মায়া ও বিবেচনা ন্যায়পরায়ণতা, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ প্রভৃতি গুণাবলীর জন্ম হয় স্বতঃস্ফুর্তভাবেই। আমি সারাটি জীবন চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদেরকে অহিংসা, সততার পথে পরিচালিত করতে, সহ্য করতে, মানিয়ে চলতে, সবকিছুর মধ্যে সমতা রেখে চলতে। কেননা পিতা হিসেবে এসব আমার দায়িত্ব ছিল।

-ইনশাআল্লাহ! বাবা হবার আগে আমি আপনার আর আমার বাবার কাছে পিতার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের কোর্স করে নেবো। আমিও আপনাদের মতো একজন আদর্শ পিতা হতে চাই।

-(হাসতে হাসতে) দুটা পরামর্শ দিচ্ছি তোমাকে।এক. কোন এক বিজ্ঞ ব্যক্তি যদি কোন এক মুর্খ লোকের দলের মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে তার সম্মান বাঁচানোর আশা ছেড়ে দিতে হবে। কেননা পাথরই মণি-জহরত ভেঙ্গে টুকরো করে ফেলে। তাই অজ্ঞ এবং মুর্খদের থেকে সদা সাবধান।দুই. তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয়- নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, প্রার্থনা এবং দান এই তিন বিষয়ে যেন কোন সন্তোষ না থাকে। প্রথমটি শেখ সাদী আর দ্বিতীয়টি চাণক্য এর বাণী।

-(হেসে) ইনশাআল্লাহ! বাবা আমি মনে রাখবো আপনার পরামর্শ।

-(হেসে)এখন চলো বাড়ির ভেতরে যাই। নয়তো তোমার শাশুড়ি কাঠের খন্তা নিয়ে তেড়ে আসবে। তোমাকে কে তো আর কিছু বলবে না, ঝড় যাবে আমার উপর দিয়ে।

হাসি মুখে শ্বশুর-জামাই বাড়ির ভেতরে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।



চলবে................(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

২০৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File