একটি শিশুর আর্তনাদ-২

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৩ মে, ২০১৫, ০৬:৫৪:০৯ সন্ধ্যা



যারা বাবা-মা হয়নি বা নতুন বাবা-মা হয়েছে তারা হয়তো সতর্ক হবে এই ধরণের উদ্যোগে। যাতে তাদের সন্তানদের মনে হাহাকার ঘেরা আর্তনাদ জমাট কষ্টের রূপে তৈরি না হয়। কিন্তু বাবা-মার কারণে যাদের মনে এমন কষ্টরা ছটফট করে আর সময় সময়ে ঢুকরে কাঁদে তাদের কি হবে? তারা তো কখনোই ফিরে পাবে না তাদের হারানো সেই শৈশব। তাদের মনের ক্ষতগুলো তো অপূর্ণই থেকে যাবে। যে কষ্ট তারা পরিবার থেকে পেয়েছে ভুলতে না পারার কারণে সবসময়ই তাদের মনের বিরাজ করবে নিজেকে ঘিরে অতৃপ্তি, হতাশা আর পরিবারকে ঘিরে রাগ, বিদ্বেষ। অনেকটা যেন আপন মনেই কথাগুলো বললো শাহরিন।

কিছুক্ষণ শাহরিনের দিকে তাকিয়ে থেকে অধরা বলল, অভিজ্ঞতা ভালো হোক বা মন্দ, সুখের হোক বা দুঃখের, আনন্দের হোক বা বেদনার, বিষণ্ণতার কিংবা আশা জাগানিয়া। চাইলে সবগুলোকেই কাজে লাগানো যায়। সম্ভব হয় নিজকে আরেকটু উন্নত করে,অন্যের জন্য এক টুকরো প্রেরণার উৎস হওয়া। আমাদের প্রফেশন থেকে তো আমরা এই কথাটাই শিখেছি তাই না? কোথায় যেন পড়েছিলাম- “অপরের দুঃখ নিয়ে যারা চিন্তা করে, তাদের নিজেদের দুঃখ বলে কিছু থাকে না”। আসলেই নিজের দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য অন্যের দুঃখগুলোকে দূর করার মত কার্যকরী ফর্মূলা সত্যি অনেক কম আছে। তাই ‘নিজের ঝরে যাওয়া স্বপ্নকে ঘিরে বন্ধ করে আহাজারি! চলো অন্যের স্বপ্নগুলোকে সঠিক পথের দিশা দেবার চেষ্টা করি’। নিজের অভিজ্ঞতা থাকা কারণে ব্যাথাতুর মনগুলোকে বুঝতে অনেক বেশি সহজ হবে। তাদের মনে বুলিয়ে দেয়া সম্ভব হবে চাহিদা অনুযায়ী সহমর্মিতা ও ভালোবাসার পরশ।

হাসি ফুটে উঠলো শাহরিনের চেহারাতে। বলল, বলার মত করাটাও যদি এতটাই সহজ হতো তাহলে খুব ভালো হত। অধরা যাদের পুরো শৈশবটা কেটেছে অনাদর, অতি শাসনে আর নিরানন্দে। যাদের খুব ছোট ছোট চাওয়াগুলোকেও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। কখনোই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া হয়নি সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। একটু আদর, একটু ভালোবাসার জন্য যাদের মনের ভেতরটা ছটফট করতো। তারা যখন তাদের মতই ব্যাথাতুর কাউকে দেখে কতটা কষ্ট পায় সেটা কি উপলব্ধি করতে পারো তুমি?

একজন ভুক্তভোগীর মত করে হয়তো কখনোই উপলব্ধি করতে পারবো না আমি। কিন্তু সাধ্যমত চেষ্টা অন্তত করি। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তুমি কষ্টটা বোঝ বলেই তো চেষ্টা করবে এমন কষ্টের স্বীকার যাতে আর কাউকে না হতে হয়।

আর আমার কষ্টগুলো?

কষ্টের সময়গুলো তো তুমি পেড়িয়ে এসেছো। তোমার পক্ষে না অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব, না মুছে দেয়া সম্ভব তোমার কষ্টকর স্মৃতিগুলোকে। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যের জন্য কল্যাণকর কিছু করা অবশ্যই সম্ভব। জানি আমার পক্ষে বলাটা অনেক সহজ যেহেতু আমি তোমার জায়গার দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই যখন একটু নীচের দিকে তাকাবে তখন দেখবেন মনের অভিযোগ, হতাশা অনেক কমে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর ইসলামের শিক্ষাও তো এমনটাই তাই না?

কোন জবাব না দিয়ে ফাইল খুলে কাজে মন দিলো শাহরিন। সাথে সাথে উপলব্ধি করলো অধরা এভাবে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। শরীয়তের উদাহরণ টেনে সে শাহরিনের কথা বলার পথটাই রুদ্ধ করে দিয়েছে। অধরার সেঝ ভাইয়াও একজন নিউরো সাইকোলজিস্ট। ভাইয়ার বলা একটা কথা মনে পড়লো। ভাইয়া বলেছিলেন, “আমাদের প্রফেশনটাই এমন প্রচুর কথা বলতে হবে মানুষের সাথে এবং শুনতে হবে আরো অনেক বেশি। কথা বলা ও শোনা দুটাকেই তাই উপভোগ করতে হবে। যে যাই বলবে প্রথমে মন দিয়ে শুনে যেতে হবে এবং বোঝানোর ক্ষেত্রে কখনোই এমন কিছু বলা যাবে না যাতে কথা বলার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আর ইসলামিক কাউন্সিলাররা এই ভুলটাই করে ফেলে অনেক সময়। তারা প্রথমের কুরআন ও হাদীসের উদাহরণ দিয়ে মন খুল কথা বলার পথ রুদ্ধ করে দেয়। অবশ্যই সবকিছুর সমাধান দিতে হবে কুরআন ও হাদীস দিয়ে কিন্তু সেটা দিয়ে হবে একটা বিশেষ নিয়ম মেনে। অনেকটা স্কুলের পরীক্ষার ব্যাখ্যার নিয়ম মেনে। অর্থাৎ, প্রথমে রোগীর সমস্যার উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তাকে সেই প্রসঙ্গে মন খুলে কথা বলতে দিতে হবে। অতঃপর তার বলা কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এবং সবশেষে মন্তব্যে এসে কুরআন ও হাদীসের বিধান মনে করিয়ে দিতে হবে।” বোকামীর জন্য নিজের উপরই বিরক্ত হলো অধরা। শাহরিনের মনে জমে থাকা বহু বছরের কষ্ট, অপ্রাপ্তি ক্ষোভের আকারে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল। এটা বেড়িয়ে গেলে অনেকটা শান্ত হয়ে যেত মন কিন্তু তার অসতর্কতা মূলক একটি কথার কারণে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেলো।

শাহরিনের দিকে তাকিয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে শাহরিনের। অধরার মনেহলো মনের ভেতরে বসে থাকা ছোট্ট শিশুটা যেন জেগে উঠেছে শাহরিনের। বর্তমান থেকে টেনে তাকে নিয়ে গেছে অতীতের সেই ব্যথাতুর দিনগুলিতে। সেই শিশু মনে জমে থাকা অভিমানরা আর্তনাদ করছে ক্রমাগত। এখন কিছু না বলাটাই ভালো শাহরিনকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় অধরা জানে বোঝানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন অভিমানী কাউকে কিছু বুঝিয়ে বলাটা। কারণ অভিমান সবার আগে যা করে তা হচ্ছে মনে যুক্তি প্রবেশের দ্বারকে রুদ্ধ করে দেয়। আর অভিমানী মন খুবই চৌকস অনুসন্ধানী। সে খুঁজে খুঁজে মনের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু অনুযোগ, অভিযোগকে একসাথ করে সিন্ধু গড়ে তোলে। তাতে অভিমানী ব্যক্তি মনে কষ্টের সমুদ্র তৈরি হয়ে যায় এবং নিজের কষ্টের পরিমাণ ও প্রচণ্ডতায় তার বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মনে পড়লো প্রফ বলতেন, অভিমান হচ্ছে মনের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। যখন হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বা স্পন্দন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ হৃদপিন্ড শরীরের অন্যান্য স্থানে রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয়,তখন তাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া বলে। অভিমানও ঠিক একই কাজ করে মনের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করে রুদ্ধ হয়ে যার মনের যুক্তি গ্রহণের দ্বার।

নিজ অভিজ্ঞতায়ও এমনটাই দেখেছে অধরা। প্রচন্ড অভিমানী কারো সাথে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে অনুভব করে কোন গোলোক ধাঁধার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা অনেকটা ঠিকানা হাতে কারো বাড়ি খোঁজার মত অবস্থা। অর্থাৎ, সঠিক ঠিকানার সন্ধান আছে কিন্তু কোন পথে সেখানে পৌছাতে হবে সেটা জানা নেই। তাই অবিরাম ঘুরপাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য চারপাশে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা, বার বার ঠিকানা লেখা কাগজটিকে চোখ বুলিয়ে নেয়া, পথের মাঝে কাউকে থামিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়া যে সঠিক পথেই চলছি না। ঠিক তেমনি অভিমানী ব্যক্তির দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কেননা দেখা যায় অভিমান ভাঙাতে গিয়ে আরো অভিমানী হয়ে যায় রোগী। কখনো কখনো প্রচন্ড রেগে যায়। তাই কথা বলার সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয় অভিমানীর মনের গোলকধাঁধার কোনদিকে খাঁদা-খন্দ, কোনদিকে পথ গিয়ে দেয়ালে ঠেকেছে, কোনদিকে পঁচা ডোবা-নালা, কোন দিকে চোরাবালি, কোনদিকে অথৈ সমুদ্র, কোনদিকে হিমালয় সম পাহাড়, আর কোন দিকে ঘাসফুলে ছেয়ে যাওয়া পথ।

আপাতত তাই শাহরিনকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলো অধরা। ওর মনে বসে থাকা শিশুটির আর্তনাদ সে অবশ্যই শুনবে কিন্তু এখন নয়। অবুঝ শিশুটির মনে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার পরশ বুলিয়ে ক্ষতগুলো সারাতেও চেষ্টা করবে কিন্তু এখন সেটার জন্য সঠিক সময় নয়। অধরাও তাই চুপচাপ নিজের কাজে মন দিতে চেষ্টা করলো।

বিষয়: বিবিধ

১৯৮১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319856
১৩ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৯
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, এখন একটু ব্যাস্ত, তাই হাজিরা দিলাম, স্টিকি হলে পরে পড়ে যাবো।
319864
১৩ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগলো
319921
১৪ মে ২০১৫ রাত ০২:০৮
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম । Happy

“অপরের দুঃখ নিয়ে যারা চিন্তা করে, তাদের নিজেদের দুঃখ বলে কিছু থাকে না”। Thumbs Up বাস্তব কথা!

অভিমান ভাঙাতে গিয়ে আরো অভিমানী হয়ে যায় রোগী Thinking
ছবিটিকে ঘিরে আমার অনেক ভয় লাগছে Worried! জাযাকিল্লাহু খাইর চমৎকারভাবে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার জন্য!
Rose
319944
১৪ মে ২০১৫ রাত ০৩:০৩
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : ‘তারা প্রথমে কুরআন ও হাদীসের উদাহরণ দিয়ে মন খুল কথা বলার পথ রুদ্ধ করে দেয়' আপনার এই লাইনটা পড়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল আপু। কিছুদিন আগে কানাডায় ক্যান্সারে আক্রান্ত এক অল্পবয়সী মায়ের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল যিনি আড়াই বছর এবং তিন মাস বয়সী দুই শিশু সন্তানকে রেখে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। অনেকে তাকে দেখতে যেয়ে ইহকালে তার এই কষ্টের বিনিময়ে পরকালে জান্নাত লাভের গল্প শোনাতেন। অসুস্থ হলে মানুষের মন এমনিতেই দুর্বল থাকে এবং মুসলিম যে কেউ নিজে থেকেই তার গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে চায়। তার দিকে তাকালে আমার কাছে কেন জানি মনে হতো তার চোখ দুটো বলছে, জান্নাতের কথা নয়, বাচ্চাদের দায়িত্ব কে নিতে চায় তা শুনতে চাই। অনেকে অনেক স্বান্তনার বাণী শোনালেও তাকে খুশি করার জন্য হলেও এই নিশ্চয়তাটুকু সেখানে উপস্থিত কেউ দেয়নি। জানিনা এই ঘটনা বলাটা আপনার লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক হল কিনা তবে একসাথে থেকেও আমরা অনেকসময় আপনজনদের এই আর্তনাদগুলো বুঝতে পারিনা। ধন্যবাদ আপু আপনাকে Good Luck Rose
320036
১৪ মে ২০১৫ বিকাল ০৫:১০
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

তুমি কষ্টটা বোঝ বলেই তো চেষ্টা করবে এমন কষ্টের স্বীকার>(শিকার) যাতে আর কাউকে না হতে হয়।

প্রথমে রোগীর সমস্যার উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তাকে সেই প্রসঙ্গে মন খুলে কথা বলতে দিতে হবে। অতঃপর তার বলা কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এবং সবশেষে মন্তব্যে এসে কুরআন ও হাদীসের বিধান মনে করিয়ে দিতে হবে।”


শ্রোতার বড্ড অভাব!!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File