ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৫

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৬ মার্চ, ২০১৩, ০৬:০১:৫১ সন্ধ্যা



বই থেকে চোখ তুলে আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো রিনিলা, রাত পণে একটা বাজে। কখনোই ফিরতে এতো রাত করে না রিসাব। সাধারণত রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই চলে আসে সবসময়। কখনো দশ মিনিট দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলেও ফোনে জানিয়ে দেয়, কিন্তু আজ ফোনও করেনি আবার কল দিলে রিসিবও করছে না। মনের শান্ত দীঘিতে দুশ্চিন্তারা ঢিল ছুড়তে শুরু করলো। ঢেউয়ের আকারে আসতে লাগলো নেতিবাচক সব চিন্তা। দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য বই নিয়ে বসেছে কিন্তু মন লাগছে না কিছুতেই। বই বন্ধ করে চুপচাপ বারান্দায় এসে বসলো। মিটিং হবার কথা ছিল আজকে সেখানেই হয়তো দেরী হচ্ছে, কিংবা হয়তো হঠাৎ কোন গুরুত্বপুর্ন কাজ এসে গিয়েছে। ব্যস্ততার কারণে হয়তো ফোন করতে পারছে না কিংবা খেয়ালই নেই.....!এমন নানা ভাবনা দলে দলে হাজির হচ্ছে রিনিলার মনে। রিং হতেই ছো মেরে মোবাইল তুলে নিয়ে স্ক্রীনে দেখলো শাশুড়ির নাম্বার। সালাম এবং কুশলাদী বিনিময়ের পর রিসাব এখনো ফেরেনি জেনে শাশুড়ি বেশ অবাক কণ্ঠে বললেন, রিসাব ফেরেনি এখনো? ফোন করে কিছু জানায়নি?

-জ্বিনা মা! তবে আমি ফোন দিয়েছিলাম উনি মনেহয় ব্যস্ত, তাই ধরেননি।

-যতই ব্যস্ত থাক ফোন করে জানানো উচিত ছিল রিসাবের। বাসায় তুমি টেনশন করবে এটা তো ওর অজানা নয়।

-হয়তো কোন কারণে আটকে গিয়েছেন মা। নয়তো উনি তো সবসময়ই খুব সতর্ক এসব বিষয়ে। চিন্তা করবেন না মা। আপনি বরং দোয়া করুন বেশি করে। ইনশাআল্লাহ চলে আসবেন উনি।

-(হেসে) আমার অভিজ্ঞতা কি বলে জানো? বিপদ-সমস্যা-অসহায়ত্বের সময় নিবিড় আশ্রয় হতে পারা মেয়েদের সবচেয়ে বড় গুনসমূহের একটি। যে কোন পরিস্থিতিতে মনখারাপ লাগলে বা অসহায় লাগলে, ভালোবাসার ক্ষমতা দিয়ে দুর্বল মুহুর্তের সহায় হতে পারবে, মনে আশ্বাস জাগাতে পারবে এমন কোন মেয়েকেই জীবনসাথী হিসেবে পেতে চায় ছেলেরা।

-এমন জীবনসাথী হবার জন্য আমাকে কি কি করতে হবে মা?

-(হেসে) তুমি এমন জীবনসাথী বলেই হয়তো এতোটা নিশ্চিন্তে এখানে বসে থাকতে পারছো এবং আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না করে, উল্টো আমাকেই বোঝানোর চেষ্টা করছো।

-অভিযোগ করবো কেন মা? ইচ্ছে করে তো কেউ আর এমন কিছু করে না। আবার অনেক সময় বেখেয়ালে ভুল হয়ে যায়। যে কারো এমনটা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই ভুল না বুঝে বরং বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

-আমি নিজেও তো একটি মেয়ে তাই খুব ভালো করেই জানি যে, এই ধরণের পরিস্থিতিগুলোতে অনেক সময় না চাইলেও মনে ক্ষোভের জন্ম হয়। কেন আগে থেকে জানালো না, ফোন করতে কতটুকুই বা সময় লাগে, ফোন ধরলো না কেন, ইত্যাদি নানা চিন্তা এসে মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আর ক্ষোভ জলোচ্ছ্বাসের মতো মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যেতে চায় বা বেশির ভাগ সময়ই নিয়ে যেতে পারে। তাই ক্ষোভ ন্যায্য হলেও ক্ষোভের কারণগুলো বিবেচনা করতে হয় যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে নয়। কারণ ক্ষোভের সাথে যখন আবেগ যোগ হয় তা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করবে এটাই স্বাভাবিক।

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! আপনার ভাবনাগুলো অনেক সুন্দর মা।

-(হেসে) পঁয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাও যে জড়িয়ে আছে এই ভাবনার সাথে। আসলে কি জানো দাম্পত্য জীবনে একে অপরের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে ধৈর্য্য খুব গুরুত্বপুর্ন। তাই সর্বাবস্থায় ধৈর্য্য ধরার চেষ্টা করতে হবে। তবে ধৈর্য্য ধরা মানে কিন্তু সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেয়া না। অপরকে খুশি করার জন্য প্রয়োজনে নিজের ছোটখাট স্বার্থত্যাগ করার সাথে সাথে, এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে ত্যাগ করতে গিয়ে যেন নিজের স্বকীয়তা বা নিজস্বতা হারিয়ে না যায়।

-এটা আমারো ধারণা মা যে কখনোই নিজের স্বকীয়তা বা নিজস্বতাকে বিসর্জন দেয়া ঠিক না। নানা পরিবর্তনের মাঝেও নিজের কেন্দ্রীয় সত্ত্বাটিকে ধরে রাখতে হবে। তা না হলে নিজের সাথেই নিজেকে অভিনয় করে চলতে হয়। আর নিজের ব্যক্তিস্বত্বার সাথে যে ভানহীন থাকতে পারে না, জীবনে অনেক কিছু পেলেও সে সত্যিকার অর্থে সুখী বা তৃপ্ত হতে পারে না। যার ফলে তার আত্মা আলো ছড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে।

-(হেসে) এবার তো আমাকে বলতে হয় যে তোমার ভাবনাগুলো খুব সুন্দর। রিসাব বিয়ের আগে সবসময় আমাকে বলতো, মা খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে এমন মেয়ে খুঁজবে আমার জন্য। খুব সাধারণ আটপৌরে কথোপকথনেও যে মেয়ে তার মনের উদারতা-সুন্দরতা-উষ্ণতাকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। তোমার কথা শুনলে মনেহয় আমি আমার ছেলের মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ।

-(হেসে) আমি বিয়ের আগে শাশুড়িদের নিয়ে অনেক ভীতিকর কথা শুনেছিলাম কিন্তু আপনাকে দেখার পর সেসব মনেহলে খুব হাসি পায়।

-(হেসে) আমিও তোমাদের বিয়ের আগে বৌদের নিয়ে অনেক ভীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার হতে দেখেছি কাছের-দূরের অনেককেই। আসলে কি জানো একটা সংসার তখনই সুন্দর হতে পারে, যখন প্রতিটা সদস্য অন্যেরা কি করছে না ভেবে, নিজের করণীয় পালনের যথাযথ চেষ্টা করে। বিশেষ করে পরিবারের মেয়েরা যদি সচেতন হয়, তাহলে পারিবারিক জটিলতা অনেক কমে যায়। জীবনের চলার পথে সময় বদলায়, পরিস্থিতি বদলায়, প্রয়োজন বদলায়, কখনো সুসময় থাকে কখনো থাকে দুঃসময়। সর্বাবস্থায় ভারসাম্য যেসব মেয়েদের মধ্যে থাকে তাদেরকে ঘিরেই কিন্তু লেখা হয়েছিল- “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।” আমার বিয়ের পর আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এমন রমণী হবো যার গুণে সংসারে সুখ প্রস্ফুটিত হয়ে বিকশিত হবে শান্তি।

-আমিও আপনার মতো হতে চাই মা। সুখী আর সুন্দর একটা জীবন যাপন করতে চাই। এরজন্য আমাকে যা যা করতে হবে আমি করবো, ইনশাআল্লাহ।

-(হেসে) আমি খুব বেশি কিছু করেছি বলে মনেপড়ে না। তবে যে জিনিসটা করিনি তা হচ্ছে বিবেকের মধ্যে আবেগকে ঢুকতে দেইনি কখনোই। কারণ বিবেকের মধ্যে যখন আবেগ ঢুকে যায়, জীবনকে তখন জটিলতা আর সমস্যা ঘিরে ধরে। পরিবারের সদস্যরা যখনই কোন ভুল বা অন্যায় করেছে আমার সাথে, আমি রাগ না করে বুঝতে চেষ্টা করেছি কেন এমন করলো। ধীরে ধীরে প্রত্যেকের কাজের পেছনে কি যুক্তি বা মনোভাব কাজ করছে সেটা বুঝে যেতে শুরু করলাম। এরপর থেকে আর রাগ করার সুযোগই হয়নি। বেশি বোঝার এটাই হচ্ছে সমস্যা, সবসময় হার মানতে হয় অন্যের রাগ-জেদ-বোকামোর কাছে।

-(হেসে) আমি আপনার কথা যত শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি মা। এতো সুন্দর করে আপনি কিভাবে ভাবতে শিখেছিলেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

-আলহামদুলিল্লাহ! একজন মানুষের ভাবনা কোনদিকে প্রভাবিত হবে সেটা তার জীবনদর্শন, জীবনবোধ আর জীবনের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে। আমার জীবনদর্শন হচ্ছে ইসলাম, ইসলামকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে আমার জীবনবোধ আর আমার জীবনের উদ্দেশ্যে দুনিয়ার কর্মের দ্বারা আখেরাতের জন্য কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা।

-ইনশাআল্লাহ! আমিও এই মুহুর্ত থেকে নিজেকে এই ভাবনার আলোকেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করবো মা। ঐতো যে রিসাব এসে গিয়েছেন।

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! ঠিকআছে আমি এখন রাখছি। সকালে ফোন দিতে বলো রিসাবকে।

শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দরজা খোলার জন্য ছুটল রিনিলা......

চলবে...........(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

১৭৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File