ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-৪
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৪ মার্চ, ২০১৩, ১১:২৭:২২ রাত
অফিস থেকে ফিরে রিনিলাকে ঘরে না দেখে মেজাজ খিচড়ে গেলো রিসাবের। যদিও বুঝতে পারছে যে অযৌক্তিক রাগ কিন্তু তারপরও কেন জানিনা মেজাজকে ঠাণ্ডা করতে পারছে না। মেজাজ খারাপের মাত্রা আরো বাড়ল যখন কিচেনে গিয়ে দেখল কোন খাবারই নেই। কফি আর টোস্ট রেডি করতে করতে কল দিলো রিনিলাকে, মোবাইল বন্ধ। অধিক শোকে মানুষ হয় পাথর আর অধিক রাগে রিসাব হলো শীতল। খাবার শেষ করে রান্নার আয়োজনে মন দিলো। যেখানেই গিয়েছে ফিরে আসলে নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগবে রিনিলার কারণ বাইরে কোথাও সাধারণত কিছু খায় না সে। রান্না শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই রিনিলা ফিরলো। স্বামীকে কিচেনে দেখে সালাম দিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, তুমি কখন এসেছো? কিচেনে কি করছো? হায় আল্লাহ! তুমি রান্না করছো কেন? কি আশ্চর্য! কথা বলছো না কেন? রিসাব বলল, তোমার প্রশ্নপত্র তৈরিতে যাতে বাঁধা না পরে তাই কথা বলছি না। প্রশ্নপত্র তৈরি হোক তারপর ভাইবা দেবো। খিলখিল হেসে ফেললো রিনিলা, আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর দুজন মিলে রান্না করবো, বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো। রিসাবের মনের আকাশ জুড়ে যে মেঘের ঘনঘটা বিরাজ করছিলো, রিনিলার দমকা হাসির হালকা বাতাসই যথেষ্ট সেখানে নতুন সুর্যোদয়ের জন্য। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে রিনিলা বলল-
-বিরক্ত হয়েছো আমার উপর? আমার খেয়াল ছিল না যে তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে আসবে। কথা বলছো না কেন? শোন তোমার রাগ হলে আমাকে বলো, চাইলে কিছুক্ষন বকে দাও কিন্তু প্লিজ চাপা ক্ষোভ পুষে রেখো না মনে। কারণ চাপা ক্ষোভ দাম্পত্যের জন্য মারাত্মক কুফল বয়ে আনে। এরফলে দাম্পত্যের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরির সহায়ক এনজাইমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-দাম্পত্যের কি তৈরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
-অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরির সহায়ক এনজাইমগুলো। আচ্ছা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি, দেখো দাম্পত্য জীবনে সুখকে ধরে রাখতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কোন বিকল্প নাই। আমাদের মনে এমনিতে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্ষিত থাকে। কিন্তু রাগ-ক্ষোভ-সন্দেহ ইত্যাদি আমাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
-দাম্পত্যের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জিনিসটা কি?
-শ্রদ্ধা-সম্মান থেকে উদ্বুদ্ধ ভালোবাসা।
-(হেসে রিনিলার কান ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে) মাথাভর্তি শুধু দুষ্টুমি তোমার। তবে তোমার এই অদ্ভুত কনসেপ্ট আমার পছন্দ হয়েছে।
-(হেসে) শুকরিয়া জনাব। সন্দেহ নিয়েও আমার একটা কনসেপ্ট আছে।
-(শঙ্কিত কণ্ঠে) তাই নাকি! আচ্ছা বলো শুনি।
-সন্দেহ হচ্ছে ঘুণ পোকার মতো বন্ধনকে কুরে কুরে খেতে থাকে যার ফলে মনে টক্সিন ছড়ায়। সম্পর্কের বন্ধন সরু হতে থাকে, বেড়ে যায় মনোমালিন্য, খিটপিট এবং দাম্পত্য জীবনে তার সুদূর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
-কি ধরণের সুদূর প্রতিক্রিয়া?
-সংসার জীবনে সন্দেহের সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনেকটা এটম বোমার মতো।
-(হাসতে হাসতে) তুমি সহ তোমার এসব চিন্তাকে যাদুঘরে রাখা দরকার।
-(অভিমানী কণ্ঠে) তুমি হাসছো! দম্পতিদের নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে এইসব কনসেপ্ট।
- হুমম.... আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি দাম্পত্য বিশেষজ্ঞ। তা কি অবস্থা আপনার দম্পতিদের?
- (হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! সবাই ধীরে ধীরে দাম্পত্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে এবং এনজাইমগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সতর্কতাও অবলম্বন করতে শুরু করেছে। তোমার পরামর্শ দরকার আমার একটা ব্যাপারে। তারআগে বলো আমাদের দুজনের মনোমালিন্য না হবার পেছনে কারণ কি কি বলে তুমি মনেকরো?
- (হেসে)আমরা দুজনই ঝামেলা অপছন্দ করি। আমাদের দাম্পত্য জীবনের চড়াই-উৎড়াইয়ের মুখোমুখি না হবার একটি কারণ হচ্ছে, ঝামেলা বাঁধতে পারে বুঝতে পারলেই আমরা যে যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করি শান্তি প্রতিষ্ঠার। আইথিংক আমাদের দুজনের সম্মলিত এই সংগ্রাম ঝঞ্ঝাটমুক্ত রেখেছে আমাদের সংসারকে।
- আমারো মনেহয় যে, শুধুমাত্র কিছু নিয়ম মেনে চলার কারণেই আমাদের জীবনটা এতো সুন্দর। দুজন সম্পুর্ন দুইরকম স্বভাবের হবার পরও আমাদের মাঝে কোন মত বা পছন্দের অমিল জনিত কোন সমস্যা নেই। অবশ্য এর আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমরা চেষ্টা করি মানুষের কথার প্রভাব মুক্ত থাকতে। মনোমালিন্য বা ভুল বোঝাবুঝিতে বাইরের কাউকে টানাই ঠিক না। সবাই পরামর্শ দেয় যার যার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার আলোকে। সুতরাং কনফিউশন বেড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
- (হেসে) কনফিউশন বেড়ে যাবার কথাটা একদম ঠিক বলেছো। আমার এক বন্ধুকে এসেছিলো তার স্ত্রীকে কিভাবে শরীয়তকে মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে সেই পরামর্শ চাইতে। একেকজন একেক রকমের পরামর্শ দিলেন, একজন তো এককথায় বলে দিলেন শরীয়ত না মানলে ডিভোর্সে তো আছেই। তাই এমন হযবরল পরিস্থিতির স্বীকার হবার চেয়ে বরং একা একাই সমাধান সুন্দর করে করা সম্ভব হয়। যখনই সাথে অন্য কেউ আসে বা জড়িয়ে যায় সমাধান জটিল হয়ে যায়। নানা মুনির নানা মত থেকে জীবনের সবক্ষেত্রেই বেঁচে থাকতে চেষ্টা করা উচিত।
- ইনশাআল্লাহ! আমরা এসব থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবো।
- (হেসে) হ্যা! জীবন আমাদের, সংসার আমাদের এবং ভবিষ্যতও যেহেতু আমাদেরই তাই এসবকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও শুধু এবং শুধুই আমাদের। অন্যের ভাবনার জালে ঘুরপাক খাওয়ার চেয়ে, নিজেদের ভুলগুলোকে সংশোধন করতে করতে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
-তাছাড়া সংসার জীবনে চলতে গেলে নানাধরনের বাঁধা সামনে এসে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। আর বাঁধাকে মোকাবিলা করার বা এড়িয়ে যাবার ক্ষমতা সব মানুষের ভেতরই থাকে। দাম্পত্য সুখের জন্য একজন স্বামী বা স্ত্রীকে কখনো শিল্পী, কখনো উদ্ভাবক, কখনো যাদুকর তো কখনো বিপ্লবী হতে হয়। সময়ের দাবী অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে পারলেই জীবনে সুখের ঘাটতিগুলো খুব সহজেই পুষিয়ে নেয়া যায়।
- (হেসে) আর তাছাড়া সংসার মানেই তো কিছু মান কিছু অভিমান আর সাথে ছোট ছোট দুঃখ-সুখের অপরূপ এক বন্ধন। ভালো লাগা আর ভালবাসার আয়নায় ভুল করে ভুলের বায়না ধরা হচ্ছে দম্পতিদের চিরাচরিত স্বভাব।
- (হেসে) এককথায় দাম্পত্য সুখের জন্য স্বামী-স্ত্রীকে হতে হবে দক্ষ গোলকিপারের মতো। যাতে সামলে যেতে পারে হাজারো কমান্ডমেন্টস।
চলবে............(ইনশাআল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন