অন্তরে জাগাই জ্ঞানো পিপাসা......৩
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৫:২৭:৫৪ বিকাল
জীবনের ক্ষুধা কি? ক্ষুধার কথা ভাবার চেষ্টা করার সাথে সাথে বেশি করে মটরশুঁটি দিয়ে রান্না করে পোলাও, মচমচে করে ভাঁজা ইলিশ মাছ, হাড়ি কাবাব, লেয়ার পুডিং ইত্যাদি খাবারের ছবি ভেসে উঠলো সাহিলের মনের পর্দায়। নিজেই নিজেকে বোকা, পেটুক বলে বকা দিয়ে আবারো ভাবতে চেষ্টা করলো সাহিল। কি তার মনের ক্ষুধা? অনেক চেষ্টা করেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। মানসিক ভাবে তাকে শক্তি দেয় এমন কি আছে? কোন জিনিসটার অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সে মানসিক ভাবে? বার বার শুধু অনলাইন জগতের কথাই মনে আসতে লাগলো। অনেক বন্ধুবান্ধব তার অনলাইনে। তাদের সাথে একদিন যোগাযোগ না হলেই মনখারাপ লাগে! যত যাই কিছু হোক না কেন একটু পর পর অনলাইন না হলে তার অস্থির লাগে। গতমাসে যখন বাবা অসুস্থ্য হয়েছিল তখন বাবার কষ্টে তার মুখ দিয়ে খাবার ঢোকেনি। কিন্তু একটু পর পর অনলাইন হয়ে সে ঠিকই বাবার আপডেট জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। বাড়িতে অনেক আত্মীয়-সজ্বন এসেছিলেন তখন। কিন্তু তাদের সবার সহানুভূতি, দোয়া, সান্ত্বনার চেয়ে ফেসবুকের বন্ধুদের লেখা শব্দগুলোকেই বেশি প্রশান্তিকর মনে হয়েছে তার কাছে। শরীর আর ক্ষুধার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভেবে দেখলো অনলাইন জগতটাও তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাহলে তার মনের ক্ষুধা কি অনলাইন জগত আর সেই জগতের বাসিন্দারা? উপলব্ধিটা নিজেই কাছেই কেমন যেন অস্বস্থিকর লাগলো সাহিলের। কেমন যেন একটা লাজুক আবহ ছেয়ে গেলো তার মনের ক্ষুধা অনলাইন লিখতে গিয়ে। কিন্তু যেহেতু সে নিজেকে সংশোধন করতে চায় তাই সত্যি কথাটিই লিখলো। নয়তো আপা তাকে সাহায্য করতে পারবে না।
রাগ নিয়ে তেমন বিপদে পড়তে হলো না সাহিলকে। তার তেমন একটা রাগ হয় না কখনোই কারো উপর। আবার হলেও দ্রুতই সে সেটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকেই সাহিল পছন্দের মানুষদের সাথে রাগ করে থাকতে পারে না। কেউ যখন বকাঝকা করে তখন কষ্ট পায়, অভিমান হয়। কিন্তু নিজেই আবার বুঝতে পারে অকারণে তো কেউ বকা দেননি। অবশ্য সাহিল এই স্বভাবটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছে বলেই মনেহয়। বাবাকে সাহিল কখনোই কারো উপর রাগ করে থাকতে দেখেনি। বাড়িয়ে যখনই কারো সাথে বাবার রাগারাগি হয় দু'চার ঘন্টা মধ্যেই বাবা তাকে ডেকে বলেন, চলো আমরা ভেতরে ভেতরে একে অন্যেকে দোষারোপ না করে সরাসরি কথা বলি। কথা বলতে গেলে আবারো মতের অমিল হতে পারে। তারচেয়ে চলো লিখে ফেলি যার যার যুক্তি। এরপর পয়েন্ট ভিত্তিক আলোচনা করা যাবে। এতে অকারণে আমাদের মনে বিষবাষ্প জমা হবে না। এবং সেটার দ্বারা নিজেকে বা অন্যকাউকে আমরা ক্ষতিগ্রস্তও করবো না। সাহিলের যদি কখনো কারো উপর রাগ হয় সে এই কাজটি করে। রাগের পেছনের কারণগুলো লিখে ফেলে পয়েন্ট ভিত্তিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে কয়েক ঘন্টা পর সেই লেখা দেখলে নিজেই অনেক পয়েন্ট বাদ দিয়ে ফেলে অহেতুক মনে করে। বাবাও এই কথাটিই বলেন। রাগের সময়টায় নাকি খুবই অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। তাই চারপাশে ধরার মত যাই পায় খপ করে ধরে সেটাকে রাগের পেছনে একটা যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। এবং তার রাগ আরো জোড়ালো হয় এরফলে। তাই রাগের পেছনের কারণগুলো যদি লিখে রাখা হয়। তাহলে মন শান্ত হবার পর সেটি চোখের সামনে মেলে ধরলে নিজের কাছেই অনেক কারণকে অনর্থক মনে হয়। যাক একটা ব্যাপারে অন্তত সে ভালো ছেলে আলহামদুলিল্লাহ। ভাবতে ভাবতে দন্ত বিকোশিত হয়ে গেলো সাহিলের।
একাকীত্ব কিভাবে উপভোগ করে? প্রশ্নটা মনে হতেই সাহিলের মনে হলো, ধূর একাকীত্ব কি উপভোগ করার জিনিস হলো। খুব একটা একাকীত্ব ফিলই তো কখনো করে না সে। সারাক্ষণই তো বাস্তবে নয়তো ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে হাসি-মজা, গল্প, খুনসুটি চলতেই থাকে তার। কখনো কখনো অবশ্য এমন হয় যে কাউকেই পাওয়া যায় না আশেপাশে বা অনলাইনে কোথাও। তখন সাহিল ঘুম দেয়। ঘুমের কোন সমস্যা তার নেই। শোবার সাথে সাথে সে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠে কাউকে না কাউকে পেয়ে যায় আবার একাকীত্ব দূর করার জন্য। সেই হিসেবে এভাবে বলা যায় যে, একাকীত্বকে সে উপভোগ করে ঘুমিয়ে আর একাকীত্ব দূর করে বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে। গঠনমূলক কিছুই সে করে না আসলে। ক্লাসের বইয়ের বাইরে খুব বেশি একটা পড়ে না। সৃজনশীল কোন শখও তার নেই। আবারো ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো সাহিলের ভেতর থেকে। জীবনটাকে কি উদ্দেশ্যহীন ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে এরআগে কখনোই বুঝতে পারেনি। যাইহোক, যা করে ফেলেছে সেটা তো বদলে ফেলা যাবে না। এখন থেকে সে নিশ্চিত একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোবে ইনশাআল্লাহ। এরপরের প্রশ্নের উত্তরে মন দিলো সাহিল। কি কি বা কোন কোন জিনিস তাকে ক্লান্ত করে?! সারাবছর যেহেতু ঠিকমতো পড়াশোনা করে না তাই পরীক্ষা এলেই সে সবচেয়ে বেশি ক্লান্তি বোধ করে পড়ার চাপে। পড়তে পড়তে শরীর মন ভেঙে পড়ে। জানা জিনিসও ভুলে যায়। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। এই যেমন ফিজিক্স পরীক্ষার দিন সে ফিজিক্স অর্থ কি সেটাই মনে করতে পারছিল না। মানসিক চাপ বা ক্লান্তি আসলেই ভয়াবহ জিনিস। নিয়মিত পড়াশোনা করতে হবে এখন থেকে। আরো একবার মনকে এই ব্যাপারে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ করে নিলো সাহিল।
সন্ধ্যার পর আপা তাকে আরো কিছু প্রশ্ন দিয়েছিল নিজেই নিজেকে করার জন্য। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরলো সাহিল।
১. তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?
২. “সময়”কে তুমি কিভাবে দেখো?
৩. রুটিন মেনে চলা কি পছন্দ করো?
৪. পড়াশোনা করতে কেমন লাগে?
৫. ক্লাসের বই ছাড়া অন্য কি ধরণের বই পড়তে ভালো লাগে?
৬. অবসরের উপকরণ সমূহ কি তোমার?
৭. তোমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি?
৮. মনখারাপ হলে কি করো?
৯. কোন জিনিসটা ছাড়া তোমার দিন চলেই না?
১০. কোন বিষয় কঠিন লাগলে কি করো?
১১. জীবনের সার্থকতা কিসের মাঝে খুঁজে পাও?
১২. যদি একবাক্যে জানতে চাওয়া হয় তোমার কাছে পরিবারের গুরুত্ব?
১৩. পড়ার সময় কি নোট করতে পছন্দ করো?
১৪. কেমন পরিবেশে পড়তে সবচেয়ে বেশি আনন্দ বোধ হয়?
১৫. পড়ার জন্য কি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে?
১৬. তোমার ভীষণ প্রিয় তিনটি বইয়ের নাম বলো!
১৭. ‘মুমিন মুমিনের আয়না’ এটি কি বিশ্বাস করো?
১৮. কারো সাথে বন্ধুত্ব করো কিসের ভিত্তিতে?
১৯. স্বপ্ন দেখো? খোলা চোখের স্বপ্ন? খুব বেশি দেখো এমন একটা স্বপ্ন বলো।
২০. তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে?
প্রশ্নগুলো নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লো সাহিল। আবার একটু অবাকও হলো ভেবে তাকে তো অন্যকারো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। অথচ উত্তর কি লিখবে সে ভেবে পাচ্ছে না! এটা কি খুব বেশি অদ্ভুত না যে সে নিজের সম্পর্কেই ভালো মত জানে না?! অথচ নিজেকে জানার প্রয়োজনীয়তা তো তার অজানা নয়! আপা কি তাকে এইজন্যই প্রশ্নগুলো দিয়েছে যাতে সে বুঝতে পারে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতাকে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, প্রতিদিন তিলাওয়াত, কোরআনের তাফসীর ও হাদীস অধ্যয়ন অবশ্যই করে সাহিল। কিন্তু মুমিন মুনিনের আয়না এটা বিশ্বাস করে কিনা সেটা তো কখনোই ভেবে দেখার চিন্তা মনে আসেনি! ফেসবুকে তার তিন হাজারের উপরে ফ্রেন্ড। নিয়মিত যোগাযোগ থাকে এমন ফ্রেন্ডের সংখ্যাও পঞ্চাশের উপরে। হ্যা এটা অবশ্যই খেয়াল রাখে সাহিল যাতে অশ্লিলতা সমর্থন ও প্রচার-প্রসার ঘটায় এমন কেউ যেন না আসে তার ফ্রেন্ড লিষ্টে। কিন্তু এছাড়া তো তেমন কিছু ভেবে দেখে না কখনোই। আজকের আগে তো ভেবে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। পরীক্ষায় পাশ করতে হবে তাই নাকে মুখে পড়ে সবসময়। পড়ার সাথে পরিবেশের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন চিন্তাও কখনো উদয় হয়নি মনে! এককথায় পরিবারের গুরুত্বই বা কি বলবে? স্বপ্ন তো কত রকমেরই দেখে। ভাইয়ার রুমে গেলে সেলফে সাজিয়ে রাখা মেডেল, ট্রফি দেখে খোলা চোখেই স্বপ্ন দেখে একদিন তার রুমেও এমন মেডেল, ট্রফিতে ভর্তি একটা সেলফ হবে। কিন্তু এটা যে সম্ভব না সেটাও জানে। সময়কে নিয়ে তো ভাবেই না পরীক্ষার সময় ছাড়া! আর ভাবতে ইচ্ছে করলো না সাহিলের নিজের সম্পর্কে। নিজের দিকে তাকাতে পারছে না সে। কেমন যেন সংকুচিত হয়ে আসছে ভেতরটা। অবনত হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। একজন মুসলিমের জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত সে খুব ভালো মতই জানে। তেমনি এটাও জানে তার জীবন যে লক্ষ্যহীন ছুটে চলছে।
উঠে দাঁড়ালো সাহিল। দ্রুত পায়ে আপার সন্ধানে চললো। হতাশাকে কখনোই মনে বাসা বাঁধতে দেয়া চলবে না। এখন তার কারো সঙ্গের প্রয়োজন। এমন কারোর যে তাকে সাহায্য করবে ভুলে ভরা জীবন থেকে বেড়িয়ে আসতে ইনশাআল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
১৯৩৩ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপু এতো খাবার ওহ......
আজকে সারাটা দিন দৌড়ের উপর ছিলাম আপু ।
ইনশাআল্লাহ বাদ ফজর কমেন্টস করবো।
বিশেষ করে ইমাম গাজ্জালি (রহ.)
এর বই পড়ে শুধুই কাঁদতাম।
এত কাঁদতাম যে হৃদয়টা আমার পাক সাফ হয়ে যেতো, তাফসীর পড়ে কত ইয়াক্বিন পেতাম।
সেই সুকুন নষ্ট করে ফেলেছে মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন অ্যাক্টিভিটি।
আমার দুইটা বড়াপু ছিলো যারা আমাকে খুউব আদর করতেন প্রচন্ড আদর এমনকি তাদের ঘড়ের একজন মনে করতেন তো তিনাদের অনেক বই কালেকশন এ ছিলো আমি ছোট মানুষ হলেও প্রচুর বই পড়ে ফেলতাম।
এমনকি ছোট অবস্থায় পাড়ার একটি পাঠাগাড়ে যেয়ে অনেক বই পড়তাম।
কিন্তু স্কুলের বই TTMP এর মত পড়তাম টাইনা টুইনা মেট্রিক পাশ।
হা হা হা সাহিল দেখছি ঘুম বয়।
আপু এখানে প্রচুর প্রশ্ন প্রতিটা প্রশ্নই চিন্তা করার মত।
কারন প্রথম প্রশ্নেই থমকে গেছি যে আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
মুখস্ত বলতে পারবো বাট হৃদয়কে প্রশ্ন করে উত্তরতো আগে বের করি।
কেননা এখনো জীবনের লক্ষ্য আমি ঠিক করতে পারিনি।
আমি খুব চিন্তা করি আপু।
চিন্তার পরে উত্তরতো বের করি।...............
......................
..............................
মন্তব্য করতে লগইন করুন