অন্তরে জাগাই জ্ঞানো পিপাসা......২
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৬:১১:২৮ সন্ধ্যা
শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ফিরেই বোনের সন্ধানে ছুটলো সাহিল। সাহিলের মনে আজ অনেক আনন্দ। আনন্দটা সে আপার সাথেই শেয়ার করতে চায় সবার আগে। ফিজিক্স পরীক্ষা থেকে নিয়ে শুরু করে এরপরের বাকি সব ক’টা পরীক্ষাই ভীষণ ভালো হয়েছে সাহিলের। সেদিন রাতে সাহিল রুমে যাবার কিছুক্ষণ পরই আপা ওর রুমে এসেছিল। সাহিলের হাত থেকে বই নিয়ে বন্ধ করে বলেছিল, চল আমরা বাগানে গিয়ে বসি। খোলামেলা পরিবেশে প্রশান্ত মনে দুজন মিলে আলোচনা করবো তোর পরীক্ষার পড়াগুলোকে নিয়ে। প্রায় তিন ঘন্টার মতো আলোচনা করেছিল সাহিলের সাথে রাহমা। পড়াশোনা বিষয়টা এত্তো মজার জীবনে মনেহয় সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছিল সাহিল। কিভাবে যে তিনঘন্টা পেড়িয়ে গিয়েছিল টেরই পায়নি। অথচ এমনিতে আধঘন্টা একটানা পড়লেই সাহিলের মাথা ঘুরতে থাকে। এরপরের সব কয়টা পরীক্ষার সময় আপা একই ভাবে আলোচনা করে পড়া বুঝতে সাহায্য করেছে তাকে। প্রতিটা পরীক্ষাই অনেক ভালো হয়েছে সাহিলের। তাই আজ শেষ পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বেড়িয়েই লাইব্রেরীতে ছুটেছিল। আপার জন্য অনেকগুলো বই কিনে নিয়ে এসেছে। খুব ভালো মতোই জানা আছে তার বই উপহার পেলেই আপা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়।
গত কয়েকদিনে পড়াশোনার বাইরেও অনেক ধরণের কথা হয়েছে আপার সাথে সাহিলের। একদিন কথায় কথায় আপা বলেছিল, প্রিয়জনদেরকে খুশি দিতে পারাটাও অনেক বড় একটি প্রাপ্তি জীবনের। এবং এই খুশি দেবার জন্যও দরকার পড়ে জ্ঞানের। কারণ জ্ঞানই মনে এই উপলব্ধি জাগায় যে উপহার সেটা যতই ছোট হোক না কেন দেবার পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকা উচিত। সেটা হচ্ছে প্রিয়জনকে খুশি করা, আনন্দ দেয়া সর্বোপরি তাদের প্রতি মনের ভালোলাগা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা। কিন্তু সেই খুশি ও আনন্দের উপকরণ কখনোই এমন কিছু হওয়া ঠিক না যা প্রিয়জনের জন্য কল্যাণকর বলে বিবেচিত হবে না। খুব কল্যাণকর যদি নাও বা হয় অন্তত পক্ষে অকল্যাণকর কিছু হবে না। আর এই কল্যাণ ও অকল্যাণ নির্ধারণ করতে জ্ঞান সহায়তা করে। সাহিল খুব মজা পেয়েছিল যখন আপা তাকে বলেছিল, তুই ভালো একজন মানুষ হতে চাস? একজন ভালো সন্তান, ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী স্বামী, পিতা এমনকি একজন ভালো পথচারী হতে চাস? এই সব কিছুর ওয়ানস্টপ সুপারমল হচ্ছে জ্ঞানার্জন। এই পৃথিবীতে পরশপাথর বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটি হচ্ছে সঠিক ও শুদ্ধ জ্ঞান। যা তোকে সেই মানুষে রূপান্তরিত করবে নিজেকে যেমনটা হয়তো কল্পনাও করে দেখিননি কখনো।
গত কয়েকদিন থেকে সাহিলও নিজের মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রতি তীব্র একটা আকর্ষণ অনুভব করছে। তাকে জানতে হবে, শিখতে হবে, বুঝতে হবে এমন ইচ্ছে কাজ করছে। আগে তার মনেহতো দুনিয়ার সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। প্রয়োজনীয় বিষয়ে জানলেই যথেষ্ট। কিন্তু আপার সাথে গত কয়েকদিন কথা বলে তার মনে হয়েছে সেই প্রয়োজনটা নির্ধারণ কে করবে? কেউ কি আগে থেকে বলতে পারে পরবর্তী জীবনে কখন তার কিসের দরকার পড়ে যাবে? সুতরাং, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পর্কেই অন্তত বেসিক জ্ঞানার্জন করতে হবে এই ব্যাপারে সাহিল এখন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আপার রুমের কাছে এসে দরজা খোলা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো সাহিল। বিশাল হাসি ফুটে উঠলো চেহারাতে। পৃথিবীতে পিকুলিয়ার মানুষদেরকে যদি অ্যাওয়ার্ড দেয়া হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তার আপাই সেটা পেতো। এই যেমন রুমের দরজা খোলা থাকা মানে আপা এখন ভয়াবহ রকমের ব্যস্ত। দরজা বন্ধ থাকা মানে হচ্ছে আমি ফ্রি আছে দরজা নক করে অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে পারো। এর পেছনে আপার যুক্তি হচ্ছে, বন্ধ দরজার প্রতি মানুষের একটু অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। দরজা খোলা রাখা মানে অকারণ নক এন্ড টক দুটোর সুযোগই কমিয়ে দেয়া।
কিন্তু আপাকে বই না দিয়ে সাহিলের কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বকা খাবার সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই বলল, আপা তুমি কি খুব ব্যস্ত?
প্রায় সাথে সাথেই বেড়িয়ে এলো রাহমা। হেসে বলল, না ব্যস্ত না। কাজ শেষ করে উঠা মাত্রই তুই হাজির হয়েছি।
সাহিল হেসে বলল, আমি তোমার জন্য কিছু বই নিয়ে এসেছি।
বই হাতে নিয়ে রাহমা হেসে বলল, একটি বই যুগিয়ে যায় একটু খানি উড়ার ক্ষমতা! একটি বই বাড়িয়ে দেয় এক বিন্দু জ্ঞান সাগরের গভীরতা! আর তুই সেখানে এত্তোগুলা বই নিয়ে এসেছি আমার জন্য? জাযাকাল্লাহ।
সাহিল হেসে বলল, মনে আছে তো আজ থেকে কিন্তু তুমি আমার টিচার! আমার অন্তরে জ্ঞানো পিপাসা জাগানোর টিচার!
রাহমা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই মনে আছে। ইনশাআল্লাহ আমি চেষ্টা করবো একজন আদর্শ ও ভালো টিচার হবার। এখন তুই যা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নে। আমরা পরে কথা বলবো।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রাহমাকে বাগানে বসে থাকতে দেখে দেরি না করে সাহিল হাজির হয়ে গেলো আপার কাছে। পাশে বসে হাসতে হাসতে বলল, ঠিক হয়েছে তোমার ল্যাপটপ?
রাহমা হেসে বলল, অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। দেখা যাক কি হয়। তোর কথাই ভাবছিলাম আমি। এসে ভালো করেছিস। তুই HALT পদ্ধতির নাম শুনেছিস?
নাতো! এটা কি?
রাহমা হেসে বলল, HALT পদ্ধতি বলে একটা ব্যাপার আছে। পদ্ধতিতে এইচ ফর হাংরি। এখানে এইচ হচ্ছে ক্ষুধার প্রতিচ্ছবি। খাদ্য এমন একটি জিনিস যা ছাড়া আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। খাদ্য আমরা তখন খাই যখন আমাদের ক্ষুধার অনুভূতি হয়। তবে এই পদ্ধতিতে ক্ষুধা বলতে শারিরীক না মানসিক ক্ষুধাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, তোকে জানার চেষ্টা করতে হবে যে জীবনের কোন জিনিসটির জন্য তুই মানসিক ভাবে ক্ষুধার্ত। কোন জিনিসটা তোকে মানসিক ভাবে সবল রাখতে খাদ্যের ভূমিকা পালন করছে।
সাহিল হেসে বলল, শুনতেই তো কেমন জানি মজা লাগছে। তবে এখনই জবাব দিতে পারবো না আপা। আগে ভাবতে হবে আমাকে।
অবশ্যই খুব ভালো মতো ভেবে তবেই জবাব দিবি। এরপর হচ্ছে, এ। এ ফর অ্যাংরি। রাগ এমন একটি আবেগ যা আমাদের মানসিক শক্তিকে প্রচন্ড রকম ক্ষতিগ্রস্ত করে। বলা হয় যে রাগ দমন করা ছাড়া কারো পক্ষে আত্মিক সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্মেই রাগের ধ্বংসাত্মক দিক সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আমাদের রাসূল(সঃ) বলেছেন, “ রাগান্বিত হয়ো না, যে ব্যক্তি রাগকে সংবরণ করতে পারে সেই প্রকৃত বীর। বুদ্ধদেব বলেছেন, “ রণক্ষেত্রে সহস্র যোদ্ধার উপর বিজয়ীর চেয়ে রাগ-ক্রোধ বিজয়ী বা আত্মজয়ী বীরই বীরশ্রেষ্ঠ।”বেদে আছে, “জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত রাগ-ক্রোধ থেকে দূরে থাকো। যিশুখ্রীস্ট বলেছেন, “ যখন কেউ তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। সদাপ্রভু তোমাকে ক্ষমা করবেন।” রাগের কারণে আমরা নিজেই নিজের মধ্যে গুম হয়ে থাকি। অনেক সময় অন্যের উপর রাগ দেখাতে না পেরে বিভিন্ন ভাবে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করি। তাই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার পন্থা তোকে খুঁজে বের করতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ আমার এমনিতেই রাগ কম। তবে এটা ঠিক বলেছো আপা রাগের কারণেও অনেক সময় নষ্ট হয়। আর মেজাজ গরম থাকলে পড়াশোনা তো হয়ই না।
হুমম... যাইহোক, এরপর হচ্ছে এল। এল হচ্ছে একাকীত্বের প্রতীক। এখানে দুটা বিষয় আনা যায়। এক. একাকীত্বকে তুই কিভাবে উপভোগ করিস। দুই. একাকীত্বকে দূর করার জন্য তুই কি কি করিস।
দুইটা প্রশ্নের জবাব কি একই হবে না আপা?
রাহমা হেসে বলল, না একই হবে না। আচ্ছা তোকে উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। আমাদের মনটা এত অদ্ভুত একটা জিনিস যে অনেকসময় হাজারো মানুষের ভিড়েও নিজেকে ঘিরে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না। মানে সব থাকতেও হঠাৎ কেউ নাই, কিছু নেই এমন একটা উপলব্ধি ঘিরে ধরা। আমার সাথে যখনই এমন হয় আমি তখন কবি হয়ে যাই। জানি না কোত্থেকে জানি দলে দলে ছন্দরা হাজির হয়। আবার দু’ একদিন শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে সুবিশাল ভাবনার জগতে ডানা মেলে অবাধ বিচরণ করি হঠাৎ ঘিরে ধরা একাকীত্বের মুহূর্তগুলোতে। এবার হচ্ছে একাকীত্ব দূর করার জন্য আমি কি কি করি। বই পড়ি, বাগান করি, প্রিয়জনদের সাথে গল্প করি। ইত্যাদি।
সাহিল হেসে বলল, হ্যা এবার বুঝতে পেরেছি আমি।
শেষ অক্ষরটি হচ্ছে টি। টায়ার্ড অর্থাৎ, ক্লান্তি। তোকে জানতে হবে কোন বিষয়গুলো তোকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত করে তোলে। এবং সেই ক্লান্তি দূর করার সম্ভাব্য পন্থাগুলোও তোকে খুঁজে বের করতে হবে। যাতে ক্লান্তিভাবের কারণে তোর জীবন থেকে মূল্যবান সময় হারিয়ে না যায়। এই পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগে আত্মোন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ অনেকখানিক সুগম হয়। তুই আজ খুব ভালো করে এই চারটি বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কর। আগামীকাল আমরা আবার এই বিষয়ের উপর কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। এখন যা আমার জন্য এক মগ কফি নিয়ে আয়। নিজে হাতে বানিয়ে আনবি।
সাহিল বিশাল হাসি দিয়ে বলল, ব্ল্যাক এন্ড নো সুগার তাই না?
রাহমা হেসে বলল, তোর যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই বানিয়ে নিয়ে আয়।
সাহিল তখন মনের আনন্দে বোনের জন্য কফি আনতে রওনা দিলো।
বিষয়: বিবিধ
১৯০৩ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরে Comment!
আপনার কমেন্টস দেখলে আমাদের বিদ্যালো ১ এর কথা মনে পরে।
তিনাকে দেখিনা অনেকদিন
অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
লেয়ার পুডিং দেয়া হলো...
অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
সুন্দর দেখে একটা ফাস্টু আম্মিইইআম্মিইই
অনুভূতিগুলো অনুরণিত হচ্ছে!
দরদময় ভংগিতে সাবলীল উপস্হাপনা পাঠক কর আগ্রহী করেছে বিষয়ের গভীরে যেতে!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকিল্লাহু খাইরান!!
ঐকমত্য মন্তব্যের রাজার সাথে।
তবে রাহমা আপু পিকলু শুনে খুব ভালো লাগ্লো
একাকীত্বকে তো ঘুমিয়ে উপভোগ করি আপু
এটা সাহিল বললে খুব ভালো লাগবে।
আমি চান্স পেলেই ঘুমাই।
ঘুমাতে ঘুমাতেই টাইম একাকিত্ব খাওয়া দাওয়া সব দুর হয়ে যায়।
আপু HALT সিস্টেমটা ডিটেইলস একটু বললে খুব ভালো হবে তাই প্লীজ একটু ডিটেইলস বলবেন খুব সংক্ষিপ্ত লাগছে।
যাই আমিও আপুর জন্য কফি বানাতে যাই আর আপুও এ ফাঁকে পড়ের পর্বটি লিখে শেষ করুন
খুউব খুউব শুকরিয়া আপু
ইনশাআল্লাহ আরেকটূ ডিটেইল বলার চেষ্টা করবো। পরের পর্ব লিখে শেষ করেছি। অনেক অনেক দোয়া রইলো আওণের জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন