ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-২

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:৫০:৫৬ দুপুর



কাজ শেষে ফাইল বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো রিসাব। হাতে এখনো আধঘন্টা সময় আছে নিজেকে ফিটফাট করে নেবার জন্য। অফিসে এসে পকেট থেকে সেলফোন বের করার সময় সাথে বেড়িয়ে এলো একটা চিরকুট। খুলে দেখে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, ‘সুর্যাস্তের আগে আমাদের প্রিয় জায়গাটাতে চলে আসবেন। আজ আমাদের ফাস্ট ডেটিং তাই সুর্য যেন ডুবে না যায়। যদি যায়......!!!’ যদি যায় এর পরে থ্রেট স্বরূপ হাতুড়ি হাতে রাগন্ত কার্টুনের স্টিকার দেখে অনেকক্ষণ হেসেছে রিসাব। পকেট থেকে চিরকুটটি বের করে আরেকবার হাসলো। নানা ধরণের ইমোশন প্রকাশের জন্য কার্টুনের স্টিকার ব্যবহার করে রিনিলা সবসময়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন আবদার যুক্ত একটা চিরকুট রেখে দেয় পকেটে। তবে একটা জিনিস সবসময় লক্ষ করেছে রিসাব, রিনিলা কখনোই এমন কোন আবদার করে না যা পূরণ করতে সামান্যতম সমস্যায় পড়তে হবে তাকে। খুবই হিসেবী আর সাবধানী এই মেয়েটির কর্মকান্ডগুলো বিয়ের প্রথম প্রথম অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও এখন বেশ এনজয় করে সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রিনিলার চেহারাটা মনের আয়নায় আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে। যদিও জানে চোখ বন্ধ করলেই বধূ বেশে বসে থাকা একটি মেয়ের ছবিই ভেসে উঠবে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে ভেবে যে বিয়ের তিন মাস পরেও কেন রিনিলার প্রথম দিনের চেহারাটাই স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে তার মনের আয়নায়।

বাসর ঘরেই প্রথম একান্তে কথা হয়েছিলো রিনিলার সাথে। কি বলবে যখন ভাবছিল, তখন নববধূর কণ্ঠে সালাম শুনে বেশ অবাক হয়েই তার দিকে তাকিয়েছিল রিসাব। কিছু কিছু মুহুর্ত মনেহয় মনের ক্যামেরাতে স্থির চিত্র হয়ে বন্দী হয়ে যায় সারা জীবনের মতো। ঠিক তেমনি মনের ডায়েরীতে মুগ্ধতার ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে ভালোলাগার আবেশ জড়ানো কিছু কথা। রিনিলার প্রথমদিনের কথাগুলোও ঠিক তেমন। মৃদু কণ্ঠে বলেছিলো, রিসাব আমার মাঝে অনেক দোষ-ত্রুটি-ঘাতটি আছে, আপনি নিজের দোষ-ত্রুটি-ঘাতটিগুলো যেমন গর্ব নিয়ে বাইরে প্রচার করেন না বরং সেগুলোকে সঙ্গোপনে সংশোধন করার চেষ্টা করেন। দয়াকরে আমার ক্ষেত্রেও তেমনটি করবেন। সু-অভিভাবকের মত আমাকে সাহায্য করবেন যাতে আমি আমার দোষ-ত্রুটি-ঘাতটিগুলো পূরণ করে নিতে পারি। আমি এসব বলছি কারণ, আমাদের বেড়ে উঠার পরিবেশটাই এমন যে, আমরা স্বতঃস্ফ্রুতভাবে কাউকে সাহায্য করা, ভালোবাসা, নিজের ভুল মেনে নেয়া, অন্যেকে ক্ষমা করা বা আপন করে নেয়া শিখি না। যার ফলে আমাদেরকে এসবের অভিনয় করতে হয়। এটা পারবো না, ওটা আমি জীবনে কোনদিনও করিনি, আমাদের বাসায় এভাবে রান্না হয়না ইত্যাদি নেতিবাচক চিন্তার দ্বারা আমরা নিজেরাই নিজেদের চেষ্টা করার ইচ্ছেটার শ্বাসরোধ করি, আর বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে শ্বাস নিতে পারছি না সেই দোষ গিয়ে পরে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষগুলোর উপর। অথচ নতুন পরিবেশের সবকিছু আমার পছন্দ মত, মনের মত হবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই এসব ইস্যু তৈরি করে আমি আমার জীবনকে জটিল করতে চাই না। বরং নিজেকে সুখী করার লক্ষ্যে আমি মিনিটে ষাট সেকেন্ড গতিতে ছুটতে চাই।

রিনিলাকে রিসাবের হাতে তুলে দেবার সময় শ্বশুর সাহেব হাসিমুখে বলেছিলেন, বাবা আমার এই পাগলী মাটা কিন্তু বইয়ের ভুবনে ডুবে থাকা এক বইকন্যা। কিন্তু রিসাবের ধারণা, চুপি চুপি এসে দুচোখে স্বপ্ন সাজিয়ে, মনকে আশা-ভালোবাসা দিয়ে ভরে দেয় এমন এক স্বপ্নকন্যা রিনিলা। একদম প্রথম দিন থেকেই লক্ষ করেছে রিনিলা সবসময় চেষ্টা করে ওর সাধ্য অনুযায়ী সবাইকে সাহায্য করতে। কাউকে সাহায্য করার জন্য যে খুব বেশি কিছুর দরকার পরে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, এই উপলব্ধিটা রিনিলা নতুন করে বুঝিয়ে দিয়েছে ওর কাজের দ্বারা। একটু আশার বাণী, উৎসাহমূলক কিছু কথা, কষ্টের সময় একটু পাশে থেকে ভরসা দেয়া, বিপদে পড়লে সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করা... কতোই না সহজ এই কাজগুলো অথচ তারপরও মানুষের কতো কৃপণতা এসবের প্রতি। তার নিজের মাঝেও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল এই কৃপণতা। যেমন, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কয়েকজনকে অপছন্দ করতো বলে এড়িয়ে চলতো সবসময়। সেটা খেয়াল করে রিনিলা বলেছিল, দোষ-গুণ, ভালো-মন্দ নিয়েই তো একজন মানুষ। দোষের কারণে একজন মানুষকে ঘৃণা করা বা দূরে সরিয়ে দেয়া ঠিক না। বরং, তার দোষকে মেনে নিয়ে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং তাকে এরথেকে বের হতে সাহায্য করতে হবে। তাহলে আর নীরব ক্ষোভ অন্তরে হুতাশন তৈরি করবে না। সেদিন আরেকবার মুগ্ধ হয়েছিলো রিসাব রিনিলার কথা শুনে। মনেমনে প্রার্থনা করেছিলো, তার দ্বারা যেন কখনোই এমন কিছু না ঘটে যাতে অসাধারণ এই মেয়েটির মনে কষ্টের একবিন্দু মেঘ তৈরি হবার সুযোগ পায়।

রিসাবের হঠাৎ মনেহলো যে সংসার জীবনকে নিয়ে মানুষের ভাবাবেগ কত না বিচিত্র! একদিকে আশা-আনন্দ-স্বপ্ন-ভালোবাসা অন্যদিকে ভয়-বিষাদ আর উৎকণ্ঠা। দুই বিপরীত মেরুর দ্বন্দ্ব প্রতিমুহূর্তে-প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে অবিরত। এমতবস্থায় সুখী হবার তীব্র ইচ্ছেটাই কি মানুষকে সুখী করে না? রিনিলাকে দেখে অন্তত তাই মনেহয়েছে রিসাবের। নিজে ভালো থাকার জন্য যে অন্যকে ভালো রাখতে হয়, এটা বেশির ভাগ মানুষই বোঝে না। দুজন মানুষের জীবন একে অপরের সাথে জুড়ে যাবার পর তাদের মধ্যে নানা ধরণের প্রত্যাশার তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার প্রত্যাশা কতোখানি পূরণ হচ্ছে ভাবার সাথে সাথে যদি, আমি আমার সঙ্গীর প্রত্যাশা কতখানিক পূরণ করতে পারছি ভাবা যায়, তাহলেই সংসারের ভারসাম্যটা নড়বড়ে হয় না। গত তিনমাসের স্মৃতির সমুদ্রে নামলে রিনিলার সুখী হবার ও সুখী করার তীব্র ইচ্ছার ঢেউকেই ছুটে আসতে দেখে তার দিকে। মনেমনে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করলো আরেকবার রিসাব। প্রার্থনা করলো যেন আনন্দময় এই মুহুর্তগুলোকে সারাজীবন জমা করে রাখতে পারে স্মৃতির ভাণ্ডারে। এদেরকে নাগালের ভেতর রেখে যত ঘনঘন দেখবে ততই জোরালো হবে অনুভূতিগুলো। আর একই আনন্দের বারংবার উপভোগ জীবনের প্রাপ্তিগুলোকে বাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।

কবিতার লাইন মনে পড়লো হঠাৎ- “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।” রিসাবের মনে হলো তার অবস্থা ঠিক এর উল্টো। অর্থাৎ-“না উড়াইয়াই ছাই পাইয়াছি অমূল্য রতন, এইবার তাহার করিতে হইবে যথাযথ যতন।”

চলবে...........(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

১৩৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File