ভাবনা যখন সুর তুলে যায় জীবন বীণার তন্ত্রীতে-১

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৫৬:২৫ বিকাল



বিয়ের পর থেকে রিনিলার সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর একটা হচ্ছে ঘর গুছানো। এর কারণ অবশ্য এটা নয় যে সে খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে, কারণ হচ্ছে, ওর স্বামী রিসাব খুব বেশি গোছানো স্বভাবের ছেলে। রিসাব পছন্দ করে এমন সব কাজ করতে ভীষণ ভালো লাগে তার। ছোট ননদ সারাক্ষণ হাসে আর বলে, ভাবী ভাইয়া তো তোমাকে গৃহপালিত বধূ বানিয়ে ফেলেছে তিনমাসেই। আশ্চর্য! দেখতে দেখতে সংসার জীবনের বয়স তিনমাস হয়ে গেলো। যদিও রিসাবকে ছাড়াও যে একটা জীবন ছিল সেটা ভাবতেই এখন আর ইচ্ছে করে না রিনিলার। ভাগ্যিস মানুষের মনের ভাবনাগুলো বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারেনা। তা না হলে ছোট ননদের দুষ্টুমির যন্ত্রণায় নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যেত। আর রিসাবের সামনে যেতেও তো আরো বেশি লজ্জা লাগতো। স্বামীর ঠোঁট চেপে হাসির কথা মনে হতেই মনেমনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো আরেকবার মনকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখার জন্য। রিনিলার উপলব্ধি বলে যে ভালোবাসা অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে, তবে অতিরিক্ত প্রকাশ না করাই উত্তম। কারণ মানুষ যাকে খুব বেশি ভালোবাসে, তার হাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়। আর দুঃখ হলো বেশির ভাগ মানুষই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তাই একাত্মতার মাঝেও কিছুটা ফাঁক রাখা উচিত। যাতে সম্পর্কের মাঝে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ঘাটতি না হয়।

কাজ শেষ করে চায়ের মগ নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো রিনিলা। সুর্যের আলোতে ঝিকমিক করে নানা রঙয়ের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে ফুলের গাছগুলো। কোন রঙয়ের পাশে কোন রঙের ফুলের গাছ রাখলে বেশি মানাবে সেটা নিয়েও যে কত গবেষণা করেছে রিসাব ভেবে হাসি পেলো রিনিলার। রিসাবের চিন্তা-ভাবনাগুলো কেমন যেন একটু অদ্ভুত ধরণের। গতরাতে একটা প্রসঙ্গে বলছিলো, আমার ভেতর উদার এক টুকরো সদা স্বচ্ছ আকাশ আছে। মনের ইচ্ছে মতো সেখানে তুমি যেভাবে ইচ্ছে ভেসে বেড়াতে পারো। কারণ সে আকাশের ভাসন্ত মেঘের খেলা-বৃষ্টি-রংধনু-জোছনা সব আয়োজন শুধু তোমার হাসি-আনন্দ-খুশির জন্য। ঠিক তেমনি আমার ভেতর আছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দৃঢ় এক হিমালয়। যাকে জয় করতে তোমাকে অভিযাত্রী হতে হবে। বাঁধা-বিপত্তি আর কন্টকাকীর্ন সেই পথে চলতে অনেক ধৈর্য্য আর সাহসের প্রয়োজন পড়বে তোমার। কারণ পথের মাঝে অসংখ্য খাঁদা-খন্দ আছে, মাঝে মাঝেই পাথর গড়িয়ে আসবে তোমার পথ রুদ্ধ করতে। জানো তো নিশ্চয়ই অভিযাত্রীদেরকে সেসব এড়িয়ে, সরিয়েই সামনে এগোতে হয়। স্বচ্ছ আকাশে মুক্ত মনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে কেউই সাধারণত আপত্তি করে না। তাই আমি শুধু জানতে চাই, তুমি অভিযাত্রী হতে রাজী আছো কি? গতরাতে অবশ্য জবাব দেয়নি রিনিলা শুধু হেসেছে। তবে জবাব যে হ্যা সেটা রিসাবও নিশ্চয়ই জানে।

পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষই অন্যের দোষ ধরতে খুব বেশি পটু। কারণ আমাদের বেড়ে উঠার পরিবেশটার মধ্যে গুনবিচারী স্বভাবটা প্রায় অনুপস্থিত, আর ভীষণ ভাবে উপস্থিত হচ্ছে দোষ অনুসন্ধানী স্বভাব। শত গুণের ভীড়েও ছোট্ট একটু দোষ কেউ মাফ করতে রাজী থাকেন না, বরং চোখে আঙ্গুল দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তা দেখিয়ে দেয়। পরবর্তিতে আমরা নিজেরাও তেমন হয়ে যাই। অন্যের দোষ অনুসন্ধানী। কিন্তু রিসাব সম্পুর্ন এর বিপরীত স্বভাবের মানুষ। সে বলে, একটা জিনিস একজনের খুব পছন্দের আর অন্যজনের খুব অপছন্দের হতেই পারে। তাই কখনোই উচিত না নিজের ধারনাটাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। তবে হ্যাঁ যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলা যায় কেন জিনিসটা অপছন্দ বা কেন পছন্দ করা ঠিক নয়। কিন্তু কখনোই দোষ হিসেবে বলা উচিত নয়। রিসাবের সবকিছুতেই এই সূক্ষ্ম ফাঁক রেখে চলাটা খুব বেশি ভালো লাগে রিনিলার। কাহলিল জিব্রানের কবিতার লাইন মনেপরে যায় -“ নাচ-গাও-আনন্দ করো একই সাথে কিন্তু ধরে রেখো তোমাদের স্বকীয়তা, যেমনি করে বীণার তন্ত্রীগুলো আলাদা থেকেও বেজে ওঠে একই সুরের মুর্ছনায়।”

গততিন মাসের অভিজ্ঞতা থেকে রিনিলার মনে হয়েছে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে কোন বিষয়ে জোর না করে যদি করণীয় যতটা সম্ভব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে, তাহলেই মতের অমিল, অপছন্দের অমিল, সমস্যা-বাঁধা ইত্যাদি সবকিছু থাকার পরও অনেক সুখী হতে পারে জীবনে। জীবন মানেই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নানা বিচিত্রতায় ভরা। আনন্দের বারিধারার সাথে সাথে বেদনার শিলাবৃষ্টিও হাজির হয় সময়ের হাত ধরে। শিলাবৃষ্টি কাম্য নয় তবুও ঝরে.....দিয়ে যায় কিছু ক্ষত! সেই ক্ষতের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাশ করার চেয়ে, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার পক্ষপাতী রিসাব। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সমস্ত শক্তির আধার যিনি তাকে ঘিরেই যদি সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আবর্তিত হয়, তাহলে জীবনীশক্তি অপব্যবহারের আশংকা অনেক কমে যায়। রিসাব চেতনাতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলেই হয়তো জীবনের প্রতিটি রঙ, প্রতিটি রূপ, প্রতিটি পরিবর্তনকে খুব সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারে।

আসলে প্রতিটা মানুষ চিন্তা করে তার নিজস্ব জ্ঞানের আলোকে। রিসাব এতো উদার, সচেতন, দায়িত্বশীল ওর ভেতরে থাকা জ্ঞানের কারণে। জ্ঞানার্জনের সাথে যে অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা নিজেকে আলোকিতও করতে হয় একথা অনেকেই ভুলে যায়, কিন্তু রিসাব ভোলেনি। নতুন ভাবনা জেগে উঠলো রিনিলার মনে। নিজেই নিজেকে বলল, বেশি বেশি জ্ঞানার্জন করে সেই আলোতে নিজেকে আলোকিত করো। তাহলে আর অন্যের কাছে সুখী হবার টিপস চাইতে হবে না, বরং তোমার জ্ঞানের আলোতে অন্যেকে পথ দেখাতে পারবে।

চলবে.........(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

২৭১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File