করি পুষ্প রে বিকশিত-৩
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৪ মার্চ, ২০১৪, ০৮:১৬:৫৩ রাত
নাস্তা করতে এসে টেবিলে পিজা দেখে বিশাল হাসি ফুটে উঠলো মুসআবের চেহারাতে। ছুটে এসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো। নায়লাও আদর করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আসফিন ও মাশফিয়ারও পিজা অনেক পছন্দ। দেরি না করে তিনজনই তাই বসে গেলো নাস্তা করতে। তাড়াহুড়া করে গরম পিজাতেই কামড় বসিয়ে দিলো মুসআব। সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠলো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, খুব জ্বালা করছে মুখ। মনেহয় আমার জিভ পুড়ে গিয়েছে।
আসফিন আনন্দিত কণ্ঠে বলল, মুসআব ভাইয়া মামীর কাছে কথা গোপন করে তুমি যে দুষ্টু কাজ করেছিলে সেটা আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ বলো।
কেন এমন করো বাবা? জানোই তো যে অনেক গরম! বলতে বলতে ছেলের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো নায়লা কিন্তু আসফিনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। হাসি চেপে একরাশ কৌতুক ভরা চোখে অন্তরাও তাকালো ছেলের দিকে।
মাশফিয়া বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আসফিন তুমি সবসময় শুধু বেশি কথা বলো। ভাইয়ার জিভ পুড়ে গিয়েছে আর তুমি বলছো আল্লাহ দুষ্টু কাজ মাফ করে দিয়েছেন। আর দিলেও তুমি কিভাবে জানো? ছোট্ট বয়সে বাচ্চারা অ্যাঞ্জেল থাকে। তুমি এখন আর অ্যাঞ্জেল নাই। তুমি হচ্ছো মহা পাজী।
আসফিন নিজের স্বপক্ষে প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, আপ্পি আমি সত্যি বলছি। তুমি আম্মুতাকে জিজ্ঞেস করো। আমি মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বেঁধে গিয়েছিল। আমি অনেক কান্না করছিলাম। আম্মুতা তখন আমাকে বলেছিল, “রাসূল(সঃ বলেছেন, মুসলিমদের যে কোন অসুখ, মনখারাপ, এমনকি কাঁটা বিধলেও সে কারনে আল্লাহ্ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” আমি তখন আর কান্না করিনি। পরে ডক্টর আঙ্কেল আমার কাঁটা বের করে দিয়েছিলেন। ঠিক বলেছি না আম্মুতা?
অন্তরা হেসে বলল, হ্যা বাবা তুমি একদম ঠিক বলেছো। আচ্ছা এখন তোমরা খেয়ে চাপ চুপচাপ। পরে তোমাদের সবাইকে বুঝিয়ে বলবো এই বিষয়ে, ইনশাআল্লাহ। এখনো অনেক গরম তাই আস্তে আস্তে সাবধানে খাও।
নাস্তা করা শেষ হলে বাচ্চাদেরকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে বের হলো অন্তরা আর নায়লা। বাচ্চাদেরকে খেলা করতে বলে দুজন এক পাশে গিয়ে বসলো। ছুটোছুটি করে খেলতে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে নায়লা হেসে বলল, যখনই বাচ্চাদেরকে নিয়ে পার্কে আসি খুব ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে জানো? নিজের ছোটবেলাটাকে তখন খুব মনে পড়ে। কত ধরণের খেলা খেলেছি আমরা। আর আমাদের বাচ্চারা খেলা বলতে বোঝে নানা ধরণের ইলেক্ট্রনিক্স গেমস। যান্ত্রিকতা বাচ্চাদের মধ্যে আনন্দ, উচ্ছ্বাসকে কেমন যেন হ্রাস করে দিচ্ছে দিনকে দিন, তাই না?
অন্তরা বলল, বাচ্চাদের মধ্যে যাতে আনন্দ, উচ্ছ্বাস অক্ষুণ্ণ থাকে সেই দায়িত্ব বাবা-মাকেই পালন করতে হয়। আর তুমি যেভাবে ওদেরকে বড় করছো তা কিন্তু মুগ্ধ হবার মত। তুমি তোমার সবটা সময় বাচ্চাদের পিছনেই ব্যয় করো। আমি তো যখনই তোমাকে দেখি অনুভব করি আসফিনকে আরো সময় দেয়া প্রয়োজন আমার।
এত ব্যস্ততার পরও তুমি ছেলেকে অনেক সুন্দর ভাবে বড় করেছো। অবশ্য তোমার আসফিন তো এমনিতেই সবকিছু বোঝে। যে সুন্দর করে যুক্তি দেয়, মাশাআল্লাহ। আমার গুলোর মত হলে পাগল হয়ে যেতে।
অন্তরা হেসে বলল, আসফিনের কর্মকান্ড তুমি দেখো না তাই এভাবে ভাবছো। মাছের কাঁটার কথাই ধরো। ওর কান্না বন্ধ করার জন্য আমি হাদিসটা বলেছিলাম। সাথে সাথে কাজও হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর আসফিন ইচ্ছে করে মাছের কাঁটা গলায় বাঁধিয়েছিল গোনাহ মাফ হবে সেজন্য। শুধু তাই না বাগানে গিয়ে গায়ে গোলাপের কাঁটার খোঁচা লাগাতো, ক্যাকটাসের খোঁচা লাগাতো। এরপর যখন বুঝিয়ে বললাম যে, নিজেই নিজেকে কষ্ট দিলে আল্লাহ গোনাহ তো মাফ করবেনই না উল্টো তোমার উপর আরো বিরক্ত হবেন, তখন গিয়ে এসব বন্ধ করেছে।
নায়লা হাসতে হাসতে বলল, আমি তো আরো মনেকরি আসফিন তোমাকে একদম যন্ত্রণা করে না। যা বলো সবই বুঝে নিতে দেখি তো আসফিনকে।
হেসে, এমনিতে তো আর সব বোঝে না ভাবী। সারাটা ক্ষণ কিভাবে প্রশ্ন করতে থাকে সেটা তো দেখোই। যদিও বাচ্চাদের প্রশ্ন করার স্বভাবটা খুবই ভালো। এতে ওদের মনে কি ভাবনা চিন্তা চলছে সেটা জানা যায়। বুঝিয়ে বলে দেয়া সম্ভব হয় সবকিছু। আমি আসলে কখনোই আসফিনকে প্রশ্ন করতে বাঁধা দেইনি। বরং সবসময় চেষ্টা করেছি ওর প্রতিটা প্রশ্নের জবাব যুক্তির সাথে বুঝিয়ে বলতে। এভাবেই ধীরে ধীরে আসফিনও যুক্তির পথে চলতে শিখে নিয়েছে। আর আমি কখনোই কোন কিছু করার কারণ হিসেবে বাবা বা আম্মুতা খুশি হবে এমনটা বলিনি আসফিনকে। বরং সবসময় বলেছি আল্লাহ খুশি হবেন কিংবা আল্লাহ নারাজ হবেন। নিজের গড়ে উঠার পরিবেশ থেকে আমি এটাই জেনেছি ও বুঝেছি যে, এই জান্নাতি পাখী গুলোকে ফুলের কলি রূপে আল্লাহ আমাদের কাছে পাঠান। আর এই কলিরা যথাযথ কেবল মাত্র তখনই বিকশিত হতে পারে যখন ওদের ভিত্তি হয় ইসলামের মূল স্তম্ভ সমূহ।
কিন্তু এত ছোট বয়সে ইসলাম বুঝিয়ে বলা তো সম্ভব নয় বাচ্চাদেরকে।
ইসলাম করে দেখানো তো সম্ভব, তাই না? আমি তো আসফিনকে বলার চেয়ে করে দেখাতেই বেশি চেষ্টা করি। আমার এখনো মনেআছে ছোটবেলায় আমাদেরকে ঘুম থেকে ডাকার জন্য বাবা বা মামণি যেই আসতেন, শুভসকাল বলার আগে সালাম দিতেন। একটা সময় আমাদেরও ঘুম থেকে উঠে সবার আগে একে অন্যেকে সালাম দেয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। খাবার শুরু আগে বিসমিল্লাহ, খাবার শেষে আলহামদুলিল্লাহ, কোন কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করার সময়, ইনশাআল্লাহ, কারো প্রশংসা করার সময় মাশাআল্লাহ, ইত্যাদি আমরা বাবা-মামণিকে বলতে দেখেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম। যখন আরেকটু বড় হলাম সব কাজ শুরুর ও শেষের দোয়াও একই ভাবে বাবা-মামণি আমাদেরকে শিখিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা টেরও পাইনি যে আমরা শরীয়তের গন্ডির মধ্যে বড় হচ্ছি। কারণ কোন কিছুই চাপিয়ে দেয়া হয়নি আমাদের উপর। বরং কৌশলে অভ্যাসে পরিনত করে দেয়া হয়েছে। আমিও এমনটাই করার চেষ্টা করেছি এবং করি আসফিনের সাথে। সবকিছু অভ্যাস করানোর পর যখন ওকে বলবো ইসলাম তোমাকে এসব করতে বলছে। এবং আসফিন দেখবে যে ইতিমধ্যেই এসব সে করে। তখন ইসলামকে মেনে চলা মোটেই কঠিন মনে হবে না ওর কাছে, ইনশাআল্লাহ।
নায়লা হেসে বলল, তোমাদের ছোটবেলার কথা শুনলে আসলেই খুব ঈর্ষা হয় মাঝে মাঝে। আমাদের বাবা-মা আমাদেরকে এভাবে বড় করেননি।
আসলে বাবা-মার সাথে যদি বাচ্চাদের খুব সুন্দর একটা সহজ সরল বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক থাকে। খুব আন্তরিক একটা ভালোবাসা মেশানো শ্রদ্ধাবোধ যদি বাবা-মায়েরা সন্তানদের মনে জন্ম দিতে পারেন তাহলে বাচ্চাদের গড়ে তোলাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। তবে এটি কেবল মাত্র তখনই সম্ভব যখন আমরা বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের সঠিক জীবনবোধ দিতে পারেন। বাচ্চাদেরকে জাগ্রত বিবেকের আলোয় আলোকিত পথে চলতে শেখায়। আমি মনেকরি বাচ্চাদেরকে যদি শুধু একটি বাক্য অর্থসহ শেখানো যায় তাহলেই তারা সমস্ত বৈরিতা তুচ্ছ করে নিজ প্রবৃত্তিকে জয় করতে পারে। “তুমি মুসলিম” এই একটি বাক্যের প্রকৃত উপলব্ধিই যথেস্ট যে কোন মানুষকে সমস্ত দীনতা-হীনতা, স্বার্থপরতা, অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখার জন্য। কেননা ইসলাম সেই ধর্ম যার মধ্যে শুধু আছে কল্যাণময়তা। আর ইসলাম তথা শরীয়তের পুর্ন জ্ঞান হচ্ছে মানুষের রক্ষা কবজ।আর বাচ্চাদের মনে এই জ্ঞান ঢোকানো কোন কঠিন কিছুনা। বাচ্চাদের মন হচ্ছে পানির মতো। যে পাত্রে রাখা হবে তারই আকার ধারণ করবে। এটা আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা সঠিক পাত্রের সন্ধান আমাদের সন্তানদেরকে দিতে পারি না।
অন্তরার কথাগুলো ভাবনার গভীর জগতে নিয়ে গেলো নায়লাকে। এক দৃষ্টিতে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে নিজের করণীয় কি সেটাই ভাবতে লাগলো।
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৩ বার পঠিত, ৪০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল্লাগসে এরকম লেখা আরো চাই
অনেক অনেক শুকরিয়া আপনাকে। শুভকামনা রইলো।
আপনার সন্তানরা মারামারি করেনা ??
চোখ লালটুকটুক
মারামারি করার চেয়ে তর্ক-বিতর্ক বেশি করে আমাদের বাচ্চারা। সবাই তার্কিক আর যুক্তিবাদী। ইচ্ছে আছে যুক্তিবাদী বাচ্চাদেরকে নিয়ে একটা সিরিজ লিখার, ইনশাআল্লাহ।
@ আওণ, আপনারা ছোটবেলায় এত দুষ্টুমি করেছেন যে, এই জেনারেশনের বাচ্চাদের ভাগে আর কিছুই রাখেননি।
বাচ্চারা সেভাবেই গড়ে উঠে। ভালো লাগলো আপনার ফুল,কলিদের কথাগুলো
...............
ধন্যবাদ।
এরা কি গাছের গোড়ায় দুধ ঢালে??
আপনার জন্য সূর্যোদয়ের ছবি।
সত্যি নয়ন জুড়ানো ছবি।
চমৎকার অনেক ধন্যবাদ। আপু।
সত্যি নয়ন জুড়ানো ছবি।
চমৎকার অনেক ধন্যবাদ। আপু।
আবার অতীত অভিজ্ঞতা এটাও বলে কোন গল্প আঁটকে গেলে তৃতীয় পর্বের পরেই আটকায়।
তাহলেই ভালো, গল্পটা পড়ার জন্য আসি আপনার ব্লগে। আফরোজা আপু।
মন্তব্য করতে লগইন করুন