ধূসর গোধূলি বেলা......৩
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৫:৫১:২৭ বিকাল
সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হল রুশানের। প্রায় একঘন্টা আগে জাহিদ ও ইমরান এসে শাফাতকে দিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ তো কথাই বলতে পারেনি শাফাত। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে ছিল। বিধ্বস্ত চেহারা দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিন যাপন করছে ছেলেটি। মানসিক অসহায়ত্ব চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। কোন প্রশ্নের জবাবই গুছিয়ে দিতে পারছিল না। এর আরেকটি কারণ হয়তো এটা যে, রুশান শাফাতের পূর্ব পরিচিত। মানুষ নিজের সমস্যা বা ভুলের কথা পরিচিত কারো চাইতে, একজন অপরিচিতকে অনেক সহজে বলতে পারে। কারণ ব্যক্তির সম্পর্কে ধারণা থাকার কারণে পরিচিত মানুষেরা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রতিটা কথাকে যাচাই করে দেখতে ও সেই মতো পরামর্শ দিতে চেষ্টা করে। যা একজন সমস্যাগ্রস্ত মানুষের কাম্য থাকে না। সমস্যাক্রান্ত মানুষেরা কথা বলার জন্য এমন কাউকে খোঁজে যে বাঁধাহীন ভাবে তার কথা শুনবে এবং নিরপেক্ষ সমাধান দেবে।
শাফাতের এলোমেলো কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো রুশান। কিভাবে বন্ধুদের সাহচর্যে ধীরে ধীরে নেশার জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, তার নেশার করার কথা জানতে পেরে মা স্ট্রোক করলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিভাবে নিজেকে বের করে এনেছে অন্ধকার থেকে, পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য বিভিন্ন আচরণ ও কথার দ্বারা কিভাবে প্রতিনিয়ত তাকে ভুলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সবকিছু খুলে বললো শাফাত। পরিবারের কাছের মানুষদের এমন নেতিবাচক আচরণ ভেতরে ভেতরে একদম নিঃশেষ করে দিচ্ছে শাফাতকে। দু’এক সময় মনেহয় কি হবে ভালো হয়ে? কেউ তো চায় না সে ভালো হোক। শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে এখনো নিজের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। চাচাতো বোন তানিয়ার সাথে তিন বছর আগে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করাছিল তাই মেলামেশাতে তেমন কোন বাঁধা ছিল না দু’জনের। সেই সম্পর্কটার ভবিষ্যৎও এখন অনিশ্চিত। সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে পারছে না তার করণীয় কি!
কিছুটা সময় নীরবতার পর রুশান বলল, মানুষের চরিত্রের স্বাভাবিক কিছু প্রবণতা আছে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা হচ্ছে, মানুষ প্রয়োজনের চাইতে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী, কারো গুণের চাইতে তার দোষের ব্যাপারে বেশি সতর্ক, ভালো কাজের স্বীকৃতি না দিলেও মন্দ কাজের হিসাব রাখতে কখনোই ভুল করে না ইত্যাদি। এর কারণ হিসেবে আমার কি মনেহয় জানো?
কি মনেহয় ভাইয়া?
মনেহয় মানুষের ভালো কাজ হচ্ছে দুধের মত আর মন্দ কাজ হচ্ছে লেবুর রস। আর দুধে যখন লেবুর রস পড়ে দুধ ফেটে গিয়ে জমাট বেঁধে যায়। পানি আর পনির আলাদা হয়ে যায়। ভালো কাজগুলো পরিণত হয় ঘোলা পানিতে আর মন্দ কাজগুলো পনিরের মত খণ্ড খণ্ড রূপে ভেসে বেড়ায় সেই পানিতে। যারফলে মন্দ কাজগুলো স্পষ্ট রূপে চোখে ধরা পড়াটাই স্বাভাবিক।
শাফাত ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি ভাইয়া।
এখন ভেবে দেখো লেবুর রসের প্রভাবে দুধ থেকে যে পনির তৈরি হয়, তার নিজস্ব ব্যবহার তো আছেই সেই সাথে তাকে কাজে লাগানো হয় অনেক ধরণের মিষ্টি তৈরিতে। রসোগোল্লা, চমচম, কালোজাম, সন্দেস আরো অনেক কিছু। ঠিক একই ভাবে জীবনে কখনো কখনো আমাদের দ্বারা ভুল হয়ে যায়। যখন ভুলের উপলব্ধি হয় তখন আমাদের উচিত থমকে দাঁড়ানো এবং চিন্তা করে দেখা যে, এরফলে আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম। হারটাকে ভুলের প্রায়শ্চিত মনে করে, পাওয়াটাকে সাথে নিয়ে আমাদের উচিত সামনে এগিয়ে চলা। আবার জীবনের স্বাভাবিকতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।
আমি চেষ্টা করছি ভাইয়া। কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করছে না।
ধরো কেউ এস এস সি পরীক্ষায় ফেল করেছে। এরফলে পরিবারের সবাই তোর উপর রাগ। এই রাগের পেছনে কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কষ্ট লুকায়িত থাকে, তাদের স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা থাকে। তারা পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে গিয়ে অনেক সময় এভাবে বলেন যে, ঠিকমতো পড়ো নয়তো আবারো ফেল করবে। কিংবা একবার তো ফেল করে মান সম্মান ডুবিয়েছো, এবার অন্তত ভালো ভাবে পড়ো। যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে কিন্তু এমন কথা শুনে কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দেবে না বরং আরো বেশি করে পড়বে এবং পরীক্ষায় পাশ করে দেখাবে। তোমার ব্যাপারটাও কিন্তু অনেকটা একই রকম। তুমিও আদর্শ সন্তান হবার পরীক্ষায়, নৈতিকতার পরীক্ষায় ফেল করেছো। কষ্ট দিয়েছো প্রিয় মানুষদেরকে। ভেঙ্গে দিয়েছো তোমাকে ঘিরে দেখা তাদের মনের স্বপ্নকে। তাই কিছু আঘাত তো এখন তোমার উপর আসবেই। দেখো আপনজনদের রাগ বেশির ভাগ সময়ই তাদের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ থাকে। আমরা সেটা বুঝতে পারি না কারণ আমরা অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থাকি। আর একজন অপরাধী কখনোই ইতিবাচক চিন্তা করতে পারে না। তাই কল্যাণকামীতাকে সে অবজ্ঞা ও অবহেলার নাম দিয়ে দেয়। আমার কথা বুঝতে পেরেছো?
জ্বী ভাইয়া।
তোমার করণীয় কি সেটা কি বুঝতে পেরেছো?
জ্বী না ভাইয়া।
কেউ যখন স্কুল বা কলেজের পরীক্ষায় ফেল করে তখন যেমন কেউ সাহায্য করুক বা না করুক পরীক্ষায় পাশের জন্য তাকে পরিশ্রম করতেই হয়। জীবনের কোন পরীক্ষায় ফেল করলেও কেউ পাশে থাক বা না থাক ব্যক্তিকেই পরিশ্রম করে যেতে হবে তা থেকে উত্তোরণের। হ্যা এটা ঠিক যে আপনদের কাছ থেকে যখন আঘাত আসে সেটা সহ্য করা অনেক বেশি কঠিন। কারণ এই আঘাত মানুষের মনোবলকে নড়বড়ে করে দেয়। কিন্তু সেই আঘাতটাকে যদি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়া যায়, তাহলে সেই আঘাতই হতে পারে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম তোমার জানা আছে দেখা হলেই আমি তোমার দিকে ইট ছুঁড়ে দেবো। সুতরাং, প্রস্তুতি নিয়েই তুমি আমার আশেপাশে আসবে এবং কৌশলে ছুঁড়ে দেয়া ইট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সেই ইটকে ব্যবহার করেই আমাদের মাঝে সেতু প্রতিষ্ঠা করবে।
এই প্রথম হাসি ফুটে উঠলো শাফাতের চেহারাতে। হাসতে হাসতে বলল, ভাইয়া এত চমৎকার করে কথা কিভাবে বলেন আপনি?
রুশান হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এটা আমার টপসিক্রেট তাই বলা যাবে না। এক কাজ করি চলো বাগানে গিয়ে বসি আমরা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে মন খুলে কথা বলাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কি পছন্দ তোমার চা না কফি?
যে কোন একটা হলেই হবে।
ঠিকআছে তুমি বাগানে যাও আমি কফি নিয়ে আসছি আমাদের দু’জনের জন্য।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৮ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বলি ফাঁকিবাজিরও তো একটা মাত্রা থাকা উচিত, নাকি?
আমি মানি না
@ আপু ব্লগে ঢু দিতে এসে আপনার লেখা দেখেই। কমেন্ট দিয়েছি।
একদম রেডিমেড ফাকিবাজ এক্কেবারে না পড়ে কমেন্ট
আমি এখন আগের সিরিজ এ আছি ওটার পড়ে এটাতে আসবো
মন্তব্য করতে লগইন করুন