নিজেকে খুঁজে ফিরি নিজেরই মাঝে......৩
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ৩১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:২৬:০৮ বিকাল
ক্লাস থেকে বেড়িয়ে মামণিকে ফোন করলো অধরা। সালাম ও কুশলাদী বিনিময়ের পর অধরা বলল, মামণি কোন প্রশ্ন না করে আমি যা বলবো তাই করবে। চোখ বন্ধ করো। এখন ভাবো যে তুমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছো। তোমার মনে আজ অনেক আনন্দ কারণ বাবা আজ আবদারের সুরে তোমাকে বলেছে, নাজিয়া মনেহচ্ছে বহুদিন তোমার হাতের ইলিশ মাছের পাতুরি খাই না। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে রাঁধো না আজ ইলিশ পাতুরি। শোন ঝাল ঝাল করবে কিন্তু। আনন্দে তাই টগবগ করে ফুটতে ফুটতে তুমি রান্নাঘরে ঢুকেছো। ট্যাপের নীচে রেখে ঘষে ঘষে যত্ন করে পুঁই পাতা ধুচ্ছো। পেছনে কারো পদশব্দে ভগ্ন হলো তোমার নিমগ্নতা। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখো অবনত মস্তকে তোমার অবাধ্য কন্যা মানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেঁপে উঠলো তোমার বুকের ভেতর। মনেহলো হায় আল্লাহ কি হয়েছে আমার মেয়ের? এত শুকনো লাগছে কেন আমার পাখীটার চেহারা? দ্রুত হাতে পানির ট্যাপ বন্ধ করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তুমি আমার কাছে এসে দাঁড়ালে। আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললে, কি রে মা কি হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? আমি আহ্লাদে গদগদ হয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম, মামণি জানোই তো আমি অদ্ভুত, করে ফেলেছি তোমার কিঞ্চিৎ গীবত। দয়াকরে করো মোরে ক্ষমা, এখানেই লুকানো মাতৃত্বের মহিমা।
মিসেস নাজিয়া বললেন, সামনে পেলে এখন এমন একটা থাপ্পড় দিতাম তোকে, সব দুষ্টুমি ভুলে যেতি।
হাসতে হাসতে অধরা বলল, আচ্ছা চলো কল্পনায় থাপ্পড় দেবার দৃশ্যও হয়ে যাক।
যথেষ্ট হয়েছে বন্ধ কর তোর ভুজুংভাজুং। কোথায় তুই এখন? কার কাছে করেছিস আমার নামে গীবত।
এই তো ক্লাস থেকে বের হলাম মাত্র। লেকচার ছিলো আজ আমার। স্টুডেন্টদেরকে একটা বিষয় বোঝাতে গিয়ে তোমার সামান্য উদাহরণ টানতে হয়েছিলো। তারপর থেকে মনের মধ্যে খচখচ করছে।
মনের মধ্যে খচখচ করে এমন কথা বা কাজ করার দরকারটা কি তোর?
দরকার আছে মামণি। যখন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেয়ার কথা হয় তখন সেটার ব্যাপারে দৃঢ়তা থাকে মনে। তাছাড়া নিজের উদাহরণ দিয়ে কথা বলার আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, মানুষ বোঝে যে উনি শুধু লেকচারই দিচ্ছেন না সাথে ফিলও করছেন। যদিও ফিল করার জন্য প্রতিটি পরিস্থিতিকে ফেস করা শর্ত নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার একটা আলাদা মর্যাদা আছে। কোন মানুষ যখন এমন কাউকে দেখে যে তারই মত করে কথা বলে, চিন্তা করে কিংবা পেরিয়ে এসেছে তারই মতো অবস্থা, তাহলে খুব দ্রুত আপন করে নেয় তাকে। আর এটাই আমি চাই। আমার কাছে যারা সমস্যা নিয়ে আসে তারা যেন আমাকে আপন ভাবতে পারে। যা আমাকে তাদেরকে বুঝতে ও সঠিক পরামর্শ দিতে অনেক বেশী সাহায্য করে।
তা এই লক্ষ্যে কি তুই গিনিপিগ শুধু আমাকেই বানাস নাকি আমি ছাড়াও আরো গিনিপিগ আছে তোর ভান্ডারে?
হাসতে হাসতে অধরা বলল, আরো আছে। যেদিন যাকে বানাই সেদিন তোমার মতো তাকেও চার লাইন কাব্য শুনিয়ে দেই। আলহামদুলিল্লাহ। কি রান্না করছো মামণি?
কি রান্না করছি সেটা তো জানিসই। এই বাড়ির সব কথা তোর কাছে পাচার করার কারবারই তো করে তোর বাপ-চাচারা। আমি চিংড়ী দিয়েও পাতুরি করে তোর জন্য পাঠাবো ভাবছিলাম। চলে আয় তুই।
না আজ আসতে পারবো না। তুমি রান্না করে পাঠিয়ে দিও বাসায়। আমি রাখছি এখন।
কিন্তু কি গীবত করেছিস আমার নামে সেটা তো বললি না?
আমি আজ শরীর ও মন নিয়ে কথা বলছিলাম মামণি। শরীরের ব্যাপারে আমরা নিজেরা যেমন যত্নশীল আমাদের প্রিয়জনেরাও। কিন্তু মনের ব্যাপারে সবাই উদাসীন। অথচ মনেরই কিন্তু বেশি প্রয়োজন নিজের এবং অন্যের যত্নের। যেমন ধরো, আমার মাথা ব্যথার সময় তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলেও আমি পেইনকিলারের সাহায্যে খুব সহজেই দূর করতে পারবো আমার ব্যথা। কিন্তু মামণি যখন আমার মনে কোন কারণে ক্ষতের সৃষ্টি হয় আর তার প্রভাব পড়ে আমার কথা, কাজ বা আচরণে। দেখা যায় না বলে সেই ক্ষতে মলম লাগানোর বদলে হয়তো তাতে আরেকটা আঁচড় কেটে যাও তুমি। যারফলে গড়িয়ে পরে আরো কয়েক ফোঁটা রক্ত।
কোন মা নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে এটা করে না? তুই নিজেও তো মা। পারবি তোর মেয়েকে সজ্ঞানে রক্তাক্ত করতে শারীরিক বা মানসিক ভাবে?
বেশির ভাগ সময়েই প্রিয়জনরা না জানার কারণেই আঘাত দেয় ক্ষতে এতে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু কথা এখানে নয়। কথা হচ্ছে মনকে দেখা যায় না তাই কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না যে, নিশ্চয়ই কোন সমস্যার কারণেই কথা বা আচরণে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এখন দুনিয়ার সবার পক্ষে তো তোর মত মন ও মস্তিষ্কের গবেষক হওয়া সম্ভব নয়।
হেসে, আমি তো সেকথাই বলছি মামণি। সেজন্যই তো নিজেকেই নিজের আশ্রয় হতে হবে। দুনিয়া বার বার হাজির হবে নিয়ে তার রূপ বীভৎস, থমকে যেন না যায় কদম হতে হবে তাই নিজেই নিজের প্রেরণার উৎস।
মামণির সাথে কথা বলতে গেলে ফোন রাখবো রাখবো করেও কত সময় যে পেরিয়ে যায় অধরার। কথারা ডাল-পালা ছড়িয়ে, পুষ্প-পত্র-পল্লবে শোভিত হয়ে অনবরত ঝরাতে থাকে তাজা তাজা সবুজ পাতা। মামনির সাথে কথা শেষ করে লাইন কাটার সময় চোখ পড়লো ম্যাসেজে। আবার কে ম্যাসেজ পাঠালো ভাবতে ভাবতে ওপেন করলো অধরা।
''তোমার আকাশে সাজিয়ে দেবো সাত রঙয়ের ইন্দ্রধনু, বর্ণিল আলো ছড়াবে তুমি বিকশিত হবে ফুলের রেণু! তোমার আঙিনার মেঘমালাদের ঝড়িয়ে দেবো বৃষ্টি হয়ে, আঁখিদ্বয়য়ের স্বপ্ন কুড়িয়ে বাগিচা গড়বো তোমার নিয়ে! বেদনার ধূসর গোধূলি তুলির ছোঁয়ায় করে দেবো সুর্যোদয়, তাকিয়ো না বিস্ময়ে ভালোবাসার মৃত্তিকাতে এ যে কুটির স্বপ্নময়! তোমাকে ঘিরেই আবর্তিত মোর অনাদিকালের যত চাওয়া-পাওয়া, বিষাদ ক্লান্ত অন্তরান্তে তব প্রতীক্ষায় চঞ্চল মোর হিয়া...!''
এমন ভালোবাসায় সুতোয় বোনা আকুলতা জড়ানো শব্দমালা এসে বসে আছে তার দুয়ারে ধারণাই ছিলো না অধরার! মুগ্ধতা ও ভালোবাসার আবেশে মন ভরে গেলো! চোখ বন্ধ করলো অধরা! চায় না ঝরে যাক এই আনন্দাশ্রুর একটি বিন্দুও! মনের মধ্যে জমা করে রাখতে চায় এই শ্রাবণধারাকে। কখনো যদি অমোঘ নিয়তি আবারো খরার তপ্তদাহ নিয়ে হাজির হয় তার কাছে। এখান থেকেই কিছু জল তুলে সেচ দিয়ে যাবে মনভূমিতে।
ব্যবসার কাজে প্রায়ই শহরের বাইরে যেতে হয় শোয়েবকে। প্রতিবারই ফিরে আসে এমন একটি প্রেমময় বার্তা নিয়ে। নিশ্চয়ই বাসায় তার অপেক্ষাতে বসে আছেন শোয়েব। যত দ্রুত পারলো নিজের সবকিছু গুছিয়ে রেখে গ্যারেজের দিকে ছুটলো অধরা।
মুন্নি ও জুম্মিকে তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো অধরা। সাথে সাথেই মনে পড়লো যে ওদের দুজনকে আজ বাসায় দাওয়াত দিয়েছে সে। কথা ছিলো দু’জন আজ রান্না শিখবে অধরার কাছে। তারপর সারারাত গল্পও করবে সবাই মিলে। আজই শোয়েব আসবেন সেটা তখন জানা ছিলো না অধরার। এখন কিভাবে প্ল্যান ক্যান্সেল এই কথা বলবে ওদেরকে? নিশ্চয়ই মনখারাপ করবে কিছুটা হলেও! কিন্তু ঐদিকে শোয়েবও নিশ্চয়ই তার সাথে সময় কাটানোর জন্য বসে আছেন! হায় আল্লাহ! এমন উভয় সংকটের মুহুর্তগুলো কেন আসে মানুষের জীবনে? ‘একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা! একজনকে খুশি করতে গেলে অন্যজন কষ্ট পায় এই তো মনের জ্বালা।’
ভেতর থেকে উঠে আসা ‘কি চাইলাম আর কি হইলো’ টাইপের অনুভূতিটাকে গিলে ফেললো অধরা। বত্রিশ পাটি বের করে ফুটে থাকা ছোট ছোট ফুল দুটিকে ঝরিয়ে দিতে মন সায় দিলো না। অধরা কাছে গেলে দুজন আরো কিছুটা বিকশিত হয়ে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে অধরা বলল, আমি ডেন্টিস্ট না। দাঁত বন্ধ করে গাড়িতে উঠো চুপচাপ দুজন। মেয়ে দুটার রিমঝিম হাসির শব্দে অধরার মনে যে সামান্য দ্বিধার মেঘ ভাসছিলো তা বহুদূরে সরে গেলো। ম্যাসেজ করলো শোয়েবকে-তারাদের ছাড়িয়েও তো আছে আরো ভুবন, প্রতীক্ষা মেলবে ডানা দেখো না এমন স্বপন......
বিষয়: বিবিধ
১৯২৪ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই দৃশ্য সেই পালোয়ানের কোন আপনজন দেখলে কি করবে? সে তো বিরাট পালোয়ান ভেবে নিজের কাজে মগ্ন হবে? ব্যথায় কাতরাতে থাকা পালোয়ানকে দেখে বিরক্ত হবে? উহু বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা থাকলেও ছুটে যাবে তার কাছে।
একজন মানুষ যতই বুদ্ধিমান ও মানসিক দৃঢ়তা সম্পন্ন হোন না কেন, মানসিক আঘাতের প্রাথমিক ঢাক্কাটা সামলে নিতে কিছুটা সময় তার লাগবেই। সেই সময়ের মধ্যে তার চেহারা ও আচরণে ফুটে উঠবে সেই মানসিক বেদনার ছাপ। কিন্তু মন দেখা যায় না বলেই সেই সময় আমরা তাকে দিতে চাই না।
তবে মূল কথা আসলে এটাই যে, সব আঘাতের জন্যই মহান আল্লাহ সুন্দরতম পদ্ধতিতেই মলমের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কিন্তু সেটা বুঝতে তো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে। শরীয়ত দিয়ে চিন্তা করতে পারলে তো আমাদের জীবনে কোন সমস্যাই থাকতো না। সেটা পারি না বলেই তো সাইকোলজি, নিউরোলজি আরো কত কিছুর দ্বারা বুঝিয়ে একজনকে দেখাতে হয় যে, অনেক আগেই এর সমাধান আল্লাহ দিয়ে রেখেছেন পবিত্র গ্রন্থে।
লেকচার কি বেশি দেই আমি আজকাল? এজন্যই তো আমার ব্লগে দিতে চাই না এইসব গল্প। আরু অনেক সুন্দর জবাব দিতে পারে আমার চেয়ে।
ভালো থাকুন।
ইনশাআল্লাহ! দিয়ে দেবো টাইপ করা শেষ হলেই। ভালো থাকো তুমি।
ওকে অপেক্ষায় রইলাম আপু।
সাহিত্যের বুনন খুব ভালো আপনার। তাই বইমেলায় কোনো বই কি আসতেছে আপনার?
অনেক অনেক শুকরিয়া।
অনেক অনেক শুকরিয়া আপনাকে।
সুন্দর লেখার জন্য শুভেছ্ছা।
অনেক অনেক শুকরিয়া আপনাকে। ভালো থাকুন।
ভালো লাগলো খুব। পিলাচ
শুকরিয়া অনেক অনেক।
খুব ভালো লাগলো আলহামদুলিল্লাহ্ ।
জাযাকাল্লাহু খাইরান
বারাকাল্লাহু ফীক।
আমাদের পাখীর জন্য একটা বেগুনী পাখী...
উত্তর আসে আমি চল্লিশ বছর যাবত আমার স্বামীর জন্য রান্না করছি কিন্তু তিনি এই সময়ে কখনও আমার রান্নার প্রশংসা করেননাই।
তখন থেকেই রান্নার প্রশংসা করার একটি সিফাতের জন্য চেষ্টা করছি। আমার ঘড়ের রান্নার দোষ যে রাঁধে সেই মা নিজেই ধরে আর আমি তাকে শাষন করি রান্নার দোষ ধরতে নেই।
[প্রশংসা করার উত্তম পন্থা শিখলাম আলহামদুলিল্লাহ ]
২, আপু একটি বই বের করুন না প্লিজ কি যে সুন্দর ভাষার সৌন্দর্য আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন সেটা ছড়িয়ে পড়ুক দাওয়াত হয়ে।
৩, "আমি" নিয়ে কথাগুলো একটু বিবেচনা করলে ভালো হয়। কারন নেক আমলের ক্ষেত্রে " আমি" নিয়ে বললে হয়ত এখলাস এ কোন সমস্যা হয় কিনা?
৪, পুরো লিখাটার জন্য অনেক শুকরিয়া। শুভকামনা।
আল্লাহ সুবাহানাহুওয়াতাআলা আপুকে নাকিব মামাকে সুস্থ করে দিন।
আপুর সমস্তগুণাহকে ক্ষমা করে দিন। আমীন।
''আমি'' নিয়ে ভয়ের কারণেই কিন্তু গল্পে গল্পে লিখি আমি। কারণ এই বিষয়টি আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মনোজগতের বিষয়গুলো সহজে বোঝানোর জন্যই এভাবে লিখতে হয়। তারপরও আমি আরো সতর্ক হতে চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন