নিজেকে খুঁজে ফিরি নিজেরই মাঝে......১
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৯ জানুয়ারি, ২০১৪, ০১:৫৮:৩৬ রাত
জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে এক মনে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল অধরা। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। কখনো টুপটুপ, কখনো ঝিরঝির, কখনো রিমঝিম, কখনো এলোমেলো। আকাশ থেকে নেমে আসা এই পানি রাশিরও কত রূপ! কত ভাবেই না ছুঁয়ে যায় মৃত্তিকাকে। আর মৃত্তিকাও বুক পেতে গ্রহণ করে নেয় ঝরে পড়া পানিরাশির সব রূপকে। ম্যাসেজের শব্দে মোবাইলের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো নয়টা বাজতে দশমিনিট বাকি। দশটায় তার লেকচার আছে আজ কিন্তু একটুও ইচ্ছে করছে না বাইরে বেড়োতে। এমন সাধারণত কখনোই হয় না তার। দায়িত্ব পালনে কখনোই কোন অবহেলা করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আজ মনকে মানাতেই পারছে না বাইরে বেড়োবার জন্য। ‘ম্যাম প্লিজ হেল্প মি’ ভীষণ প্রিয় ও আদরের স্টুডেন্ট মুন্নির এই ছোট্ট ম্যাসেজে চোখ বুলিয়ে মন বদলে গেলো অধরার। আজ আবার কি হলো এই মেয়ের? স্টুডেন্ট গুলোকে নিয়ে মহা যন্ত্রণার মধ্যেই থাকতে হয় অধরাকে। প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো কিছু না কিছু হয়। কখনো কেউ ম্যাসেজ পাঠায় ‘ম্যাম কিচ্ছু ভালো লাগে না। কেন ভালো লাগে না সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি খুঁজে বের করে বলে দেন।’ গত পরশু একজন লিখে পাঠালো, ‘ম্যাম মনটার মধ্যে আঁকুপাঁকু করে। কোন খাবার খেয়ে মজা পাচ্ছি না। কি করি বলেন তো?’ ম্যাসেজ দেখে আপন মনেই অনেকক্ষণ হেসেছিল অধরা। কি যে হয় আর কি যে বলে নিজেরাই বোঝে না এই ছেলেমেয়েগুলো। বয়স বিশ ছাড়িয়ে গেলেও স্বভাবে সবাই এখনো টিনএজাদের মতোই অস্থির।
অবশ্য এমনটা সবারই মাঝে মাঝে কম বেশি হয়। দেখা যায় সবকিছু ঠিক আছে অথচ কিছুই ভালো লাগছে না। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না মন। পছন্দের মানুষ কিংবা প্রিয় জিনিস গুলোও তখন মনের সেই হাহাকার ভাবকে দূর করতে পারে না। নিজের মাঝেই গুম হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তখন। আতিপাতি করে নিজের ভেতরেই তখন মানুষ খুঁজে ফেরে একটু প্রশান্তি। কিন্তু মনের কোথাও দেখা মেলে না কিছুরই। মনের আকাশ, মেঘ, চাঁদ, তারা, রংধনু, নদী, সাগর, পাহাড়, বন্দর সবকিছু কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। যেদিকেই চোখ যায় শুধু ধূধূ মরুভূমি। অধরার নিজেরও মাঝে মাঝে এমন হতো আগে। তারপর একদিন মনের ধূধূ মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো তপ্ত বালুর উপরই। মাথার উপর সূর্য উগড়ে দিচ্ছিলো বিরক্তির লাভা। উফফ...কি যাতনা দায়ক ছটফটে অনুভূতি। মনেহলো এই মরুভূমিতে কিছু ফুলের বীজ ছড়িয়ে দিলে কেমন হয়! যেই ভাবা সেই কাজ। যতদূর পর্যন্ত হাঁটতে পারলো বীজ ছড়িয়ে দিলো মরুভূমিতেও। আবার যেদিন আটকা পড়তে হয়েছিল মরুভূমিতে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিলো অধরার। ওমা এতো আর মরুভূমি নেই! এ যে ঘাসফুলের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। নানা রঙয়ের ফুল তাতে প্রজাপতির চঞ্চল ছুটোছুটি খেলা চলছিল মরুভূমি জুড়ে। এরপর থেকে মরুভূমিতে আটকা পড়লেও আর কষ্ট হয় না তেমন অধরার।
নাহ আজ স্টুডেন্টদেরকে শেখাতে হবে কিভাবে মরুভূমিতে করতে হয় শ্রাবণের চাষ বাস। অধরার সবসময়ই মনেহয় যে নিজেকে জানা, বোঝা ও চেনাটা খুব বেশি গুরুত্বপুর্ণ প্রতিটা মানুষের জন্য। অনুভূতির পেছনে কি আবেগ কাজ করছে সেটা না জানলে জীবনের মহামূল্যবান সময়ের অনেকটা হেলায় হারিয়ে যায়। মানুষ বুঝতেই পারে না কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং তার করণীয় কি! যারফলে মনে জায়গা করে নেয় বিষণ্ণতা, নিরাসক্ততা। আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে জীবনের প্রতি। আর এসব থেকে মনকে মুক্ত রাখতে নিজেকে জানার কোন বিকল্প নেই। নিজেকে জানা, বোঝা ও চেনার জন্য নিজের সাথে থাকতে হবে নিজের সখ্যতা। দুনিয়ার সবাইকে সময় দিতে গিয়ে নিজের কথাই ভুলে যায় মানুষ। শত কাজের ভিড়ে নিজের জন্য থাকে না এক খন্ড অবসর। অথচ খুব জরুরি নিজের সাথে নিজের একান্ত আলাপন। দিনের কিছুটা সময় শুধুই নিজের সাথে কাটানো উচিত। মনের চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ গুলোকে যাচাই বাছাই করে নেবার জন্য। কোন কোন জিনিসটা সত্যি প্রয়োজন, কি কি না পেলেও স্বাচ্ছন্দে কেটে যাবে জীবন। যে কোন দুটো পছন্দের মধ্যে থেকে যদি একটিকে বেছে নিতে হয় কখনো তাহলে কোনটাকে নেবে? এই বোঝাপড়া থাকা উচিত নিজের সাথে। হ্যা এটা ঠিক যে জীবনকে এমন মেপে মেপে হিসাব করে কাটানো যায় না। কিন্তু একদম লাগামহীন ছেড়ে দেয়াও উচিত না মনকে। লাগামটা হাতে ধরা না থাকলেও কোথায় আছে সেটা জানা থাকা দরকার।
মোবাইলের শব্দে ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো অধরা। মুন্নি কল দিয়েছে। সালাম বিনিময়ের পর অধরা বলল, আজ আবার কি হয়েছে তোমার?
কিছুই বুঝতে পারছি না ম্যাম। কেন জানি না কিছুই ভালো লাগছে না। অথচ মন খারাপ হবার মতো কিছুই ঘটেনি।
কিছু তো অবশ্যই ঘটেছে যার ফলে তোমার অবচেতন মন থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া। যার প্রভাবে চেতন মনের ব্যহত হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। এক কাজ করো। চোখ বন্ধ করে এক কোণে বসে যাও। চিন্তা করো এই ভালো না লাগার আগ পর্যন্ত ঠিক কি কি ঘটেছে তোমার সাথে। খুঁজে দেখার চেষ্টা করো বিষাদের কারণ।
আমি একা একা পারবো না ম্যাম। আপনি আমাকে সাহায্য করেন।
একা একাই পারবে তুমি চেষ্টা তো করো আগে। পৃথিবীতে কাউকেই সারাক্ষণ বা যখন প্রয়োজন তখনই কাছে পাবে না তোমার। তাই নিজেকেই নিজের আশ্রয় হতে হবে। সেজন্য নিজেকে চিনতে, জানতে ও বুঝতে হবে। আজ থেকে নিয়মিত কিছুটা সময় নিজের সাথে কাটাবে। চেষ্টা করবে নিজেকে চিনতে, জানতে ও বুঝতে। মোটকথা যে সময়টা জুড়ে চলবে তোমার নিজের সাথে নিজের কথোপকথন। নিজেই হবে নিজের উপদেষ্টা, নিজেই নিজের জার্জ, নিজেই করবে নিজেকে শাসন, শোষণ ও দুর্বলতার মুহুর্তে নিজেই নিজের ভরসা হয়ে নিজেকে করবে আলিঙ্গন।
এই কথাগুলোও কি আপনার কল্পনার ফুল ম্যাম? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো মুন্নি।
অধরার চেহারাতেও ফুটে উঠলো হাসির রেখা। জানো আমি সবসময় এমন কিছু মানুষকে খুঁজতাম যারা আমার মত করে চিন্তা করে। সবসময় স্বপ্ন দেখেছি যখন খুঁজে পাবো তাদেরকে নিয়ে আমি কাজ শুরু করবো। ঘৃণার বদলে ভালোবাসা ছড়ানো, দুঃস্বপ্ন ঘেরা মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেয়া, হতাশার ঘোর অমানিশায় আশা জাগানিয়া হওয়া, নিজে কাঁটার উপর দিয়ে চলে অন্যের জন্য ফুল ছড়িয়ে দেয়া, নিজের কষ্টের মেঘগুলোকে অন্যের জন্য আনন্দের শ্রাবণ রূপে ঝরানো, মনের মধ্যে নিরবধি বেদনার স্রোতকে চাপা দিয়ে সুখের ধারা বইয়ে দেয়া হবে সেই কাজ। তোমাদের কয়েকজনের মাঝে আমি সেই মানুষগুলোর ছায়া দেখতে পাই। কিন্তু নিজের মনের অনুভূতির কাছে যদি এমন অসহায় থাকো তাহলে অন্যকে নিয়ে ভাববে কিভাবে? বিশৃঙ্খল মন নিয়ে কি অপরের জীবনকে সাজাতে পারবে? তাই আগে নিজের মনটাকে গুছিয়ে নিতে হবে তোমাদেরকে। নিজেকেই যদি নিজের মাঝে খুঁজে ফিরতে হয় তাহলে পথহারাকে পথের সন্ধান কিভাবে দেবে?
আমি খুব দুঃখিত ম্যাম।
হেসে, হয়েছে এখন আবার দুঃখী আত্মার লেবাস ধারণ করতে হবে না। তারচেয়ে যা বললাম তাই করো। নিজ মনে অবগাহন করে নিজেকে খুঁজে বের করো নিজের মাঝ থেকে। এখন রাখছি ক্লাসে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ......
বিষয়: বিবিধ
২০৫০ বার পঠিত, ৭১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে লাগামহীন না ছাড়লেও লাগাম দিয়ে মনকে ছেড়ে দিন আপন ঘরে।
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ।
মনের বিরুদ্ধে তাই আমাদের সার্বক্ষণিক লড়াই চালিয়েই যেতে হবে। লাগাম তাকে পড়ানো গেলেও ছেড়ে দেয়া যাবে না কিছুতেই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও।
তবে এই গল্পটাতে স্বপ্নালু কিছু ছেলেমেয়ের মনের জগতটাকে তুলে ধরতে চাই আমি।
অনেক অনেক শুকরিয়া ভাইয়া।
ভালো লাগ্লো...
না চাইতেও তাই খেতাব জুটেছে মোর উদাসী......
অনেক শুকরিয়া আপু।
নয়ন কি দেখিতেছে সাচ(সত্যি)
জানোতো সবি,লিখিতে কষ্ট
তাতে কি?
আছেতো কুইক কমেন্ট ঝুলি
আপনিও ভালো থাকুন এই দোয়া করি। প্রথম প্রথম প্রবাস জীবন অনেক কষ্টের লাগে। আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সহজ করে দিন আপনার জন্য। আমীন।
আপনি পারেন ও বটে !!!! ধন্যবাদ।
উঁকি দিয়ে দেখে নেন তাহাকে...
উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়ে
খেলাম একটা ঝাঁকি,
সুধামণি ঠুলি পরায়
তোমার চোখে এ কি?
পিলাচ ভালো লাগলো ধন্যবাদ অনেক ধন্যবাদ
শুকরিয়া শুকরান শুভকামনা
জাজাকাল্লাহু খাইরান
[অনেক দিন বেত খাইনা ]
দিলাম বাড়ি ক’টা শপাৎ শপাৎ......
টেনে টেনে করে দিরে ইচ্ছে করছে লাল......
এমন কি হতে পারে আমার ছোট্ট বোনেরা আমার কাছে কিছু চাইবে আর সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও আমি সেটা করবো না???? উহু...নেভার এভার ইনশাআল্লাহ।
কি যে মুশকিল !
সুন্দর ভাবনা।
খুব সুন্দর লিখেছেন আপুমণি । আল্লাহ্ আপনাকে উওম প্রতিদান দান করুন
ফসল ফলাতে তাতে হতে হবে মোদের আশাবাদী।
হুম আমি আমার প্রশ্নের উত্তর একটু একটু পাচ্ছি।
ইনশা আল্লাহ
আগে এই পর্ব শেষ হোক তারপর পুরো মন্তব্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো আপুমণির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন