পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও আমার পুত্র......
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:৩৯:২৯ দুপুর
আমরা সবাই জানি প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রীয় রয়েছে। চোখ, কান, নাক, জিহবা, ত্বক। আরেকটি ইন্দ্রিয়ও আছে যাকে ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলা হয়। বলা হয় ষষ্ট ইন্দ্রিয় সবার থাকে না। কারো কারো থাকে। যাদের মধ্যে থাকে তাদের ভেতরও এটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে সেটা তার অস্তিত্ব জানান দেয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটির নিজস্ব কার্যাবলী আছে। চোখ দিয়ে আমরা দেখি, কান দিয়ে শুনি, নাক দিয়ে ঘ্রাণ অনুভব করি, জিহ্বা দিয়ে স্বাদ গ্রহন করি, ত্বকও অনুভবের একটি মাধ্যম। এই প্রত্যেকটিই জ্ঞানার্জনেরও একেকটি মাধ্যম। চোখ দিয়ে দেখে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করি। নাক দিয়ে ঘ্রাণ অনুভবের মাধ্যমে অনেক কিছু বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারি। জিহ্বা দ্বারা স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমেও জ্ঞানার্জন করি। কান দিয়ে শুনেও জ্ঞানার্জন করি। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা স্তরে গিয়ে এই প্রত্যেকটি হারিয়ে ফেলে নিজ নিজ কার্যক্ষমতা। আর সেইসব মুহুর্তে জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে মাধ্যমটি আমাদেরকে দিয়েছেন সেটিই হচ্ছে ষষ্ট ইন্দ্রিয় বা বিবেক। যেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায় পঞ্চ ইন্দ্রিয়, সেখান থেকেই সচল হয় ষষ্ট ইন্দ্রিয়। সেই হিসেবে আমাদের সবার মাঝেই ষষ্ট ইন্দ্রিয় বর্তমান।
জন্মের পরই একটি শিশুর দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ,স্পর্শ অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাজ করতে শুরু করে। এগুলোর সাহায্যেই শিশু নানা ধরণের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এবং সেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতার দ্বারাই ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে তার মানসিক বিকাশ। নাকীবের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর আমি একদিন সামান্য সাজগোজ করেছিলাম। যেহেতু সাধারণত আমি কখনোই সাজি না তাই নাকীবও সেদিনের আগে আমাকে এমন রূপে দেখেনি। তাই আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো তারপর দিলো বিকট এক চিৎকার। আমি যে ওকে বোঝাবো সেই উপায়ও ছিল না। ঘর ভরে ছুটছিল আর চিৎকার করে আমাকে ডাকছিল। কিন্তু আমার কাছে কিছুতেই আসছিলো না। সবকিছু ধুয়ে মুছে যখন সামনে এলাম ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে লাগলো। পরে ওর কথা থেকে বুঝেছিলাম যে সে ধারণা করেছিলো এটা তার আম্মু না। তার আম্মুর চেহারাতে তো রঙ নেই। কানে কিছু ঝোলে না পোকার মত। বেশ অবাক হয়েছিলাম সামান্য কিছু রঙের ছোঁয়া একটা শিশুর মনে এমন ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে, সে তার মাকে নিয়ে সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলো।
নাকীবের একটা ভীষণ রকম বদভ্যাস হচ্ছে যে কোন খাবার মুখে দেবার আগে সে শুঁকে দেখে। দেখতে সুন্দর তো হতেই হবে সাথে সাথে ঘ্রাণও তার পছন্দ হতে হবে। নয়তো কিছুতেই খাবে না। যেদিন প্রথম মাছ খাওয়াতে গেলাম ওকে সেকি কান্না। কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেলো একদম। কিন্তু যেহেতু খাওয়াতে হবে আমি অটল রইলাম। গন্ধে বমি করে দেবো বলার পরও আমি মুখে দিলাম। কিছুক্ষণ মুখের মধ্যে নিয়ে বসে রইলো পরে ধীরে ধীরে খেয়ে নিলো। আরো কয়েকবার খেয়ে বলল, আম্মু মাছ তো খেতে মজা। গন্ধ বাজে তো তাই আমি ভেবেছিলাম খেতেও অনেক বাজে। অর্থাৎ, ঘ্রাণ থেকেই সে খাবারের স্বাদের ব্যাপারে ভালো-মন্দের ধারণা করে নিয়েছিলো। ঘ্রাণ সুন্দর মানেই ভালো আর ঘ্রাণ অস্বস্তিকর মানেই মন্দ। অর্থাৎ, যাচাই বাছাই ছাড়াই আনুমানিক ধারনা।
কথা বলা শিখার আগেই একটি শিশু ভাষা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করে। তাই দেখা যায় যে একটা শিশু কথা বলতে পারে না কিন্তু তাকে যদি শেখানো হয় হাত কোনটা, পেট কোনটা, মাথা কোনটা। সে ঠিকই সুন্দর ও নির্ভুল ভাবে সেটা দেখিয়ে দিতে পারে। শ্রবণ শক্তির সাহায্য সে এই ধারণা করতে শেখে। শুনে শুনে অনেক কিছুই শিখে ফেলে শিশুরা। নাকীবকে একদিন শুনলাম খেলতে খেলতে সূরা ফাজর তিলাওয়াত করছে। আমি যে যে সূরাগুলোর তিলাওয়াত সবচেয়ে বেশি শুনি সূরা ফাজর তারমধ্যে একটি। অর্থাৎ, শ্রবণ শক্তির দ্বারা সে জ্ঞানার্জন করছে অনেকটা নিজের অজান্তেই। আবার যেমন আমার কণ্ঠস্বর শুনেই নাকীব বুঝে ফেলে আমার মেজাজ এখন কেমন। কয়েকদিন আগে একটা কাজ বলার সাথে সাথেই করে ফেললো। এমনিতে সে অনেক সময় লাগায় তাই কারণ জানতে চাইলাম। বলল, আম্মু তোমার অদ্ভুত কণ্ঠ শুনেই বুঝেছি তোমার মন ভালো না তাই আমি ঝামেলা করিনি। হুমম...এটা তার অভিজ্ঞতা লব্ধ ধারণা।
আমি মাঝে মাঝে বেশ অবাক হই পুত্রের কর্মকান্ড ও কথাবার্তায়। নতুন কিছু বললেই সে প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসে। যে পর্যন্ত তার মন মোটামুটি সন্তুষ্ট না হয় সে প্রশ্ন করতেই থাকে। যেমন ডাইনোসরের উপর প্রচুর ডকুমেন্টারি সে দেখেছে, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি বড়দের কিছু বইও সে পড়ে ফেলেছে ডাইনোসরের উপর। নিয়মিত একটা কার্টুন দেখে ডাইনোসর নিয়ে। কিন্তু তারপরও তার ইচ্ছে বড় হয়ে সে ডাইনোসরের ফসিল খুঁজে বের করবে। সেটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে সে যেসব জায়গায় ডাইনোসরের ফসিল আছে সেখানে গিয়ে দেখে আসবে। আমি ওর চিন্তাতে কখনোই বাঁধা দেই না। ভালো লাগে ওর সবকিছুকে যাচাই করে দেখার এই স্পৃহা। গল্পের বই পড়ছে হয়তো একটা শব্দ বুঝতে পারছে না। এতে পুরো বাক্যটা বুঝতে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু তারপরও নাকীব বই পাশে রেখে ডিকশনারি খুলে সেই শব্দের অর্থ খুঁজে বের করে তারপর আবার পড়া কন্টিনিউ করে। অর্থাৎ, সুযোগ থাকলে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সে ধারণা করতে নারাজ। কারণ তার মস্তিষ্ক জানে ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।
পোশাকের ব্যাপারে আমার ছেলেটা এত আরাম প্রিয়! উফফ...কত উপহার পাওয়া ড্রেস এখনো তেমনি পরে রয়েছে। একবারও সে পড়েনি। কারণ সে কিছুতেই শার্ট পড়বে না। আর শুধু তেমন টিশার্ট পড়বে যাতে বোতাম থাকতে পারবে না, চেন থাকতে পারবে না এবং অবশ্যই খুব নরম কাপড়ের হতে হবে। প্রথম প্রথম পাত্তা না দেবার চেষ্টা করতাম কিন্তু অপছন্দনীয় কোন পোশাক পড়ালে মুখ ভোঁতা করে বসে থাকার পাশাপাশি চুলকিয়ে শরীরের চামড়া অবস্থা এমন করতো মনেহত এলার্জী উঠেছে। শরীরের মত ওর মনটাও খুব সংবেদনশীল। একটুতেই অভিমান চোখে নামে অশ্রুর বাদল, আবার স্নেহের সামান্য পরশেই জুড়ে দেয় অদম্য কোলাহল। তবে সবকিছু মিলিয়ে পুত্রটি আমার জন্য জ্ঞানার্জনের বেশ আনন্দদায়ক একটি মাধ্যম। আলহামদুলিল্লাহ।
ওর পঞ্চ ইন্দ্রিয়র প্রয়োগ দেখে আমি অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে শিখেছি। যেমন আমরা দিব্য চোখ দেখে যেসব ধারনা করি সবসময় তা সত্যি হতে নাও পারে। ঘটনার আড়ালেও থাকতে পারে ঘটনা। বর্ণিল গল্পের আড়ালেও থাকতে পারে রঙহীন উপাখ্যান। সুতরাং পারত পক্ষে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করি ধারণা করা থেকে। কোন কিছু যখন বার বার ছুঁয়ে যায় শ্রবণ যন্ত্রের তার একসময় সেই সুরই ধারণ ও গ্রহণ করে ফেলে সে। কিন্তু বাতাসে শুধু অক্সিজেন ভাসে না, কার্বন-ডাই-অক্সাইডও ভাসে। তাই যাচাই করে দেখা উচিত যা গ্রহণ করছি তা আমল নাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে নাতো? দেখতে খুব সুন্দর এমন ফুলের ঘ্রাণে অনেক সময় যেমন নাকে হাত চাপা দিয়ে হয়। তেমনি পথের ধারে ফুটে থাকা ঘাসফুলের ঘ্রাণ মনকে করে যায় শিহোরিত। আবার এমন অসংখ্য ফুল আছে যার কোন ঘ্রাণ নেই কিন্তু চোখকে করে শীতল, মনকে করে প্রশান্ত। তাই সতর্ক থাকি কারো সৌরভ যাতে বিভ্রান্ত না করে দেয় মনকে। তারপরও যে ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকতে পারি তা কিন্তু না। আসলে কারো প্রতি ধারণা এমন একটা অনুভূতি যা খুব সহজেই মনের ভেতর তৈরি হয়ে যায়। এটা করতে কোন খরচা হয় না। এটাকে নিয়ে চলাফেরা করতে বোঝা মনেহয় না। কিন্তু এর পরিণাম অনেক ভারী...!
সেজন্যই শরীয়তে মুসলিমদেরকে ধারণা পোষণের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ভাবে ইন্দ্রিয়ের কথা বলেছেন সূরা বনী ইস্রাইলের ৩৬ নং আয়াতে-“ তোমার যে বিষয়ে জ্ঞান নাই উহার অনুসরণ করো না । যা কিছু শুনবে, অথবা যা কিছু দেখবে, অথবা হৃদয়ে যা কিছু [অনুভব করবে] , সব কিছুর অনুসন্ধান করা হবে [ হিসাব গ্রহণের দিনে]।” এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-“ স্রষ্টা আমাদের জ্ঞান লাভের জন্য বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দান করেছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করি ও হৃদয়ের অনুভূতির মাধ্যমে এই জ্ঞানকে আমরা আত্মস্ত করি। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কর্ণ ও চক্ষু, জ্ঞান আহরণের জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় মাধ্যম। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়কে কিভাবে ব্যবহার করেছি পৃথিবীতে তার হিসাব আমাদের দিতে হবে পরলোকে। মানুষ অহেতুক কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই নিষিদ্ধ জিনিষের স্বাদ গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। তাই অহেতুক কৌতুহল ভালো নয়। অনেক সময়ে তা ব্যক্তিকে মন্দ পথে উপণীত করে। কারণ আমরা জানি না যে কৌতুহলের শেষ প্রান্ত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। আমরা সর্বদা নিজেদের এরূপ বিপদ থেকে রক্ষা করে চলবো। আমরা সেই কথাই শুনবো যা সুপথে চালিত করে, সেই জিনিষই দেখবো যা ভালো, উপদেশ পূর্ণ এবং আমাদের অনুভূতি ও মনকে তৃপ্ত করে এবং আত্মার সমৃদ্ধিতে সহায় হয়।
(কৃতজ্ঞতাঃ সাদিয়া মুকিম আপুনিকে। বিবেক নিয়ে পোষ্টটি লেখার পর সাদিয়া আপু ইন্দ্রিয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। নয়তো এই পোষ্টটি হয়তো লেখা হত না। আলহামদুলিল্লাহ।)
বিষয়: বিবিধ
৪৬১৫ বার পঠিত, ৮০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বারাকাল্লাহু ফীক।
এগুলোর কোনো তুলনা নেই!
অনেক অন্নেক ধন্যবাদ আপনাকে!
ধন্যবাদ আপু।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
খাবার পর প্রতিক্রিয়া........
অনেক ধন্যবাদ।
একমত অনেক সুন্দর লেখা আপু
গতকাল তোমার সুন্দর একখানা গল্প পড়িয়াছিলাম! আজ মন্তব্য করিবার জন্য তাহাকে খুঁজিতেছিলাম কিন্তু সন্ধান মেলে নাই।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
Allah amader Shokol Keo shobgulo indrior jothartho bebohar korar taufiq dao.
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আলহামদুলিল্লাহ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহু খাইরান
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আল্লাহ্ আমাদের উওম জ্ঞান লাভের তাওফিক দিন । এবং অহেতুক ধারণা থেকে দূরে রাখুন আমিন ।
অনেক অনেক ভালোবাসা রোশনি মণির জন্য।
নাকীব বাবুর জন্য অনেক দোয়া রইলো। যখন লিখাটি পড়েছিলাম তখন কেমন যেনো আধ্যাত্মিকতায় পড়ে গিয়েছিলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আমার প্রথম কমেন্ট এই ব্লগে। এবং সেটা তোমার লেখাতেই পড়ে অনেক কিছু শিখলাম। বরাবরের মত এটাও শিক্ষণীয় একটা লেখা। আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।
অনেক শুকরিয়া তোমাকে।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনার জন্য যেমন পুত্রটি জ্ঞানার্জনের আনন্দদায়ক একটি মাধ্যম; ঠিক আমাদের জন্যও এই লেখাটি জ্ঞানার্জনের আনন্দদায়ক শিক্ষনিয় মাধ্যম হয়ে রইলো ।
এবার ষষ্ট ইন্দ্রিয় নিয়ে লেখা চাই
যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের
এই ছবিটা আরোহী আপু এবং আফরোজা আপু তোমাদের দুইজনের জন্য।
অনেক ধন্যবাদ।
অনেক অনেক শুকরিয়া।
অনেক ভালো লাগল আপনার পোস্টটি।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
যে ফুলটা আড়ালে সেটা আমি
বেড়িয়ে আসুন জলদি বাহিরে...
অনেক অনেক শুকরিয়া আপুনি।
( )
মন্তব্য করতে লগইন করুন