সূরা আলে-ইমরান এর পাঁচটি আয়াত
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৪:৪৯:৩৬ বিকাল
"হ্যাঁ - যদি তোমরা দৃঢ় থাক এবং সঠিকভাবে কাজ কর, সেক্ষেত্রে শত্রু যদি দ্রুতগতিতে তোমাদের উপর আক্রমণ চালায়, আল্লাহ্ পাঁচ হাজার ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন, প্রচন্ড আক্রমণের জন্য।" (সূরা আলে-ইমরান -১২৫)
“আল্লাহ্ ইহা তোমাদের জন্য আশা ও তোমাদের হৃদয়কে নিশ্চিত করার জন্য করেছেন। এবং [সব সময়ে] সাহায্য তো শুধু পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্র নিকট থেকে আসে।" (সূরা আলে-ইমরান -১২৬)
এই দুই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-“ যাই ঘটুক না কেন, এই বিশ্বাস মনে রাখা যে আল্লাহ্ সমস্ত সাহায্য ও ভরসার মালিক। এই সাহায্য বাহ্যিক উপায় উপকরণ হতে পারে বা অলৌকিকও হতে পারে। আল্লাহ্র উপর পূর্ণ ভরসার নামই হচ্ছে 'তাওয়াক্কুল।' এর অর্থ যেনো একথা কেউ না বোঝে যে বাহ্যিক উপায় উপকরণ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে বসে থাকার নাম "তাওয়াক্কুল।" বরং আল্লাহ্র উপর পূর্ণ ভরসা হলো - সামর্থ্য অনুযায়ী যাবতীয় বাহ্যিক উপায় অবলম্বনের পর ফলাফলের ব্যাপারটি আল্লাহ্র কাছে সমর্পণ করা এবং বাহ্যিক উপায়াদির জন্য গর্ব প্রকাশ না করে আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং সাফল্যের জন্য আল্লাহ্র উপরে ভরসা করা। মানুষ যেনো উদ্ধত অহংকারী না হয় তার বিত্ত, অর্থ-বৈভব বা শক্তির আতিশয্যে। একথা যেনো কেউ না ভাবে তার শক্তি সামর্থের দ্বারা আল্লাহ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পারবে। এ কথা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, জাতির জন্যও প্রযোজ্য। যেমন : প্রাচীন কালের আদ জাতি, বর্তমান কালে জার্মান জাতি এক সময়ে মনে করেছিল, তারা তাদের শক্তির দম্ভে পৃথিবী পদানত করবে। যদি আল্লাহ্র তা-ই ইচ্ছ হতো, তবে তা হতো। পৃথিবীর জীবনযাত্রায় বাহ্যিক উপকরণের প্রয়োজন আছে - তবে তা-ই শেষ কথা নয়। আল্লাহ্র নিকট সাফল্য চাওয়া ও তার উপরে নির্ভরশীলতাই হচ্ছে শেষ কথা। আগেই বলা হয়েছে এর মানে এই নয় যে আল্লাহ্র সাহায্যের আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। আল্লাহ্ তাকেই সাহায্য করেন যে তার দেওয়া নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে। পৃথিবীতে চলার পথে যে ধৈর্য্য, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, সাহস প্রদর্শন করে এবং স্বীয় কর্তব্য-কর্মের দিকে অবিচলভাবে এগিয়ে যায় এবং এই এগিয়ে যাওয়ার পথে সে আল্লাহ্র প্রদত্ত সব নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করে এবং ফলাফলের জন্য শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপরে নির্ভর করে, আল্লাহ্র রহমত তাদের জন্য। বদর এবং ওহুদের যুদ্ধে নবী করিমের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষাই লাভ করি। এখানে একটি কথা স্মরণযোগ্য, আল্লাহ্ "পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়"। অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ-সিদ্ধির আশায় আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীলতার অনেক উর্ধ্বে আল্লাহ্র অবস্থান। আল্লাহ্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শক্তি আমাদের ধারণার বাইরে।”
“কাফিরদের এক অংশকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অথবা লাঞ্ছিত করার জন্য। ফলে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়।” (সূরা আলে-ইমরান -১২৭)
এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে- “"কাফেরদের এক অংশ" - এ কথাটির অর্থ এই যে, সকলে নয় কিছু অংশ। এখানে এর অর্থ হচ্ছে মক্কার কাফেরদের প্রধান এবং তার অধীনস্থ যোদ্ধারা যারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে মদিনা আক্রমণ করেছিল নিশ্চিত জয়ের আশায়, তাদের সে আশা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল - যেনো আল্লাহ্ তাদের এক অংশ নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। ওহুদের যুদ্ধে মক্কাবাসীরা যে প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়, এমনকি তারা মুসলমান শহীদদের উপরে যে বর্বরোচিত আচরণ করে তা যুগ যুগ ধরে কলঙ্কিত অধ্যায়রূপে তাদের জন্য বিশ্ববাসীর ঘৃণাই কুড়াবে। এটাও আল্লাহ্র তরফ থেকে তাদের প্রাপ্য শাস্তি। তাদের এই নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক ব্যবহারই হয়তো মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা বিবেকবান তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দেয়, মুসলমানদের মহত্ব তাদের মুগ্ধ করে। এই ঘটনার পরেই খালেদ-বিন-ওয়ালিদ শুধু যে ইসলাম গ্রহণ করেন তা-ই নয়, তিনি ইসলামের ঝাণ্ডা উত্তোলনকারীদের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছিলেন। এই সেই খালিদ-বিন-ওয়ালিদ যিনি ওহুদের যুদ্ধের সময়ে গিরিপথে মুসলিম সৈন্যদের অনুপস্থিতিতে তার সুযোগ গ্রহণ করে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের বিপর্যস্ত করেন। তিনি অত্যন্ত কুশলী বীর যোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ে তিনি মুসলিমদের পুরোধায় ছিলেন এবং সিরিয়া ও ইরাক জয় করে তিনি যোদ্ধা হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত হন। এ হিসেবেও আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় কাফেরদের এক অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে মুসলিমে রুপান্তরিত হয়।
“তিনি তাদের অনুগ্রহ করবেন অথবা তাদের শাস্তি দেবেন এ ব্যাপারে [আল্লাহ্ ব্যতীত] তোমার কোন সিদ্ধান্ত নাই। প্রকৃতপক্ষেই তারা তো পাপী।” (সূরা আলে-ইমরান -১২৭)
আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা আলে-ইমরান -১২৮)
এই দুই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে- “বদর এবং ওহুদের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য এক পথ নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পথ নির্দেশক এই জন্য যে এর শিক্ষা সে যুগে যেমন প্রযোজ্য ছিল, অদ্যাবধিও তা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সমভাবে না বলে বলা যায় এর দিক-নির্দেশনা এ যুগে আরও বেশি করে মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ্র সাহায্য বা করুণা তখনই পাওয়া যায় যখন আমাদের মধ্যে বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা, চেষ্টা, আন্তরিকতা, শৃঙ্খলা, একতা, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি গুণের জন্মলাভ করে। যে ব্যক্তি বা জাতির মধ্যে উপরের গুণাবলীর জন্ম নেবে অবশ্যই সে ব্যক্তি বা জাতি হবে সফলকাম - ইহকালে এবং পরকালেও। ভেবে দেখার বিষয় মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা এসব গুণ বর্তমানে কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। যারা ঐসব গুণ অর্জন করতে পারে না তারা সফলকাম হয় না সত্য, কিন্তু আল্লাহ্র করুণার ধারা তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায় না। তাঁর করুণা-ধারায় বিশ্বজগৎ আপ্লুত। আল্লাহ্র করুণা বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, ইসলামের শত্রু-মিত্র, সকলের জন্য সমভাবে প্রবাহিত। অবিশ্বাসী, অবিশ্বস্ত, মিথ্যাবাদী, অন্যায়কারী আল্লাহ্র করুণা বা রহমত ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না।ফলে তারা সফলকাম হতে পারে না। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই। ওহুদের যুদ্ধের পরে খালিদ-বিন-ওয়ালিদের মতো বীর যোদ্ধা, যিনি ইসলামের গৌরব, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ওহুদের যুদ্ধে বিপর্যয় এবং মক্কাবাসীদের নিষ্ঠুরতা খালেদ-বিন-ওয়ালিদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে দেয়। পাপীকে অনুতাপের সুযোগ দান আল্লাহ্র এক বিশেষ দয়া। আমরা যাদের অবিশ্বাসী মনে করি, পাপী মনে করি, হয়তো তাদের মধ্যেও নিশ্চয়ই অনেক ভালো গুণ আছে যার জন্য আল্লাহ্ তাদের বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে হেদায়েত করতে চান। আমাদেরও আল্লাহ্ সেই সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের উদাহরণের মাধ্যমে, যেনো আমরা আমাদের নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারি। অন্ধ অহংকারে নয়, গর্বের সাথে নয়, বিনয়ের সাথে আমাদের চরিত্রে কোন কোন গুণের অভাব তা বিশ্লেষণ করি এবং আত্ম-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আত্ম উন্নতির চেষ্টা করি তবেই আমরাও হব সফলকাম।”
হে আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন আমরা যেন সর্বদা আপনার মঙ্গলময় ইচ্ছার কাছে নিজেদের সমর্পিত করতে পারি। কখনো যাতে অধৈর্য্য না হই! কখনো যাতে আমাদের মনকে ছুঁতে না পারে হতাশা রূপি অকৃতজ্ঞতা। আমীন।
সুত্রঃ কুরআন এন্ড তাফসীর ডট কম।
বিষয়: বিবিধ
২৯৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন