শিশুদের কাউন্সিলিং
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ০৩:৫১:৫২ দুপুর
নাকীবের ভীষণ রকম একটা বদভ্যাস হচ্ছে আমাকে ছাড়া সে কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। আমার কোলে আসবে তবেই ঘুমোবে নয়তো বসে থাকবে। বিভিন্ন কারণে প্রায়ই আমি ওর ঘুমের সময়ের আগে ফ্রী হতে পারিনা এবং সেও না ঘুমিয়ে গাঁট হয়ে বসে থাকে। এই অভ্যাসটা বদলানো দরকার তাই ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি পড়তে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে বলল, আম্মু আমরা যত বড় হই ততই নতুন নতুন জিনিস শিখি তাই না? বললাম, হুম...হঠাৎ এই কথা কেন? নাকীব বলল, দেখো আম্মু আমি যখন পৃথিবীতে এসেছিলাম তখন তো কিছুই জানতাম না। এরপর ধীরে ধীরে বসতে শিখেছি, হাঁটতে শিখেছি, দৌড়াতে শিখেছি, কথা বলতে শিখেছি, একা একা খেতে শিখেছি, লিখতে শিখেছি, পড়তে শিখেছি, আর এই বছর আমি দোকান থেকে একা একা খাবার কিনতে শিখেছি। আমার বয়স আট এবং আট বছরে আমি আটটা জিনিস শিখেছি। আম্মু আমার যখন নয় বছর বয়স হবে তখন আমি একা একা ঘুমোতে শিখে যাবো। নয় বছর হতে যে কয়দিন বাকি আছে তোমার সাথে ঘুমাবো কেমন! আমি বই বন্ধ করে ওর সাথে ঘুমোতে গেলাম তখন।
আমরা অভিভাবকরা বেশির ভাগ সময়ই ভুলে যাই যে আমরাও একসময় ছোট ছিলাম। বাবা-মা যখন জোর করে কোনকিছু চাপিয়ে দিতেন, কিংবা আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছা-খুশি-আনন্দগুলোকে মূল্যায়ন না করতেন কতটা অসহায় অনুভব করতাম আমরা। হয়তো বাবা-মা ঠিক কাজটিই করতেন, হয়তো আমরা ইচ্ছা-খুশি-আনন্দের যে উপকরণগুলোকে পছন্দ করেছিলাম আমাদের জন্য সেসবই ভুল ছিল। কিন্তু বুঝিয়ে না বলে চাপিয়ে দেবার কারণে আমরা নিজের ভুল তো বুঝতে ব্যর্থ ছিলামই সাথে সাথে বাবা-মার সম্পর্কেও ভুল ধারণা লালন করেছি মনে। আসলে নিজেদের সিদ্ধান্ত জোর করে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিলে উপকারের বদলে অপকারই বেশি হয়। সন্তানের কল্যাণ করতে গিয়ে কল্যাণকামী হবার বদলে আমরা হয়ে যাই মেন্টালি অ্যাবিউজার। তাই জোর করে সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে যুক্তির মাধ্যমে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে সন্তানরা স্বতঃস্ফ্রুত ভাবে সেই মেনে নিতে বাধ্য হবে। আর এরফলে আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ অর্জন এটা হয় যে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শেখে, ভাল-মন্দকে যাচাই বাছাই করতে শেখে।
আমি যখনই নাকীবকে কিছু শিখাতে যাই কিংবা নাকীব কোন ভুল করলে ওকে শুধরাতে যাই, কখনোই সরাসরি কিছু বলি না ওকে। বরং কাজটা ওর কেন শেখা উচিত বা যে কাজটি করেছে সেটি কেন ভুল পয়েন্ট ভিত্তিক বিষয়টা ওর সামনে উপস্থাপন করি এবং ওকে বুঝে নিতে সাহায্য করি করণীয় ও বর্জনীয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঠিক এই কাজটি নাকীবও করে আমাকে কনভিন্স করতে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যুক্তি দিয়ে এমন একটা আবহ তৈরি করে যে আমি মানতে বাধ্য হই কিংবা এটা বলা ঠিক হবে মানার মত হলে আমি তখন সেটা মেনে নেই। কারণ আমি যদি ওর ভাবনাকে সবসময় অবমূল্যায়ন করি তাহলে একসময় সেও আমার ভাবনাকে মূল্য দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না। আসলে শিশুরা বাবা-মাকে বন্ধু হিসেবে পেতে পছন্দ করে, শাসক হিসেবে নয়। তারচেয়েও বড় কথা ভালোবাসা যা করার ক্ষমতা রাখে শাসন সেটা রাখে না। শাসনের কারনে বেশির ভাগ সময়ই শিশুদের মনে অভিমানের ক্ষোভ দানা বাঁধে। সেই ক্ষোভের কারণে একদিকে যেমন শিশুদের পার্সোনালিটি বিল্ড আপ ব্যহত হয়, অন্যদিকে ব্যহত হয় বাবা-মার সাথে সন্তানদের রিলেশনশীপের বিল্ড আপ।
কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া কিংবা নিজের ধারণা, মনোভাব কিংবা বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া নয়। যে সমস্যায় স্বীকার সরাসরি তার কাছে সমস্যার বিষয়টি উপস্থাপন না করে বরং খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তাকে সমস্যা মোকাবিলা পথ খুঁজে বের করে দেয়া হচ্ছে কাউন্সেলরের কাজ। যাতে সে সমস্যার ব্যাপারে বাস্তব উপলব্ধি লাভ করে নিজের অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ, কাউন্সেলরের মূল কাজ হচ্ছে প্রতিটি সমস্যার নির্দিস্ট সমাধানে পৌঁছাতে সাহায্য করা। কাউন্সিলিং করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই এমন কিছু ছেলে-মেয়েদের সাথে পরিচয় হয়, যাদেরকে সমাধানে পৌঁছোতে সাহায্য করা তো দূরে থাক কথা বলাটাকেই দুঃসাধ্য ব্যাপার মনেহয়। কারণ যুক্তির প্রয়োগ বা গ্রহণ কোনটাই তারা শেখেনি, কিংবা পায়নি বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে। তাদের উপর সবসময় সবকিছু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই তারাও অন্যের উপর নিজের মতকে চাপিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত।
প্রচণ্ড মায়া অনুভব করি আমি এই ধরণের ছেলে-মেয়েগুলোর উপর। আতঙ্কিত হই ভেবে না জানি কেমন ছিল সেই পরিবেশ যা ওদের মুক্ত চিন্তাকে একটা কোণে এনে বন্দী করে ফেলেছে। স্বেচ্ছাবন্দী ওরা আর ওদের চারপাশে নিজের তৈরি কারাগার! কিন্তু ইচ্ছে করে ওরা নিজেকে বন্দী করেনি সেই কারাগারে, পরিবেশ বাধ্য করেছে। প্রচণ্ড শক্তির দরকার সেই কারাগার ভাঙ্গার জন্য। কেননা নিজেকে জয় করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। নিজের প্রতি কল্যাণকামিতাই পারে অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসার প্রেরণা জাগাতে কিন্তু এরজন্য প্রয়োজন নিজেকে সঠিক অর্থে ভালোবাসা। আর নিজেকে সঠিক অর্থে ভালোবাসার মানে হচ্ছে, নিজের অন্যায় ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার না করা। এখন এই জিনিসটাই যারা শেখেনি তাদেরকে কেমন করে বোঝানো সম্ভব? সম্পর্কের বন্ধন যাদের জীবনে কখনোই আলো হয়ে আসেনি, তাদেরকে কেমন করে বোঝানো সম্ভব অন্ধকার ও আলোর মধ্যে আলোই যে অপ্রতিরোধ্য?
আসলে শিশুরা যা দেখে তাই অনুকরণ করতে চেষ্টা করে। তাই শিশুদের ছোট বেলা থেকেই এমন ভাবে গড়ে তোলা উচিত যাতে কোন ব্যাপারে জোর করতে না হয়। প্রতিটা কাজ করতে বলার সময় কেন করতে হবে, করলে কি হবে এবং না করলে কি হবে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাহলে তারাও যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করতে শিখবে। হুকুম নয় ভালবাসা দিয়েই কেবল সম্ভব সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। শিশুরা ভুল করবেই কিন্তু সেজন্য বকাঝকা করা ঠিক নয়। বরং তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো এমনভাবে ধরিয়ে দিতে হবে যাতে তারা অপমান বোধ না করে এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সেই ভুল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়। অনেক সময় শিশুরা অনেক যুক্তি পেশ করে তাদের ভুলের পেছনে, তখন তাদেরকে থামিয়ে না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে সেসব কথা। তারপর তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন তার চিন্তাগুলো ভুল। নানা আবদার নিয়ে হাজির হয় শিশুরা প্রায়ই, যৌক্তিক হলে খুশি মনে সেটা মেনে নেয়া উচিত। আর যৌক্তিক না হলে কিংবা আবদারটি রাখার মত না সুন্দরভাবে সেটা বুঝাতে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে একটা সময় শিশুরাও এই বিষয়গুলো আয়ত্ত্ব করে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে।
ভালোবাসাময় শৈল্পিক প্রতিভার বিকাশে
আত্মবিশ্বাসী মহৎ ধৈর্য্যশীলতার প্রকাশে
আন্তরিক সহমর্মিতা যদি দেয়া হয়
আদর্শ শিশু গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়
মনোযোগ আবেগের অভাব যদি ঘটে
সৃষ্টিশীল সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ যায় ছুটে
ভ্রান্তধারণা দুঃখবোধ বিষণ্ণতার চাদরে
বৈচিত্র্যহীন জীবনের দিকে শিশু ঝুঁকে পড়ে
ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে হয়ে উদাসীন অনাগ্রহী
কখনোই পারে না চলতে পথ হয়ে সত্য আরোহী
দৃঢ়ভাবে মনে গেঁথে দিতে হবে জ্ঞান পিপাসা
ছুঁতে পারবে না তবে অকারণ দুঃখ-হতাশা
শক্ত শাসনে তাদের না করে নিয়ন্ত্রণ
সঠিক জীবনবোধ শেখাতে হবে গ্রহন
আয়নার মতো স্বচ্ছ সংবেদনশীলতা
ভিত্তি তবেই হবে তাদের নির্মল সততা।
বিষয়: বিবিধ
২৭৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন