মা-ছেলের খুনসুটি......
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২২ অক্টোবর, ২০১৩, ০৫:১৫:১৬ বিকাল
এক.
ফজরের পর বিছানাতে শোবার পর প্রচন্ড পিপাসা লাগলো কিন্তু ঠাণ্ডার মধ্যে কম্বলের নীচ থেকে আবার বেড়োতে ইচ্ছে করছিলো না কিছুতেই। পুত্রকে বললাম, বাবা যাও তো আম্মুর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। কিন্তু সে উঠলো তো না-ই উল্টো আরো আমার কোল ঘেঁষে এলো। পিপাসা মেটানোর ইচ্ছা পরিত্যাগ করেই দিচ্ছিলাম ঠিক তখন দেখি পুত্রের পিতা পানি নিয়ে হাজির। আমার জাযাকাল্লাহ এর জবাবে উনি খোঁচা দিয়ে বললেন, ছেলেকে কি বায়েজীদ বোস্তামী মনে করেন নাকি? খালি আহ্লাদ না দিয়ে বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন বিষয়ক কিছু কথাও শেখান আপনার ছেলেকে। এক গ্লাস পানির বদলে এত বড় কথা ছোট্ট একটা শিশু বাচ্চাকে মিন করে? মা হয়ে পুত্রের বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ সহ্য করা অসম্ভব। নাকীবকে তখনি বায়েজীদ বোস্তামীর মাকে পানি পান করানোর সেই ঘটনা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে বললাম, দেখেছো মাকে কত ভালবাসতেন। এমন হলে তুমি কি করতে? জবাবে বলল, আম্মু আমি পানি নিয়ে এসে তোমাকে ডেকে তুলতাম। তুমি উঠতে না চাইলে যন্ত্রণা দিয়ে জোর করে উঠাতাম। পিপাসা নিয়ে তোমাকে ঘুমাতে দিতাম না। পিপাসায় তুমি যদি ঘুমের মধ্যে মারা যাও তাহলে আমার কি হবে? আমি তো স্তম্ভিত! হায় আল্লাহ আমি কি বুঝালাম আর আমার পুত্র কি বুঝলো। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা স্বরূপ পাশের ঘর থেকে ভেসে এলো পুত্রের পিতার অট্টহাসি।
দুই.
বাসায় থাকলে আমরা মা-ছেলে সবসময় একসাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করি। গতকাল মাগরিবের সময় ওকে ডেকে নামাজে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরই নাকীবের মনে পড়লো তার ওজু নেই। জায়নামাজ থেকে নেমে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, আম্মু কাজটা ঠিক করেনি।নামাজে দাঁড়ানোর আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, নাকীব ওজু করেছো? আমি বলতাম, না। আম্মু বলত, তাহলে অজু করে আসো। আমি তখন ওজু করে আসতাম, তারপর দুজন নামাজ পড়তাম। এটা আমার ভুল না কিন্তু আম্মু নামাজ শেষ করেই বলবে, এটা কি হল? কাজটা কি তুমি ঠিক করলে? অথচ ভুল আম্মুর। এমন ননস্টপ বিড়বিড় করতে করতে সে ওজু করে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। নামাজ শেষ করার সাথে সাথে বলল, আমার কিন্তু কোন দোষ নেই। তুমি জিজ্ঞেস না করে ভুল করেছো। বললাম, হ্যা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি খুব স্যরি। ব্যাস শুরু করলো আমাকে জ্ঞানদান করা। যার সারমর্ম হচ্ছে সবসময় যাতে নামাজে দাঁড়ানোর আগে জিজ্ঞেস করে নেই ওর ওজু আছে কিনা। আমি বাধ্য মায়ের মত সব কথা মেনে নিলাম চুপচাপ।
তিন.
স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার যুক্তিবাদী পুত্রের সাথে একচোট যুক্তি-তর্ক হয়ে গেলো। বিষয় ছিল একা একা স্কুলে যাওয়া। আমাদের বাসার গেট থেকে নাকীবের স্কুল দেখা যায় কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই পথটুকু যেতে তিনটা সিগন্যাল পেড়োতে হয়। সুতরাং ওকে একা ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু নাকীবের যুক্তি হচ্ছে, সে যথেষ্ট বড় হয়েছে এবং সিগন্যাল কিভাবে পেড়োতে হয় সেটা খুব ভালো মতো জানা আছে তার। আমি বললাম, তুমি এখনো অনেক ছোট তাই একা একা রাস্তা পেড়োতে পারবে না। জবাবে বলল, আম্মু তুমি আমাকে একদিন একা একা স্কুলে যেতে তো দাও। তখন না বুঝবে যে আমি কত বড় হয়েছি। তুমি যদি আমাকে না ছাড় তাহলে জানবে কি করে আমি কি পারি আর কি পারি না। এই যুক্তির পর আর কি বলবো খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। কিন্তু এত সহজে দমে যাবার পাত্র আমার পুত্রটি নয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আম্মু আমার কত বছর বয়স হলে তুমি আমাকে একা একা স্কুলে যেতে দিবে? বললাম, আঠারো বছর হলে। চোখ বড় বড় করে বলল, আঠারো বছর? আমার তো মাত্র আট বছর বয়স। তারমানে তো আরো দশ বছর বাকি। উহু এটা হবে না। বারো বছর হলেই আমি একা একা স্কুলে যাবো। বললাম, আচ্ছা তোমার আগে বারো বছর হোক তখন দেখা যাবে। সন্তুষ্ট না হলেও আর কথা বাড়াল না। আমিও স্বস্থির শ্বাস ছাড়লাম। যাক আগামী চার বছরের জন্য যুক্তি-তর্কের একটা বিষয় অন্তত কমলো।
চার.
কেমন যোগ করা শিখেছে সেটা পরীক্ষা করার জন্য পুত্রকে সুপার মার্কেটে নিয়ে গিয়ে দশ ইউরো দিয়ে বললাম, দশ ইউরোর মধ্যে তোমার পছন্দনীয় খাবার কিনো। খেয়াল রাখবে যেন সব মিলিয়ে দশ ইউরোর বেশি না হয় কিছুতেই। এটা কোন ব্যাপার হল এমন ভঙ্গী করে হাত থেকে টাকা নিয়ে সে ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর বিশ্ব জয় করেছে এমন ভাব নিয়ে ফিরে এলো। কাউন্টারে গিয়ে টাকা দিতে গিয়ে দেখা গেলো কাটায় কাটায় দশ ইউরোর বাজার করেছে। আমি তো মহা আনন্দিত হলাম। আদরে আদরে লাল করে দিলাম বাবা সোনাটাকে। কিন্তু ওর ঠোঁট টিপে হাসিটা একটু কেমন কেমন লাগাতে হাসির রহস্য কি জানতে চাইলাম। জবাবে বিচ্ছু ফিক ফিক করতে করতে বলল, আমি কি করেছি জানো? কঠিন যোগ করতে হবে এমন কোন খাবারই কিনিনি। আমি তিন ইউরো দিয়ে কেক কিনেছি, বিস্কিট কিনেছি দুই ইউরো দিয়ে, ব্রেড কিনেছি আড়াই ইউরো দিয়ে আর বাকি আড়াই ইউরো দিয়ে কিনেছি চকলেট। হিহিহি...! বললাম, হিহিহি...বন্ধ। তুমি একটা দুষ্টু বাচ্চা। বলল, আম্মু তুমি শুধু ভুল কথা বলো। আমি দুষ্টু না অনেক বুদ্ধিমান বাচ্চা। তোমার উচিত আমাকে নিয়ে গর্ব করা। মনেমনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ্! গর্ব তো করিই তোমাকে নিয়ে বাপজান কিন্তু পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বলার মত পাগল তোমার আম্মু না।
পাঁচ.
আমাদের গেটের বাইরেই নতুন একটা আইসক্রিমের দোকান হয়েছে। আমার পুত্র একা একা সেই দোকান থেকে গিয়ে আইসক্রিম কিনে নিয়ে এলো। মাত্র একমিনিট সময় লেগেছিল আমার চোখের আড়াল হয়ে আইসক্রিম কিনে ফিরে আসতে। জীবনে এই প্রথম নাকীব একা মেন গেটের বাইরে গেলো। ছেলের চিন্তায় একমিনিটের জন্য আমার মনের সব শান্তি বনবাসে চলে গিয়েছিলো। গেটের গ্লাসে ওর চেহারাটা দেখার পর আনন্দাশ্রু চোখের কোনে ঝিলমিল করে উঠেছিলো। আর একা একা আইসক্রিম কিনে এনে বিশ্বজয়ী বীরের বেশ ধারণ করলো নাকীব। একা কিছু করতে পারার আনন্দে আত্মহারা যাকে বলে। আমাকে শুনিয়ে দিল ছোট একটা লেকচার, এখন আর সে ছোট নেই। আমাকে ছাড়াও অনেক কিছু করতে পারে। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে আবার ছোট্ট বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। সব মায়েরাই চায় তাদের সন্তান অনেক বড় হোক কিন্তু সাথে সাথে মায়েরা তাদের মনের কোণে সন্তানের গুড্ডু গুড্ডু বেবী ইমেজটাও লালন করে বহু যতনে।
বিষয়: বিবিধ
২৫৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন