বাবার চিঠি......

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৮ অক্টোবর, ২০১৩, ০৪:০৩:২৬ বিকাল



লেটার বক্স খুলেই মহিমার মনের মেঘলা আকাশে খুশীর বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। মাত্র এক ঝলক আলো কিন্তু কি প্রচণ্ড তার ক্ষমতা, মনের প্রতিটি কোণে পৌছে গেলো সেই আলোর আভা। লেটার বক্সের ভেতর গুটিসুটি মেরে বসে থাকা চিঠিটাকে তার মনেহচ্ছিল শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে আসা শুভ্র কবুতর। মনের যে আকাশ জুড়ে নেমে এসেছিল ক্লান্তির সূর্যাস্ত, হঠাৎ সেখানে জ্বলে উঠলো সন্ধ্যাবাতি। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বাবার চিঠিটা বের করে নিলো সে। কেমন যেন শূন্যতার এক অনুভূতি খেলা করছিল অস্তিত্ব জুড়ে, কিন্তু বাবার চিঠি পুর্ণতার আনন্দাশ্রুতে ভরে দিলো আঁখিদ্বয়। ভীষণ লম্বা আর বিরক্তিকর দিনের শেষটা যে এত আনন্দময় হবে ভাবতে পারেনি। ছোট ছোট অনাকাঙ্ক্ষিত সুখ প্রাপ্তির খাতার কয়েক পৃষ্ঠা কেমন এক ঝাটকায় ভরে দেয়। চিঠিটাকে বুকে চেপে ধরে মনে মনে বলল, আমার প্রিয় বাবা আপনার চিঠি পেয়ে আমার কাছে মনেহচ্ছে প্রচণ্ড রৌদ্রে হঠাৎ এক টুকরো মেঘ এসে দাঁড়িয়েছে আমার মাথার উপর। শুকরিয়া বাবা এমন টুকরো টুকরো আনন্দ আমাকে উপহার দেবার জন্য। এমন আনন্দগুলো ছাড়া যে থমকে যেত আমার জীবনের সামনে এগিয়ে যাবার গতি।



চোখ বন্ধ করে চিঠিটা বুকে চেপে ধরে অনুমান করার চেষ্টা করলো কি লিখেছেন বাবা এই চিঠিতে? বেশির ভাগ সময়ই মহিমার অনুমানের বর্ণের সাথে বাবার চিঠির শব্দগুলো মিলে যায়। মাঝে মাঝে মহিমা নিজেও অবাক হয়ে ভাবে বাবা কিভাবে বোঝেন, কখন তার কোন বিষয়ে পরামর্শ দরকার? জীবনের চলার পথে যখনই মহিমাকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে কোন কারণে, বাবার শব্দরা কখনো সিঁড়ি তো কখনো সাঁকো হয়ে তার সামনে এগিয়ে যাবার পথকে সুগম করে দিয়েছে। নতুন স্কুলে যাবার পর সহপাঠীরা সবাই যখন তার মুখের একপাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দাগটার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছিলো। মনে পড়েছিল গেটে ঢোকার সময় বাবা তার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, মন খারাপ লাগলে এটা খুলে পড়িস মা। স্কুল থেকে ছুটে বেড়িয়ে যাবার ইচ্ছেটা দমন করে চোখের সামনে মেলে ধরেছিল চিরকুটটি। লেখা ছিল, মানুষের স্বভাবই হচ্ছে দাগ খোঁজা। আর মানুষের এই স্বভাব থেকে আকাশের চাঁদ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। কিন্তু তাতে কি? চাঁদে যদি হাজার দাগও তো থাকে তারপরও সেটা চাঁদ। ঝকমক করে, আলো দেয়, মানুষকে মুগ্ধ করে, আপ্লুত করে, মানুষ তাকে পেতে চায়। কারণ শত দাগের ভিড়েও চাঁদ সামথিং স্পেশাল। মনের সমস্ত সংকোচ মুহুর্তে দূর হয়ে গিয়েছিলো মহিমার। সেই থেকে শুরু বাবার সাথে চিঠির মাধ্যমে মনের ভাব আদান-প্রদান।



মহিমার স্বামী প্রায়ই দুষ্টুমির ছলে খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করেন, যোগাযোগের অত্যাধুনিক এত শত মাধ্যম থাকতেও তোমরা বাবা-মেয়ে কবুতরের ঠোঁটে ঝুলিয়ে চিঠির আদান-প্রদান কেন করো বলতো? মহিমা জবাবে কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসি দেয়। কি জবাব দেবে? সব অনুভূতি কি শব্দে ধারণ করা যায়? তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে সব অনুভূতিকে শব্দে প্রকাশ করতে যাওয়া ঠিক না। তাতে অনুভূতি তার সঠিক মূল্যায়নের পুরুত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। আর বাবার চিঠির প্রয়োজনীয়তা? এই তো সেদিন এক ফ্রেন্ডকে গ্রুপ থেকে বাদ দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। শত খুঁজেও তারমধ্যে আশার কিরণ দেখতে পাচ্ছিলো না বলে। একটা প্রসঙ্গে বাবা চিঠিতে লিখেছিলেন, আশা কোন হারিয়ে যাওয়ার জিনিস না যে তাকে খুঁজে বেড়াতে হবে। আশার অবস্থান মনের মাঝে। তাকে শুধু জাগাতে হয় আর ধরে রাখতে হয়। আর আশা অনেকটা বীজের মত। বীজ বোনার কিছুদিন পর চারাগাছের জন্ম হলেও সেটা বড় হতে সময় লাগে। তবে বড় অবশ্যই হয় যদি তুমি ঠিকমত যত্ন করো, পানি দিয়ে মাটিকে নরম রাখো, অনুকূল আবহাওয়া দিতে পারো।



পড়তে পড়তে চিঠির শেসের ক’টা লাইনে চোখ আঁটকে গেলো মহিমার। বাবা লিখেছেন, মাঝে মাঝে মনেহয় সবার জীবনেই এমন দু’একটা দিন আসে, যে দিনটা শেষই হতে চায় না। ঘড়ির সদা চঞ্চল সেকেন্ডের কাঁটাটি সেদিন দুরন্ত বালিকার বেশ ছেড়ে নববধূর মত ধীর গতিতে পথ চলে। কাজ করতে করতে শরীর মন সব ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যায় কিন্তু সূর্যিমামা হেলে পড়ার কোন নামই নেয় না। অবশ্য চোখের পলকে কেটে যায় এমন দিনও প্রায়ই আসে। ছুটে চলার প্রতিযোগিতায় সময় কোনদিন খরগোশ তো কোনদিন কচ্ছপের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করে। সমস্যা হচ্ছে যেদিন কচ্ছপ গতির দিন চাই সেদিন সময় খরগোশ গতিতে ছোটে। আর যেদিন মন উড়তে চায়, সময় পরিণত হয় উটপাখিতে। হুমম...নামে তো পাখি কিন্তু উড়তে সে জানে না। হেসে ফেললো মহিমা, মন জুড়ে বয়ে গেলো প্রশান্তির দক্ষিণা বাতাস। সত্যিই তো সে আজ খরগোশের গতিতে ছুটতে চেয়েছিলো, উড়তে চেয়েছিলো ডানা মেলে। কিন্তু প্রতিটা সেকেন্ড পার করতে হয়েছে গুণে গুণে।



আচ্ছা চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে এত অমিল কেন? এই প্রশ্নের জবাবে বাবা কি বলেছিলেন মনেকরার চেষ্টা করলো মহিমা। কারণ আমরা বেহিসেবী চাই আর পাওয়াকে মূল্যায়ন করতে পারি না যথাযথ। বাবা-মা হচ্ছেন সন্তানদের জন্য কখনো না শেষ হওয়া জ্ঞানের ভাণ্ডার। সেই গুপ্তধন যা জীবনকে করে তোলে ঐশ্বর্যময়। হুমম...জ্ঞানের ভাণ্ডারই তো বাবার মহিমার জন্য। আর বাবার এসব চিঠিই তো তার জীবনকে করে তুলছে ঐশ্বর্যময়।



বিষয়: বিবিধ

২১৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File