শিশুদের মনোজগতে শাস্তির প্রভাব
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২১ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:২৯:২৯ দুপুর
সপ্তাহে একদিন অনলাইনে আমরা সহপাঠীরা কয়েকজন মিলে পুরো সপ্তাহে ক্লাসে যেসব বিষয়ে টিচাররা লেকচার দিয়ে থাকেন সেসব নিয়ে আলোচনা করি। বন্ধুরা মিলে গ্রুপ ওয়ার্ক করতে বসলে কথা কখনোই একটা বিষয়ে স্থির থাকে না। আলোচনার এক ফাঁকে খাবার নিয়ে কথা উঠলো। একসময় দুপুরে কে কি খেয়েছে জানতে চাওয়া হলো। আমার হাজবেন্ডের ডাল ভীষণ পছন্দ তাই ডাল অবশ্যই থাকে দুপুরের মেন্যুতে। ডালের কথা শুনেই এক ফ্রেন্ড হাসতে হাসতে বলল, আপু কেন যে ডালের কথা মনে করিয়ে দিলেন। এখন আমার চোখের সামনে ডাল ঘুটনি ভেসে উঠবে আর তারপর মনে পড়বে ডাল ঘুটনি দিয়ে আম্মুর আমাকে পিটানোর কথা। ঘটনা কি জানতে চাইলে সে জানালো যে, ছোটবেলায় দুষ্টুমি করলেই ওর আম্মু ডাল ঘুটনি দিয়ে ওকে পিটুনি দিতো। সেই থেকে ডাল আর ডাল ঘুটনির প্রতি ওর মনে সামান্য বিদ্বেষ কাজ করে। হাসির একটা মৃদু স্রোত বয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু সেটা থামতেই একজন বলল, ছোটবেলায় চাচা আমাকে পড়াতেন। কিছু ভুল করলেই দুই আঙ্গুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ দিতেন, নয়তো পেটের মধ্যে পেন্সিল দিয়ে মোচর দিতেন। আরেকজন বলল, আমি দুষ্টুমি করলেই আম্মু বাথরুমের লাইট বন্ধ করে আমাকে আটকে রাখতো। অন্য আরেকজন বলল, তার বাবা নাকি কিছু হলেই শুধু কান ধরে উঠ-বোস করাতো। সংখ্যা একশোর নীচে হতো না কখনই।একেকজনের বিচিত্র শাস্তির বর্ণনা শুনে আমি ঠিক কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত ছোটবোনের বাসায় গিয়েছিলাম। দুজন মিলে রান্নাঘরে বসে কথা বলছিলাম আর বাচ্চারা খেলছিলো। এক সময় শুনি যে ওর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়েটা দেড় বছর বয়সী ছোট ভাইকে বলছে, এই দুষ্টুমি করবে না বলছি তাহলে কিন্তু শলা নিয়ে আসবো। শলার দুইটা বাড়ি যখন পিঠে পড়বে সব শয়তানী ভুলে যাবে। বোনটির লজ্জা রাঙা চেহারা দেখে বুঝলাম মায়ের যোগ্য উত্তরসূরীই হয়েছে কন্যা। পরিচিত আরেক বোনকে ফোন করেছিলাম শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য। বাচ্চার চিৎকার শুনে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। জবাবে হাসতে হাসতে বললেন, এত দুষ্টুমি করে তাই বাথরুমে আটকে দিয়েছি আপু। কিছুক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। নাহ কিছুই বললাম না। আজকাল কেন জানিনা আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না কাউকে। বাচ্চার গায়ে হাত তোলা ঠিক না এই ব্যাপারে আলোচনার পর দিনই বোনদের কাছ থেকে ফোনের পর ফোন। বিষয় না মারলে বাচ্চারা কথা শোনে না। সমস্যা হচ্ছে অভ্যাসকে নিজেদের দাস বানানোর যোগ্যতা আর কয়জনেরই বা হয়? আমরা বেশির ভাগই তাই অভ্যাসেরই দাস। এখন পাঁচ বছর মেরে কথা শোনানোর অভ্যাস করা হয়েছে যে বাচ্চাটাকে, না মেরে কথা শোনানোর জন্যও তো কিছু সময় দিতে হবে তাকে। কিন্তু গঠনমূলক কাজে সময় ব্যয়ে আমাদের বরাবরই অনীহা একটু বেশি। দুইটা থাপ্পড়ে যেখানে কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছে সেখানে দুই মিনিট বসে বোঝাতে যাবো কোন দুঃখে??
আর উদাহরণে যাচ্ছি না কারণ এমন বিচিত্র শাস্তির সাথে কম-বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু এই ধরণের শাস্তিগুলো শিশুদের মনোজগতে কি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সেই ব্যাপারে সবাই অবগত নই। আবার যাদের মনোজগত সম্পর্কে ধারণা কম তাদেরকে অবগত করতে গেলেও বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। শিশুদের মনোজগতে শাস্তির প্রভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে এক বোন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, শিশুরা বড় হলে এসব কথা মনে রাখে না। আমাদের সাথেও এমন হয়েছিলো তাতে কি আমরা ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে গিয়েছি? মোটেই না ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা ঠিক শিশুরা বড় হলে এসব কথা মনেরাখে না কিংবা তাদের মনে থাকে না। কিন্তু অবচেতন মনে ঠিকই কথাগুলো বা ঘটনাগুলোর প্রভাব থেকে যায়। আর থেকে যায় বলেই তো যখনই এই ধরণের শাস্তি কাউকে পেতে দেখে বা শোনে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনকে ছুঁয়ে যায় বিস্বাদ কিংবা বেদনা। এটা ঠিক বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তো কারো কারো কাছে ছোটবেলার সেসব স্মৃতি হাসির খোঁড়াক বা বিনোদনে পরিণত হয়। কিন্তু যারা এমনটা ভাবেন তারা একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন যে, ছোটবেলায় শাস্তি দিয়ে তারা বড় হলে কি হবে সেই চিন্তা করছেন কিন্তু শিশু কালের প্রভাবের কথা ভুলে যাচ্ছেন। বড় হয়ে শিশুটির যখন জ্ঞান হবে সে অবশ্যই বাবা-মা বা যাদের দ্বারা শাস্তি পেয়েছে তাদের সবকিছুকে কল্যাণকর ভাববে। কারণ সে বুঝবে যে শাস্তি দেবার মত কাজ সে করেছিলো আর এরফলে সে সাবধানী হয়েছিল। কিন্তু এই বুঝটা কি তার ছোটবেলায় ছিল নাকি থাকা সম্ভব?
শিশুরা অন্যায় বা ভুল করবেই, তা না হলে আর শিশু কেন তাই না? তাই এমন কিছু হলে শিশুদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সে কি ভুল করেছে, কেন এটা করা ঠিক না, এটা করার ফলে কি কি হয়েছে ইত্যাদি। অনেক সময় আছে বুঝিয়ে বলার পরও শিশুরা একই কাজ বার বার করতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে আমাদের নিজেদের দ্বারাও কি অনেক সময় একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয় না? সেক্ষেত্রে শিশুদের জন্য তো এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই ধৈর্য্য ধরে বোঝানোর চেষ্টা জারি রাখতে হবে। তাছাড়া সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারলে শিশুরা বেশির ভাগ সময়ই সেটা মেনে চলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে শিশুরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা তাদের সামাজিক দক্ষতা, অন্যের আবেগকে বোঝার বা ইতিবাচক-নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি হওয়াকে প্রভাবিত করে। অন্যায় বা ভুল করলে তাদের সাথে কেমন আচরণ করা হয় সেটা দেখেই তারা অন্যের ভুল বা অন্যায়কে মূল্যায়ন করে। তাই শিশুদের ভুল গুলোকে বুঝিয়ে বলে তাদেরকে উৎসাহিত ও সাহায্য করতে হবে এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে। তা না করে যদি সমালোচনা করা হয় বা শাস্তি দেয়া হয় শিশুর মনে নিজেকে ঘিরে নেতিবাচক চিন্তা তৈরি হয়। আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় যে বাবা-মা এই বিশ্বাসে চিড় ধরে। সর্বাবস্থায় বাবা-মাকে পাশে পাবে কি পাবে নয়া এই ভরসা থাকে দোদুল্যমান।
আসলে একটা শিশু যাতে বড় হয়ে একজন আদর্শ মানুষ হতে পারে তারজন্য দরকার শুধু একটা জিনিসের, সঠিক অভিভাবকত্ব। একমাত্র সঠিক অভিভাবকত্বই পারে একটি শিশুকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, তাকে সুখী-সুন্দর ও সুস্থ জীবন দিতে। কেননা শিশুদের মানসিক বিকাশ অনেকটা অংশই নির্ভর করে পরিবারের সদস্যরা তাদের ভুল বা অন্যায় গুলো কিভাবে দেখছে এবং সংস্কারের চেষ্টা করছে তার উপর। শিশুকে ভুল করলে প্রয়োজনে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে কিন্তু তা দিতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে। ভুলে গেলে চলবে না যে শিশুরা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা থেকে শিখতে থাকে এবং সংগ্রহ করতে থাকে চলার পথের পাথেয়। আর শিশুরা হচ্ছে আয়না। আর আয়নার বুকে সেই প্রতিচ্ছবিই দেখা যায় যা তার সামনে আনা হয়।
বিষয়: বিবিধ
৩২১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন