শিশুদের নিজেকে গড়ার প্রতিযোগিতা (রামাদান)

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৪ আগস্ট, ২০১৩, ০২:২৮:৪০ দুপুর



রামাদানের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বড় ভাইয়া আমাদের ছোট সব ভাইবোনদেরকে বসিয়ে বলেছিলেন যে, প্রতিটি কাজ বা ব্যবসার যেমন একটা মৌসুম থাকে রামাদান মাস হচ্ছে মুসলিমদের জন্য নেক আমল অর্জনের মাস। আরো বলেছিলেন যে রামাদানের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ট্রেনিং দেয়া। আর রামাদানের অনেক বড় একটা উপলব্ধি হচ্ছে আমাদের চারপাশে গরিব-দুঃখী যারা অর্ধাহারে অনাহারে জীবন-যাপন করে তাদের কষ্টকে কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়। আমাদেরকে উৎসাহিত করা হতো সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর। রামাদানে আমাদের চাওয়া থাকতো ভালো ভালো কাজ করার। প্রায় সমবয়সী দশজন ভাইবোন ছিলাম আমরা কাজিনরা সবাই মিলে। কে কার চেয়ে বেশী নেক আমল অর্জন করতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলতো আমাদের সবার মধ্যে। বিভিন্ন কাজ বা আমলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাবা আর ভাইয়ারা প্রতিযোগিতার সেই আগুনে ঘি ঢালতেন পর্দার আড়ালে বসে।

এবার দেখলাম যে আমাদের বাচ্চারা সেই বয়সে এসে পৌছেছে যে বয়সে রামাদানে আমরা প্রাণপণ ছুটতাম নিজেকে গড়ার প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাংলাদেশ আর ইউরোপের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গরিব-দুঃখী-অর্ধাহারী-আনাহারী-অসহায় এখানেও আছে কিন্তু চোখ মেলে তাকালেই তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুভব করতে হয় অনেক কিছুই যা বাচ্চাদের দ্বারা সম্ভব না। (বাচ্চাদেরকে দানশীলতা শেখানোর জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি অন্যকোন লেখায় সে বিষয়ে লিখবো ইনশাআল্লাহ।) তাই ভাবলাম যে এই রামাদানে এমন কিছু করতে যা ওদেরকে আমল করতে উৎসাহিত করবে। নুহেরি স্কুল বন্ধ করার আগেই ঘোষণা দিয়েছে যে এবার রামাদানে সে হিফজ কমপ্লিট করবে। ছোটবেলা থেকেই নুহেরির শখ হিফজ করার। কেউ ওকে বাধ্য কিংবা উৎসাহিত কোনটিই করেনি। ওর বাবা-চাচ্চুদের কথায় কথায় কুরআনের আয়াত বলাটা ওকে খুব স্পর্শ করেছে। তাই নিজ থেকেই আবদার করেছিলো হিফজ করার। কারণ সেও চায় আল্লাহর কালাম বুকে ধারণ করতে আর তার দ্বারা মানুষকে হেদায়াতের পথে ডাকতে।

ঈদকে সামনে রেখে আমরা একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কে কত বেশি ভালো কাজ করতে পারে এটা হচ্ছে প্রতিযোগিতার থীম। পাশাপাশি ঈদের বিশেষ আকর্ষন হিসেবে রাখা হয়েছে কুরআন তিলাওয়াত, সূরা মুখস্ত করা, ইসলামিক কুইজ আর পুরো রামাদানে ভালো কাজের মূল্যায়নকে। বাচ্চাদের ভালো কাজের যন্ত্রণায় আমাদের অবস্থা অবশ্য খুবই শোচনীয়। সাড়ে তিন বছর বয়সী নুবাঈদ যখন ভালো কাজ করার উদ্দেশ্যে রান্না করার জেদ করে, কিংবা পাঁচ বছর বয়সী যারীন যখন এসে বলে দাও ঘর মুছে দেই, তখন না বলাটাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। বাচ্চারা ভালো কাজ বলতে যে সবার আগে মাকে সাহায্য করা বোঝে বিষয়টা আবারো পরিস্কার হয়ে গেলো আমার কাছে। মায়ের পায়ের নীচে জান্নাত এই তথ্য জানা না থাকলেও, মাকে খুশি করতে পারলে যে অনেক কিছুই খুব সহজে হাসিল করা সম্ভব হয় এই জিনিসটা খুব ভালো বোঝে বাচ্চারা। তাই সবার আগে মাকে সাহায্য করা চাই।

তবে যারা আট থেকে এগারো বছর বয়সী তাদের প্রতিযোগিতা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। চেষ্টা করছে রোজা রাখতে, নিয়মিত তিলাওয়াত করছে, কুইজে ভালো করার জন্য ইসলামী বইপত্র পড়ছে, নিয়মিত নামাজ আদায় করছে, পরিবারের সবাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করছে, ছোট ভাইবোনদের খেয়াল রাখছে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একে অন্যকে সাহায্য করছে। এই জিনিসটা আমাদের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব রাখে। প্রতিযোগিতা যেন ভাইবোনদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাবের জন্ম না দেয় এটা অবশ্যই বড়দের খেয়াল রাখতে হবে। ভালো কাজের প্রতিযোগিতায় জেতার চেষ্টাতে যেন একে অন্যকে পেছনে ঠেলে দিতে না চায়। বরং যেন হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলে সম্মুখ পানে। যে কোন লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ খুব প্রয়োজন। আর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যদি বাচ্চাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, নীতিবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ না থাকে তাহলে এর দ্বারা নিজেকে গড়া বা আত্মোন্নয়ন সম্ভব হবে না কখনোই।

আসলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নতুন প্রজন্মকে ইসলামের পথে চলতে উৎসাহিত করাটা এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পারিবারিক অঙ্গনেও এই চেষ্টাটা থাকা উচিত আমাদের। কেননা পারিবারিক সুশৃঙ্খল পরিবেশ- পরিস্থিতির মধ্যে যদি শিশুরা বড় হয় তাহলে তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী কোন আচরণ ঢোকে না। তাই পারিবারিক পরিবেশে ন্যায়, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা, স্বাস্থ্য-সচেতনতা, জ্ঞানানুরাগ এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতির মধ্যে শিশুদের বড় করে তুলতে হবে। বাবা বলেতেন যে, মানবজীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলতে এবং সত্যিকার মানুষ হতে প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ। দরকার মনুষ্যত্ব অর্জন। আর নীতিবানের সংজ্ঞায় বাবা শিখিয়েছিলেন, সত্যকে যে সত্য বলে, অন্যায়কে অন্যায় বলে এবং ন্যায়–অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ জেনে, বুঝে এবং মেনে চলে সেই হচ্ছে নীতিবান। নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং অনুসৃত জীবনের মূল্যবোধকে নৈতিকতা বলে। আর শোভন রীতিনীতি ও আদর্শ অনুসারী জীবনচর্চার অভিব্যক্তি হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ। আমরাও এই রামাদানে আমাদের বাচ্চাদেরকে এসব শেখাতে চেষ্টা করছি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।



বিষয়: বিবিধ

২৮৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File