সুখের মুহুর্তগুলো(ইটালি সফরের)
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০১ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:৫১:৩৭ রাত
ভিক্সিনের একটি পার্ক
জীবনটা যে কতো সুন্দর সেটা নাকি ফেলে আসার পরই বোঝে মানুষ। আমিও অবশ্য এমনটাই মনেকরি। তাই তো জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনার স্মৃতি আমার কাছে খুব বেশি মূল্যবান। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, আনন্দ-বেদনা এবং পাওয়া-না পাওয়ায় ভরা আমাদের জীবন...জীবনের প্রতিটা দিন...প্রতিটা ক্ষণ। জীবন থেকে না পাওয়া, অপুর্নতা, কষ্ট এসব কিছুই কাম্য নয় আমাদের কারোই। কিন্তু যেহেতু এগুলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাই সেগুলোকে এড়িয়ে না গিয়ে, মুছে ফেলার চিন্তা না করে কিভাবে সেগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া যায় এবং সেই শিক্ষার দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাসমূহ থেকে দূরে থাকা যায় এমন চেষ্টাই থাকে আমার। আরেকটা চেষ্টা থাকে আমার সেটা হচ্ছে আনন্দময় মুহুর্তগুলো নাগালের মধ্যে রেখে একই আনন্দ বার বার উপভোগ করে জীবন ভাণ্ডারে আনন্দের মাত্রা বাড়ানো। ইটালি সফরও আমার জীবন ভাণ্ডারে এনে দিয়েছে অমূল্য কিছু স্মৃতি নামক রত্ন।
নাকিবের তোলা ছবি
নাকিব বড় হবার পর ওকে নিয়ে এই প্রথম ট্রেন জার্নি ও প্লেন জার্নি করলাম। ইমগ্রেশন, চেকিং কোন জায়গাতে নাকিবের পাসপোর্ট শো করা লাগছিলো না যেহেতু সে জন্মসূত্রে ইউরোপিয়ান কিন্তু আমাদেরটা শো করতে হচ্ছিলো। বাচ্চাদের সতর্ক ও কৌতূহলী দৃষ্টি ও মন সেটা এড়াতে পারলো না। কেন তার পাসপোর্ট কোথাও দেখাচ্ছে না জানতে চাইলো বাবার কাছে। আমরা এশিয়ান আর ও ইউরোপিয়ান জানার পর তো শুরু করলো প্রশ্নের বাণ ছোড়া। আমার আর ওর বাবার জন্ম, বিয়ে, স্পেন আসা পুরো ইতিহাস জেনে তবেই শান্ত হলো। জবাব দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন হাসান। উনার সেই প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েও হাসি মুখে ছেলের ননস্টপ প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাওয়ার মুহুর্তটা মনে পড়লে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
প্লেনের জানালার কাছে বসে বাইরে মেঘ থেকে মোটে চোখই সরাচ্ছিলো না নাকিব। খুবই সিরিয়াস মুড। চোখে সতর্ক দৃষ্টি। কারণ কি জানতে চাইলে বলল, যে কোন সময় মেঘদের মধ্যে এঞ্জেল দেখা যেতে পারে সেটা সে মিস করতে চায় না। একঘণ্টা পর ক্লান্ত হয়ে বলল, বাবা এঞ্জেল কখন আসবে? বাবা বুঝিয়ে বলার পর তো এঞ্জেল দেখতে পারবে না জেনে প্রচণ্ড আশাহত হয়ে বিরাট বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিছুক্ষণ নাকিব। ইশশ...এখনো ভাবতে মজা লাগে সেই মুহুর্তটা।
স্কাইপে আফনান-সারা ওদের সাথে নিয়মিত দেখা হলেও সামনাসামনি প্রথম দেখার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম। সাদিয়া আপুকে দেখার পর ভালোবাসাময় সেই আলিঙ্গন। একদিন ভোরে উঠে নাস্তা বানিয়ে রেখে আমি আর আপু বেড়িয়ে গিয়েছিলাম শপিং করতে। সেই দিনটার কথা খুব মনেপড়ে। সারাপথ দুজন ননস্টপ বকবক করেছি। কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা এমন একটা মুহুর্ত ছিল কিন্তু মনে মনেও না আবার একা একাও না। সাথে ছিল সাথী হয়ে মনের মতো বোন...বান্ধবী। আলহামদুলিল্লাহ্...
এই পথ ধরেই হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম
ভিক্সিন গিয়ে একদিন বিকেলে ঘুরতে বের হয়ে গল্প করতে করতে নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে এতো দূর চলে গিয়েছিলাম যে ফেরার পথে আর পা চলছিলো না কারো। পাহাড়ি এলাকা উঁচু-নীচু, আঁকা-বাঁকা পথ কিন্তু যখন হাঁটছিলাম তখন টেরই পাইনি। হাসান বললেন, পাশে যখন নির্ভরযোগ্য সাথী থাকে তখন পথ যতই এবড়ো থেবড়ো হোক না কেন মানুষ নিশ্চিন্তে আর নির্ভিঘ্নে পথ পারি দিতে পারে। কি প্রমাণ পেলে তো আমি যে তোমার নির্ভরযোগ্য সাথী? উনার হাসি আর দুষ্টুমিতে ভরা এই বাক্যটিও অনেক বড় প্রাপ্তি আমার জন্য।
ট্রেন থেকে তোলা পাহাড়ের ছবি
পুরো ইউরোপ জুড়েই বইছে মন্দা হাওয়া। বাঙ্গালী ভাইয়েরা নানান ধরনের জটিলতা ফেস করছেন। ট্রেন ষ্টেশনে পরিচয় হলো এমন একজনের সাথে। বললেন উনার কষ্টের কথা, অভিমান ঝরে পড়লো ভাগ্যর উপর। যদি সামর্থ্যে কুলায় পৃথিবীর সবাইকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আমরা। তবে সেটা যে শুধু জাগতিক হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। একটু পাশে থেকে, দুঃসময়ে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে, মনের কোনে জমে থাকা অভিমানের মেঘকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে যেতে, উৎসাহমূলক কয়েকটা বাক্য দিয়েও মানুষকে সাহায্য করা যায়। ট্রেনে উঠার সময় সেই ভাইয়ের প্রশান্ত চেহারাটা দেখে আবারো এটা অনুভব করেছিলাম।
পাহাড়
সফরের কোন এক বাসার পরিবেশ ঢুকেই অনুকূল মনেহয়নি আমার কাছে। সম্পুর্ন ভিন্ন লাইফ স্টাইল আমাদের থেকে। হাসান বললেন, তুমি তো সারাক্ষণ সবাইকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে সবকিছু দেখার পরামর্শ দাও। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর অর্থ হচ্ছে, ভালোটা খুঁজে বের করা। কল্যাণটা যে করে হোক উপলব্ধি করা। মনে নেই রাসুল (সঃ) কি বলেছেন, “কারো কোন একটা খারাপ দিকের কারণে তাকে সাথে সাথে অপছন্দ করো না। তার অপর কোন একটা ভালো দিক থাকতেও পারে যার জন্য তুমি তাকে পছন্দ করতেও পারো।” সত্যিই উনাদের আতিথিয়তা আর আন্তরিকতা মুগ্ধ করেছে আমাকে।
পাহাড়ি নদী
কাস্তেল ফ্রাঙ্কোতে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি সবজী বাগান। একদিন বেড়িয়ে ছিলাম আইসক্রিম খেতে। তিনজন মিলে আইসক্রিম হাতে গল্প করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সেই স্মৃতিটা খুব নাড়া দেয় মনকে। পুরো সফরে ছেলে আর ছেলের বাবাকে এনজয় করতে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রতিমাসে একবার করে বের হবো উনাদের সাথে ঘুরতে। আশেপাশের গ্রামগুলোকে ইচ্ছে হলেই ঘুরতে যাওয়া যায়। নিজের ঘরকুনো স্বভাবের কারণে স্বামী-সন্তানকে যে অনেক আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছি সেই জিনিসটা খুব ভালো মতো উপলব্ধি করেছি।
বলোনিয়ার মাছের পার্ক
জীবনের অপ্রাপ্তিগুলোর হিসাব এতো বেশি করি আমরা যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুখগুলো দেখেও যেন দেখি না। অথচ ইচ্ছে করলেই জীবন থেকে খুঁজে নেয়া যায় আনন্দময় মুহুর্ত। আর যদি একটু নীচে তাকানো যায়। আমরা তো সুখী শুধুমাত্র আল্লাহ যে অবস্থানটা দিয়েছেন সেটার কারণে। কোন কারণে যদি অবস্থানটা বদলে যেতো তাহলে এতটা সুখী নাও হতে পারতাম। নিজেকে নিয়ে সুখী হবার জন্য মনেহয় এই উপলব্ধিটুকুই যথেষ্ট।
এই গাছটা দেখে ভীষণ ভালো লেগেছিলো
বিষয়: বিবিধ
২৮৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন