চাইল্ড ইমোশনাল অ্যাবিউজ
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৩৯:০৭ বিকাল
আমার ছেলের সাথে নিয়মিত যে কাজগুলো করি তারমধ্যে একটা হচ্ছে কার্টুন দেখা। আমাদের দুজনেরই সবচেয়ে প্রিয় কার্টুনটা শুরু হলেই, চিৎকার করে বলে, আম্মু কার্টুন শুরু হয়েছে আর আমিও ছুটে যাই দেখার জন্য। কোনদিন যদি কোন কারণে একসাথে কার্টুন দেখা না হতো, প্রচণ্ড অভিমান করতো। একবার একটানা প্রায় একসপ্তাহ বিভিন্ন কারণে আমি ওর ডাকে সাড়া দিতে পারিনি। খেয়াল করলাম তিন-চার দিন পর থেকেই ধীরে ধীরে ওর অভিমান কমছে এবং আমাকে ডাকা ছেড়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। তিন বছরে যে অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল, মাত্র একসপ্তাহে সেটা গতি হারালো। আবার অভ্যাসটা গড়তে অনেকদিন লেগেছিল আমার। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে আমাকে ডাকতে ভুলে যায় আর কোন কারণে ওকে সঙ্গ দিতে না পারলে তেমন অভিমানও করে না।
আমার ব্যালকনি থেকে আমাদের বাড়ির মেইন গেইট দেখা যায়। সকালে যখন ছেলেকে তার বাবা স্কুলে নিয়ে যায় আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নীচে দাঁড়িয়ে উপর দিকে তাকিয়ে আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর সে বাবার হাত ধরে গুটুগুটু পায়ে গেট দিয়ে বেড়িয়ে যেতো। একদিন ব্যস্ততার কারণে আমি ব্যালকনিতে দাঁড়াতে পারিনি। সেদিন স্কুল থেকে বেড়িয়ে সে একদম কান্না করে দিলো অভিমান আর কষ্টের প্রচণ্ডতায়। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলছিল, আমি বার বার উপরে তাকিয়েছি কিন্তু তুমি ছিলে না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একবার বেশ কয়েকদিন ব্যালকনিতে দাঁড়াতে পারিনি। যার ফলাফল প্রথম ঘটনার অনুরূপ। এখনো বেশির ভাগ সময় আমি ডাকলেই উপরের দিকে তাকায় সে, নয়তো না। আর কোনদিন না দাঁড়ালেও কোন অভিমান করে না।
চাইল্ড স্পেশালিস্টের সাথে কথা বলার পর জানলাম যে, শিশুরা যদি তাদের কোন আবেগের যথাযথ মূল্য না পায়, তাহলে একটা সময় সে আবেগের প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। আর নিজের আবেগকে প্রতিনিয়ত অবহেলিত হতে দেখার ফলে অন্যের আবেগকেও মূল্যায়ন করতে শিখতে পারেনা। এটা এক ধরণের ইমোশনাল অ্যাবিউজ যার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয় শিশুদের নিজেদের আবেগের প্রকাশ ও অন্যেদের আবেগকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা।
বাবা-মাদের একটা সমস্যা হচ্ছে সন্তানদের ভালোর চিন্তায় বা ভালোবাসার কারণে, নিজেদের পছন্দ বা ভালোলাগা গুলোকে সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। অনেক বাবা-মা আছেন নিজেদের জীবনের অপুর্ন স্বপ্নকে সন্তানদের দ্বারা পূরণ করতে চান। যার ফলে সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেন নিজেদের প্রত্যাশার ভার। জীবনে কি হতে বা কি পেতে চায় বোঝার আগেই শিশুদের শুনতে হয় তোমাকে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে কিংবা বিজ্ঞানী হতে হবে। নিজের স্বপ্নকে আবেগের সাথে উপলব্ধি করার আগেই বাবা-মার প্রত্যাশার বোঝা চেপে বসে কচি মন গুলোতে। স্বপ্নের পাখীরা আবেগের ডানার অভাবে হারিয়ে ফেলে উড়ার ক্ষমতা।
কম্পিটিশনের হাওয়া বইছে চারিদিকে। স্কুলের সাথে স্কুলের কম্পিটিশন, বাবা-মার সাথে বাবা-মাদের কম্পিটিশন, কোচিং সেন্টারের কম্পিটিশন, শিক্ষকদের কম্পিটিশন, হায় রে কম্পিটিশন......!!! নাইনটি পারসেন্ট মার্কস পেতে হবে, নাইটি ফাইভ পারসেন্ট মার্কস পেতে হবে......! এই ধরনের ইমোশনাল ব্লাকমেইল আর এক্সপেক্টটেশনের চাপে কোমল প্রাণ শিশুগুলোর শৈশবের আবেগ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আর সেই সাথে হ্রাস পায় আবেগের প্রকাশ, অনুভব, উপলব্ধির ক্ষমতা.......!!!
আমরা যেন ভুলে না যাই যে, সন্তানরা আমাদের সম্পত্তি না, আমাদের স্বপ্ন পূরণের কোন মাধ্যম না। বরং সন্তানরা আমাদের কাছে স্রষ্টার দেয়া আমানত। তাই তাদেরকে এমন করে গড়ে তোলা উচিত যাতে আমানতের খেয়ানত না হয়, বরং আমাদের জন্য হতে পারে সাদাকায়ে জারিয়া।
বিষয়: বিবিধ
১১৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন