পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ.....“শিশুহওয়া”
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৭ জুন, ২০১৩, ০১:৫৬:১০ দুপুর
গতকাল বিকেলে এক ভাবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় বিভিন্ন প্রফেশনের জটিলতা বিষয়ক আলোচনা হচ্ছিলো। আলোচনার এক পর্যায়ে ভাবীর নয় বছর বয়সি ছেলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমরা সবাই ভুল বলছো এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ 'শিশু হওয়া'। সবগুলো চোখ তখন বাচ্চাটির দিকে ঘুরে গেলো। সে একটুও দমে না গিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কথা স্বপক্ষে অনেক যুক্তি দিতে পারবো। তাকে তখন যুক্তি দেবার পারমিশন দেয়া হলো। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সে বলল, একটি শিশুকে যত কঠিন কঠিন কাজ করতে হয় তেমনটা বড়দেরকে কখনোই করতে হয় না। ঘুম থেকে উঠেই স্কুলের জন্য তৈরি হতে হয়। ইচ্ছে না করলেও নাস্তা খেতে হয়, দেরী হলে সাথে আম্মুর বকাও খেতে হয়। এরপর স্কুলে যাবার পর তো শুধু কাজ আর কাজ। অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ছবি আকাও, এক্সারসাইজ ক্লাস, একটার পর একটা হতেই থাকে। এক ঘণ্টার ব্রেক তাও টিচার সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কেউ দুষ্টুমি করলেই শাস্তি। বাসায় ফিরতে না ফিরতেই গোছল, খাওয়া, একঘণ্টা বিশ্রাম তারপর বসে হোমওয়ার্ক করা। দেড়ঘণ্টা খেলা করা তারপর বিকালের নাস্তা করা। আবার পড়তে বসা। কুরআন, জেনারেল নলেজ আরো কত কিছু শেখা। সারাক্ষণ একটার পর একটা করতেই থাকা। কোন কিছু করতে একটু দেরি হলেই বড়রা চিৎকার শুরু করেন। বড়দের ধারণা শিশুরা মানুষ না গাড়ি। তাদের কাজ শুধু ছোটা আর ছোটা। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কি বলবো ওকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
একটি শিশুর নিজের শৈশবকে ঘিরে এতোটা অভিমান সত্যিই অবাক করার মতো। শিশুদের মনে নানা কারণে অভিমান তৈরি হয়। আর এইসব অভিমানের সূত্রপাত ঘটে যখন শিশুকে কোন কিছু বুঝিয়ে না বলে চাপিয়ে দেয়া হয়। ধরা যাক শিশু একটা জিনিস চাইছে সেটা কেন তাকে দেয়া যাবে না সেই কথা যদি বুঝিয়ে বলা হয় তাহলে আর তার মনে অভিমানের মেঘ জমতে পারে না। কিন্তু বুঝিয়ে না বলে যদি কঠোরতার সাথে বলা হয় কিংবা চাওয়াটাকে পাত্তা না দেয়া হয় তাহলেও শিশুর মনে অভিমানের জন্ম হয়। আমি বাচ্চাটিকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও? জবাবে সে বলল, আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। বললাম, ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য তোমাকে কি করতে হবে? জবাবে বলল, বেশি বেশি পড়াশোনা করতে হবে। বললাম, পড়াশোনা করার জন্য কোথায় যেতে হবে? বলল, স্কুলে যেতে হবে। তাহলে স্কুলে তুমি কেন যাও? তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য। আর যদি তুমি না খাও তাহলে শক্তি পাবে কিভাবে? আর শক্তি না পেলে পড়াশোনা করবে কিভাবে? এমন অভিযোগ করে বলা প্রতিটা বিষয় কেন সে করে বা তাকে করতে হয় প্রশ্ন করে করে নিজের মুখ দিয়েই বলতে সাহায্য করলাম ওকে। তখন সে বলল, আম্মু তো আমাকে এভাবে বুঝিয়ে বলেনি তাই আমি বুঝতে পারিনি। এখানেই আসলে সমস্যা। আমরা বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে বলার চাইতে বেশির ভাগ সময়ই হুকুম করতে পছন্দ করি। যার ফলে বাচ্চারা বুঝতে পারে না যে সে যা করছে বা তাকে দিয়ে যা করানো হচ্ছে এতে উপকার তারই হচ্ছে। আর এই না বোঝাটাই বাচ্চার মনে রাগ-ক্ষোভ-অভিমানের জন্ম দেয়।
আমার ছেলের অভিযোগ ছিল প্রতিদিন কেন কুরআন পড়তে হবে? একদিন না পড়লে কি এমন ক্ষতি হবে। ওর বাবা তখন ওকে দাদু আর নাতির সেই গল্পটা বললেন যে, একটা ছোট্ট ছেলে তার দাদার সাথে থাকতো। দাদা প্রতিদিন ভোরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ছোট্ট ছেলেটি সর্বদা দাদাকে অনুসরণ করতে চাইতো। কিন্তু কুরআনের সে কিছুই বুঝতো না তাই দাদাকে বলল, দাদা আমি তো কুরআনের কিছুই বুঝি না তাহলে প্রতিদিন কেন কুরআন পড়বো? চুল্লিতে কয়লা তোলা বন্ধ করে দাদা বলল, এই কয়লার ঝুড়িটি নিয়ে নদীতে যাও এবং দয়াকরে আমার জন্য এটা ভর্তি করে পানি নিয়ে আস। দাদা যা বললো নাতী তাই করলো, কিন্তু নাতি ঘরে ফেরার পূর্বেই সব পানি ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেল। দাদা মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে একটু দ্রুত দৌড়ে চলতে হবে বলে তাকে আবার নদীতে পাঠিয়ে দিল। এবার ছেলেটি দ্রুত দৌড়াতে লাগলো, কিন্তু এবারও ঘরে ফেরার পূর্বেই তার ঝুরিটি খালি হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে ছেলেটি তার দাদাকে বলল যে, ঝুড়িতে করে পানি আনা অসম্ভব একটি কাজ।এটা একটা অর্থহীন প্রচেষ্টা। দাদা বললেন, তাহলে তুমি মনে কর, এটা একটি অর্থহীন প্রচেষ্টা? তকিয়ে দেখ তোমার ঝুড়ির দিকে।ছেলেটি ঝুড়ির দিকে তাকাল এবং প্রথমবারের মত সে বুঝতে পারলো যে ঝুড়িটি অন্য রকম লাগছে। এটা একটা নোংরা পুরনো কয়লার ঝুড়ি থেকে এখন একটা ভেতরে ও বাইরের পরিচ্ছন্ন ঝুড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। দাদা তখন হেসে বললেন, যখন তুমি কুরআন পড় তখন এমনই ঘটে। যদিও তুমি অনেক কিছুই বুঝনা, অনেক কিছুই মনে রাখতে পার না, কিন্তু যখন তুমি কুরআন পড়বে তখন তোমার মধ্যে পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তন আসবে তোমার ভিতরে ও বাহিরে। সেটা হল, জীবনের সকল কর্মে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা। এই গল্প শোনার পর থেকে আমার ছেলে আর কোনদিনও কুরআন পড়া নিয়ে অভিযোগ করেনি। কারণ বাবা বুঝিয়ে বলাতে সে বুঝেছে কেন তাকে কুরআন পড়তে হবে প্রতিদিন।
শিশুদেরকে বুঝিয়ে বললে তারা অবশ্যই বোঝে। তাই দৈনন্দিন প্রতিটা কাজ তাকে কেন করতে হবে, করলে কি হবে আর না করলে কি হবে এটা যদি বুঝিয়ে বলা যায় তাহলে কোন কাজকে আর শিশুর কাছে বোঝা মনে হবে না। তাকে বাধ্য করে করানো হচ্ছে এমন চিন্তার উদ্রেক হবে না মনে। অভিমান মনে দানা বাঁধতে পারবে না। চাপা অভিমান শিশুদের মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। আর শিশুদের যে কোন অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। অভিযোগের পেছনে কি কি কারণ কাজ করছে তা খুঁজে বের করে শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে তার বোঝাতে কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে। নয়তো শুধুমাত্র এই বুঝিয়ে না বলার কারণে নিজের সুন্দর শৈশবকে ঘিরে শিশুর মনে তৈরি হতে পারে একরাশ হতাশা। তাই শিশুদেরকে যে কোন বিষয় বুঝিয়ে বলার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের হওয়া উচিত দৃঢ়প্রত্যয়ী,সাপোর্টিভ।
বিষয়: বিবিধ
২৩৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন