চাইল্ড বিহেবিয়ার অ্যাবিউজ

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:১৫:৫৫ বিকাল

আমার ছেলেটা যখনই আমি পড়তে বসি কিংবা কারো সাথে কথা বলি, সেটা ফোনে, স্কাইপে, সামনা-সামনি যেভাবেই হোক খুব বেশি বিরক্ত করে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে, স্কাইপ হলে যার সাথে কথা বলি তার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র মুখাভঙ্গি করে, এককথায় তখন আমারো ইচ্ছে করে ধরে একটা.....। অসংখ্যবার ওকে বুঝিয়ে বলেছি কিন্তু কোন কাজ হয়নি। বাধ্য হয়েই ওর দিকে কড়া চোখে তাকাতে হয়, বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে মাঝে মাঝে চেহারাতে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বললাম, আম্মু তোমার সাথে সময় কাটাতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। সাথে সাথে জবাব দিলো, না আম্মু তুমি আমার চেয়ে পড়াশোনা করতে আর মানুষের সাথে কথা বলতে বেশি পছন্দ করো, আমার চেয়ে এসব তোমার কাছে বেশি প্রিয়। আমাকে তুমি সবচেয়ে কম ভালোবাসো। আমি তো একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

সপ্তাহে একদিন আমার ছেলের স্কুলের বন্ধুরা আমাদের বাসায় আসে ইংরেজি শেখার জন্য। একদিন পড়া শেষ হবার পর সবাই মিলে এতো বেশি হৈচৈ করছিলো যে আমি দুষ্টুমির ছলে ওর গাল ধরে একটু টেনে দিয়েছিলাম। তখন তো কিছু বললো না কিন্তু বন্ধুরা সবাই চলে যাবার পর তো মুখ ভার করে বসে রইলো। আমার সাথে কথা বলছিল না, খাওয়া নিয়ে মরজি করতে লাগলো। অনেক করে জিজ্ঞেস করার পর বলল, তুমি আমাকে সবার সামনে অপমান করছো। আরেকবার স্তব্ধ হলাম আমি।

গত সাত বছর আমার ছেলের সমস্ত জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নের উত্তর আমি নির্ভুল ভাবে দিতে চেষ্টা করেছি। কোন কিছু না জানলে ঝটপট ইন্টারনেট থেকে দেখে নিয়ে জানিয়েছি। আস্তে আস্তে ওর মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিলো যে আমার আম্মু সব জানে। কয়েকদিন আগে বাইরে ঘুরতে গিয়ে একটা জিনিস জানতে চাইলে আমি বললাম, এখন তো বলতে পারবো না, বাসায় গিয়ে তোমাকে বলবো। চোখ বড় বড় করে বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিল, তুমি জানো না? তুমি সত্যি জানো না আম্মু? বুঝলাম কি ভুল করেছি........।

আমার ছেলের সমবয়সী একটা ছেলে আছে এক ভাবীর। কাছাকাছি বাসা তাই ভাবীটা প্রায়ই আসেন ছেলেকে নিয়ে। খুব ভাব আমাদের দুই বাচ্চার মধ্যে। একে অন্যের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। কিন্তু সেই ভাবীটা সারাক্ষণই তার ছেলে বলতে থাকে নাকীব তোমার চেয়ে এটাতে ভালো, ওটাতে ভালো পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তুলনা আস্তে আস্তে ওদের বন্ধুত্বে দুরুত্ব তৈরি করে দিচ্ছিলো। কারণ ওই বাচ্চাটার মনে বন্ধুর প্রতি বিদ্বেষের জন্ম হচ্ছিলো।

এই ধরণের ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে ঘটছে এবং আমরা নিজেরাও প্রতিনিয়ত ঘটিয়ে চলছি। অথচ আমাদের এই সমস্ত আচরণ বাচ্চাদের মনোজগতে কি ধরণের প্রভাব ফেলছে আমরা চিন্তাও করে দেখি না। বেশির ভাগ সময়ই বাচ্চারা এসব কথা প্রকাশ না করে মনের মধ্যে চেপে রেখে নানান ধরণের কষ্ট, ধারণা তৈরি করে নেয়। আমাদের প্রতিটা কথা, প্রতিটা আচরণ কোন না কোন প্রভাব রেখে যায় বাচ্চাদের মনে। আমরা অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি বাচ্চাদেরকে নিয়ে কিন্তু আমাদের আচরণই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সে স্বপ্ন পূরণের পথে।

বাবা-মাদের কখনোই এমন কোন আচরণ করা উচিত নয়, যার ফলে বাচ্চাদের মনে এমন ধারণার জন্ম হয় যে, তারচেয়ে অন্য কিছু বেশি প্রিয় বাবা-মার কাছে। কখনোই কারো সাথে তুলনা করা ঠিক নয়। প্রত্যেকটা শিশু আলাদা তাই প্রত্যেককে মূল্যায়ন করতে হবে তার মধ্যের গুনাবলীর দ্বারা। নিজেদেরকে অবশ্যই আদর্শ মডেল হিসেবে পেশ করতে হবে কিন্তু সবজান্তা, নির্ভুল, নিস্পাপ হিসেবে তুলে ধরা ঠিক নয়। বাচ্চা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু কখনোই উচিত না অন্যের সামনে বকাঝকা বা অপ্রস্তুত করা। নিজেদের ইচ্ছা-পছন্দকেও কখনো বাচ্চার উপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়।

আর কিছু বলতে চাচ্ছি না কারণ আমাদের আচরণের ত্রুটি আর বাচ্চাদের উপর এর প্রভাব লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে সবারই উচিত ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে আত্মিক-আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করা। কারণ এই চেতনাই মানুষকে সহায়তা করে নেতিবাচক পরিবেশেও আশা ধরে রাখার।

বিষয়: বিবিধ

১২৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File