বেষ্ট অব দ্যা উইক

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ৩১ মে, ২০১৩, ০২:১১:৫৬ দুপুর



আমার ছেলের স্কুলে ভলান্টিয়ার টিচার হিসেবে জয়েন করার পর যে জিনিসটা দেখে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটা হচ্ছে ক্লাসের একপাশের দেয়াল জুড়ে বিশাল একটা রেললাইনের মডেল আর ছোট ছোট ছাব্বিশটা বগি। পঁচিশটা বগিতে ক্লাসের পঁচিশজন বাচ্চার ছবি আর একটা বগিতে প্রফেসরের ছবি লাগানো ছিল। প্রফেসর নিজ থেকে এসেই বলেছিলেন যে, এই রেললাইন আমাদের বেষ্ট অব দ্যা উইক বাছাই করার জন্য। প্রতি সোমবার শুরু হয় এই জার্নি আর শেষ হয় শুক্রবার। শুধু পড়াশোনাতেই এগিয়ে থাকলে হবে না, প্রতিটি বিষয়ে যে বাচ্চার পারফরমেন্স সবচেয়ে ভালো সেই পায় এই খেতাব। অর্থাৎ, পড়াশোনা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে যার বগি সবার আগে রেললাইনের শেষ মাথায় গিয়ে পৌছায় সেই হয় বেষ্ট অব দ্যা উইক। তার গলায় বেষ্ট অব দ্যা উইক লেখা মেডেল ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, একটা বগিতে তোমার ছবি থাকার কারণ কি? হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ওদের সাথে আমিও রেসে অংশগ্রহণ করি। আমি যেমন ওদেরকে পয়েন্ট দেই ওরা তেমন আমাকে দেয়। অর্থাৎ, প্রফেসর যেভাবে বাচ্চারা কেউ দুষ্টুমি করলে, বাড়ির কাজ করে না আনলে, মারামারি করলে, নিজের ফাইলপত্র ঠিকমতো গুছিয়ে না রাখলে, ক্লাস নোংরা করলে, স্কুলের পার্কে খেলতে গিয়ে গণ্ডগোল করলে, ক্লাসের সময় অকারণে কথা বললে ইত্যাদি কারণে বগি পেছনে নিয়ে যায়। ঠিক সেভাবে প্রফেসর যদি অকারণে বাচ্চাদের সাথে কখনো হৈচৈ করে বা বকাঝকা করে তাহলে বাচ্চারা তার বগিকে এক ঘর বা দুই ঘর পেছনে করে দিতে পারে। ঠিকমতো বাড়ির কাজ করে নিয়ে যাওয়া, ক্লাসে পড়াশোনা করা, নিজের সবকিছু গুছিয়ে রাখা, বন্ধুদেরকে কোন ব্যাপারে সাহায্য করা, যে কোন ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফ্রুর্ত অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে যে যত ভালো সে তত এগিয়ে থাকে রেললাইনে।

আসলেই বাচ্চাদেরকে সারাক্ষণ বলে বলে একটা কিছু করতে বাধ্য করা কিংবা কোন কিছু থেকে ফিরিয়ে রাখাটা সত্যিই অনেক জটিল একটা ব্যাপার। সেই তুলনায় এই রেললাইন সিস্টেমটা সত্যিই অনেক সহজ আর ফুলপ্রসু। পিছিয়ে যাবার ভয়তে না পারতে দুষ্টুমি করে না বাচ্চারা। আর এগিয়ে থাকার ইচ্ছার কারণে না চাইতেও অনেক কিছু চুপচাপ মেনে নেয়। স্বাধীনতা নেই এমন কথাও বলতে পারবে না কেউ কারণ পছন্দ যার যার। বেষ্ট হতে চাইলে ছোটো নয়তো বসে থাকো। আইডিয়াটা আমার এতো বেশি ভালো লেগেছিলো যে মনেহলো এটা তো বাসায়ও প্রয়োগ করা যায়। কারণ সারাক্ষণ এটা করো, ওটা করো না বলে বাচ্চার সাথে ঘ্যানঘ্যান করাটা আমার ভীষণ অপছন্দ। কিন্তু না করেও উপায় থাকে না কারণ একটা কাজ যদি একবার বলাতেই ঠিকমতো করে ফেলে বা নিষেধ করলেই এড়িয়ে চলে তাহলে তাকে আর বাচ্চা বলা কেন?

আমার ছেলের রুমের দেয়াল জুড়ে তাই লাগিয়ে দিলাম একটা রেললাইন আর তাতে বসিয়ে দিলাম তিনটা বগি। ছেলে, ছেলের বাবা আর আমার মধ্যে শুরু হল বেষ্ট অব দ্যা উইক প্রতিযোগিতা। ভালো হবার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মজাটাই আসলে অন্যরকম। শুধু ভালো ভালো কাজ করতে ইচ্ছে করে। আমার ছেলেকে দেখে অন্তত তাই মনেহয়েছে আমার। রুটিনের প্রতিটা কাজ সুন্দর মতো আর সময় মতো করার জন্য আমাকে আর বারবার তাগিদা দিতে হতো না। আমি কিচেনে গেলেই হাজির হতো আম্মু তোমার কি কোন সাহায্য লাগবে? আম্মু চলো আমিও তোমার সাথে ছাদে যাবো, কাপড় শুকোতে দিতে সাহায্য করবো তোমাকে। আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে ফোনে বা স্কাইপে কথা বলা, সব্জি আর মাছ খাওয়াতে ছিল ওর সবচেয়ে বেশি অনীহা। কিন্তু যেহেতু ভালো বাচ্চারা পরিবারের সবার সাথে আন্তরিক আর খাবার নিয়ে ঝামেলা করে না তাই এসব ব্যাপারে ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠছে আমার পুত্র।

শুধু তাই না বাবা-মা কোন ভুল করছে কিনা হিসাব রাখতে গিয়ে খুব সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করাও শিখে ফেলছে ধীরে ধীরে। আমাদের কোন আচরণ পছন্দ না হলেই গিয়ে বগি পিছিয়ে দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে বলে আমাদের আচরণের ভুল কোথায় হয়েছে। ওর ক্ষেত্রে আমরাও এমনটাই করি। শুধুমাত্র একটা রেললাইন আমাদের ঘরের পরিবেশকে আরো সুন্দর ও আনন্দময় করে তুলেছে। বাচ্চার সাথে সাথে আমাদেরকেও সব কাজ সতর্কতা আর নিয়মানুবর্তিতার দিকে খেয়াল রেখে করতে উদ্বুদ্ধ করছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নিজেই নিজেকে যাচাই করা শিখে যাচ্ছে এতে আমার ছেলেটা। কারণ ভুল করলে ওর বগি পেছানো আর ভালো কাজ করলে আগানোর কাজটি ওকে দিয়েই করাই আমরা। যা ওকে প্রেরণা যোগাচ্ছে আত্মউন্নয়নের।

বিষয়: বিবিধ

২৫৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File