জীবন কখনোই পশ্চাৎমুখী নয়
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫১:৪২ দুপুর
বাচ্চাদেরকে নিয়ে কাজ করতে গেলে নানারকম বিচিত্র আর মজাদার সব অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে হয়। ঠিক তেমনি বাচ্চাদের মাদের সাথে কথা বলতে গেলেও বিচিত্র আর বিরক্তিকর কিংবা দুঃখজনক অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে হয়। বাচ্চাদের মাদেরকে আমি প্রথমেই বলি যে, অমীয় সম্ভাবনার আলো নিয়ে পৃথিবীতে আসে প্রতিটি শিশু। আপনার শিশুও তার ব্যতিক্রম নয়। ওর মধ্যেও রয়েছে অমীয় সম্ভাবনার আলো। কিন্তু এই সম্ভাবনার বিকাশ নির্ভর করে আপনি কিভাবে ওকে গড়ে তুলছেন তার উপর। শিশুদের মধ্যের সম্ভাবনা বিকাশের জন্য প্রচুর সহমর্মিতাময় আবেগের প্রয়োজন। শিশুর বেড়ে উঠার পরিবেশ যদি ভালোবাসা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতাময় হয় তাহলে তারা আত্মবিশ্বাসী, মহৎ ও মুক্তমনা হয়ে বড় হয়। আর যদি চারপাশের পরিবেশ নেতিবাচক হয় তাহলে শিশুর চরিত্রে তারই প্রতিফলন ঘটে।
কয়েকদিন আগে এক ভাবী আমাকে কথায় কথায় বলছিলেন তার জীবনের দুঃখভরা ইতিহাস। শ্বশুরবাড়ির সবার দ্বারা কম-বেশি কষ্ট পাওয়ার ঘটনাসমূহ। এমনকি স্বামীও তাকে তেমন করে সাপোর্ট দেননি কখনোই। বোঝানোর জন্য কিছু বলার আগেই উনি বললেন, আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে তার কিছুই ভুলিনি। সবকথা মনে আছে। আমার ছেলে বড় হয়ে এইসবের প্রতিশোধ নিবে। হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আপনি তো সিনেমা স্টাইলে ডায়লগ দিচ্ছেন। খুব ব্যথিত গলায় তখন বললেন, আমার জায়গায় আপনি হলে এভাবে বলতে পারতেন না। বললাম, ঠিক বলেছেন ভাবী আপনার জায়গায় আমি হলে কখনোই এভাবে বলতে পারতাম না। কারণ আমি তো আমার স্বপ্ন পূরণও করতে চাই না আমার ছেলের দ্বারা, সেখানে দুঃস্বপ্ন পূরণের অবকাশ কোথায়।
মাসখানেক আগে আমার কাছে এসে ছেলে বলল, বাবাকে ফোন করে বলতে যেন কাজ থেকে ফেরার পথে চকলেট আর চিপস নিয়ে আসেন ওর জন্য। আমি মজা করে বললাম, আমি বলবো কেন? চিপস, চকলেট তোমার খাবার তুমি বলো বাবাকে ফোন করে। সে ফোন করে বাবাকে বললো তখন। কয়েকদিন আগে আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই ছেলেকে ডাক দিয়ে বললাম, বাবাকে ফোন করে বলো যেন ধনেপাতা আর টমেটো নিয়ে আসে। সাথে সাথে জবাব দিলো যে, আমি বলবো কেন আম্মু? এসব তো তোমার রান্নার উপকরণ তুমি বলো বাবাকে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম একেই বলে আয়নায় প্রতিচ্ছবি। আজ আমি আমার বাচ্চাকে অন্যের উপর প্রতিশোধ নিতে শেখাচ্ছি। কাল আমার বাচ্চা ওর কাছে বেঠিক লেগেছে এমন কোন আচরণের জন্য আমার উপরই প্রতিশোধ নিতে চাইবে না এই গ্যারান্টি কে দেবে? যেখানে আমার শিক্ষাটাই এমন, প্রতিশোধ নেয়া।
আমাদের এখানে এক বড় ব্যবসায়ী আছেন। এখানে বা দেশে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির কোন অভাব নেই। উনার বড় ছেলের বয়স তেরো বছর। পড়াশোনার প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছেলেটার এবং রেজাল্টও অনেক ভালো। কিন্তু সেই উনি ঠিক করেছেন সেকেন্ডারির পর আর পড়াবেন না ছেলেকে। কারণ তার ব্যবসাই তো দেখতে হবে ছেলেকে। শুধু শুধু পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাদের চারপাশে এমন বাবা-মায়ের তো কোন অভাব নেই যারা নিজের অপুর্ণ স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম মনেকরেন সন্তানদেরকে। একবারও ভেবে দেখেন না সন্তান কি চায়। জীবনকে ঘিরে সন্তানের মনের কি স্বপ্ন। আমাদের মাধ্যমে সন্তানরা দুনিয়াতে এসেছে তাই তাদেরকেও আমরা মাধ্যম বানিয়ে ফেলি স্বপ্ন পূরণের। কিন্তু আমাদের কি এই অধিকার আছে? আমি মনেকরি নিজেদের স্বপ্নের জন্য সন্তানদের স্বপ্নকে নষ্ট করার কোন অধিকার বাবা-মাদের নেই। কাহলিল জিব্রানের কবিতাটি মনে পড়ে খুব আমার।
কাহলিল জিব্রানের কবিতা
তোমাদের সন্তানেরা নয় তোমাদের সন্তান
জীবনের পুত্র-কন্যাগণ, জীবনের পুর্নতার জন্যই তাদের আগমন
যদিও তারা এসেছে তোমাদের মধ্যে দিয়ে
তবুও ভেবো না তারা তোমাদের থেকে জাত
আর যদি তোমাদের সাথে তারা করে বসবাস
তারপরও নেই তারা তোমাদের অধিকারে
তুমি তাদেরকে তোমার ভালোবাসা দিতে পারো ঠিকই
কিন্তু কখনোই দিতে যেও না তোমার ভাবনা
তাদেরও আছে নিজস্ব ভাবনার জগত
তুমি চাইলে ধারণ করতে পারো তাদের শরীর
কিন্তু নয় তাদের আত্মা
তাদের আত্মার বসবাস আগামীর ঘরে
তুমি তো দেখনি সেই ঘর
চাইলে তাদের মতো হতে চেষ্টা করতে পারো তুমি
কিন্তু কখনোই তাদেরকে বলো না তোমাদের মতো হতে
জীবন তো কখনোই পশ্চাৎমুখী নয়
ভেবে নাও তুমি একটা ধনুক যেন
যা থেকে জীবনের পথে ছুটে যায় তারা তীরের মতন
জিনি তীরন্দাজ তিনিই চেনেন আগামীর পানে অসীমের পথ
তার শক্তি দিয়ে তিনি বাঁকান ধনুক
যেন তীর তার দ্রুততার সাথে দুরবর্তী লক্ষ্যে পৌঁছে যায়
তীরন্দাজের হাতে তোমার সে ক্লেশ, আনন্দের সাথে নিও
ছুটে যাওয়া তীর যেমনটি তার প্রিয়
তেমনটি প্রিয় তার হাতে ধরা ধনুক।
বিষয়: বিবিধ
২৪২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন