দাদুর পাঠশালা-৫

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:২২:৩৫ রাত



নাতি-নাতনীদের বোঝার জন্য গত দু’সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ওদের সাথে আগের চেয়েও অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছেন আরমান সাহেব। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না বাচ্চাদের স্বভাব-চরিত্র। একজন যে কথাতে মজা পাচ্ছে, অন্যজনের তাতে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেউ গল্প শুনতে পছন্দ করে, কেউ খেলতে পছন্দ করে, কারো আগ্রহ সৃষ্টিশীল কাজকর্মে। কাউকে বুঝিয়েও কথা বলা থামানো যায়না, আর কাউকে দশটা প্রশ্ন করলে একটা জবাবও দেয় না ঠিকমতো। সাতটি বাচ্চা যেন রংধনুর সাত রং। “সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, জানি নাতো কেমন করে কি দিয়ে সাজাই” অবস্থায় দিন কাটচ্ছেন এখন আরমান সাহেবের। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন চার বছর বয়েসি নাতীটাকে নিয়ে। এই ছেলের প্রিয় কাজ হচ্ছে দাদার দাড়ি নিয়ে খেলা করা। আদর করে ছাড়তে বললে সে আরো জোরে দাড়ি চেপে ধরে, আর ধমকের সুরে বললে দেয় কামড়। বারান্দায় বসে এসবই ভাবছিলেন… সালাম শুনে তাকিয়ে দেখলেন তার স্ত্রীর ছোটভাই জাহিদ পাশে দাঁড়িয়ে। সাথে সাথে মনটা ভালো হয়ে গেলো তার কারণ এই ছেলেটিকে তিনি অসম্ভব রকম পছন্দ করেন। পাশে বসে হাসতে হাসতে-

-তোমার পাঠশালায় ভর্তি হতে চলে এলাম দুলাভাই।

-(হেসে) আলহামদুলিল্লাহ! এই বিপদের সময় তোমাকেই দরকার ছিল আমার।

-বিপদ..? আমি তো আরো শুনলাম তুমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ার মহৎ কাজে মনোনিবেশ করেছো। তাই তো ছুটি পেয়ে একমুহুর্ত দেরী না করে চলে এলাম।

-সবই তো ঠিকআছে কিন্তু যাদের জন্য পাঠশালার আয়োজন তাদের সাথেই তো মত বিনিময় করতে পারছি না ঠিকমতো। একেকটা বাচ্চা একেক রকম।

-(হেসে) বাচ্চাদের এই বৈচিত্রতাই তো ওদের স্পেশালিটি দুলাভাই। একটা বাগানে যত বেশি রকমের ফুল বা গাছ থাকে আমাদের মুগ্ধতা বা ভালো লাগার পরিমাণ তত বেশি হয়। বাচ্চারাও ঠিক এমন। কেউ দুষ্টু হবে, কেউ শান্ত হবে, কেউ হবে বাধ্য তো কেউ অবাধ্য, কেউ বুদ্ধিমান আবার কেউ একটু বোকা, কারো সৃষ্টিশীলতা দেখে গর্ব হবে আর কারো ফাঁকিবাজি মনকে করবে ব্যথিত। এটাই তো জগতের নিয়ম।

-আমি আসলে এভাবে ভেবেই দেখিনি। উল্টো বোকার মতো নানারকম নেতিবাচক চিন্তা করছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! এজন্যই তোমাকে দরকার ছিলো।

-চিন্তা মনে করে আমরা বেশির ভাগ সময় যা করি তা আসলে দুশ্চিন্তা দুলাভাই। এজন্যই খেই হারিয়ে নেতিবাচকতার স্রোতে ভেসে যাই। অথচ চিন্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার অসংখ্য উপকরণ নিজের গণ্ডির মধ্যেই হাজির থাকে বেশির ভাগ সময়। দুশ্চিন্তা চোখে পট্টি লাগিয়ে দেয় তাই দেখতে পারিনা।

-(হেসে)হুমম…..বুঝতে পারছি এখন। আসলেই তো বৈচিত্র্যটাই সবকিছুকে ঐশ্বর্যময় করে। এখন তাহলে আরেকটু সাহায্য করো আমাকে। বাচ্চাদেরকে কি কি শেখাবো সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দাও আমাকে।

-আমি সত্যি একটা পরামর্শ দিতে চাই আর সেটা হচ্ছে ভালো শিক্ষক হবার জন্য যেমন তুমি নানাভাবে নিজেকে তৈরি করতে চেষ্টা করছো, বাচ্চাদেরকেও তেমনি ভালো ছাত্র হবার প্রশিক্ষন দিতে হবে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং শিক্ষকের মর্যাদা বোঝাতে হবে। আর এরজন্য যেভাবে তোমার ছেলে-মেয়েদেরকে গড়েছো নাতী-নাতনীদেরকেও সেভাবেই গড়ে তোল। সবার প্রথমে সত্যিকার অর্থে নিজেকে ভালোবাসতে শেখাও আর আন্তরিকভাবে জ্ঞানার্জনের নেশা তৈরি করে দাও সবার মনে। জ্ঞানার্জন ওদেরকে নিজকে চিন্তে, জানতে, বুঝতে সাহায্য করবে আর নিজের প্রতি ভালোবাসা ওদের মধ্যে এনে দেবে আত্মব্যবস্থাপনা, আত্নসচেতনতা সহ আত্মিক ও সামাজিক সচেতনতা।

-নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি যে হতাশা হচ্ছে গুণনাশিনী। একটা সময় হতাশা আমাকে খুব ভুগিয়েছে জাহিদ। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদের মনে কখনো যেন হতাশা তৈরি না হয়। আর নিজের প্রতি আশা ধরে রাখার জন্য নিজেকে ভালবাসাটা খুব বেশি প্রয়োজন। নিজেকে কেন ভালোবাসতে হবে যুক্তি দ্বারা হয়তো সেটা বুঝিয়ে বলা সম্ভব কিন্তু স্বতঃস্ফ্রূত এই বোধ না এলে যুক্তির প্রভাব খুব বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনা। এরজন্য আমি মুখে না বলে যতটা সম্ভব করে দেখাতে চেষ্টা করেছি করণীয়গুলো।

-অন্যকে উপদেশ দেয়ার আগে যারা নিজে তা পালন করে দেখাতে পারে তারাই তো যোগ্যতা রাখে পথ প্রদর্শনের। আর এটাই তো সঠিক পদ্ধতি “ আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে”। আর শিক্ষক তো একটা মহান উপাধী। শিক্ষকতা মহৎ কাজ। তাই শিক্ষক হতে বিশেষ কিছু গুণাবলীর প্রয়োজন।

-আমিও শিক্ষকতা বিষয়ে খুব ঘাটাঘাটি করছি গত কয়েকদিন থেকে। জানতে পারলাম যে শিক্ষকদের নয় প্রকার দোষ মুক্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। লোভ-লালসা, রা‌গ, পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা , মিথ্যা, পরনিন্দা, কৃপণতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহঙ্কার, এবং রিয়া বা লোক দেখানো। আর যে সাতটি গুণ শিক্ষককে অর্জন করতে হবে তা হচ্ছে- মেজাজের ভারসাম্য, সচ্চরিত্রতা, সৎ উদ্দেশ্য ও ন্যায়-নীতির অনুসারী, সহনশীলতা, স্বল্পে তুষ্টি, ধৈর্য্যশীলতা, এবং কৃতজ্ঞতা। ভাষাগত যে তিনটি গুন থাকতে হবে শিক্ষকের মধ্যে তা হচ্ছে- ধীরস্থিরতা, সহজতা, মধুরতা। চেহারাতে থাকতে হবে কোমলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা আর বডি লাঙ্গুয়েজে থাকবে গুরুত্ব ও প্রভাব।

-সত্যিই অসাধারণ লাগছে কথাগুলো দুলাভাই। এসব গুণাবলীর দ্বারা সঠিকভাবে যদি বাচ্চাদের সামনে নিজেকে পেশ করা যায় তাহলে বাচ্চাদের মনেও স্নেহ-ভালোবাসা আর নির্ভরতার অনুভূতি তৈরি হয়ে যাবে খুব সহজেই।

-আমিও মনেকরি যে একজন শিক্ষকের উচিত নিজেকে এমন ভাবে পেশ করা যাতে তাকে দেখলেই বাচ্চারা সজাগ হয়ে উঠবে এবং কাজের প্রতি মনোযোগী হবে। আর এরজন্য প্রয়োজন শিক্ষকের মধ্যে ইখলাস, মেহনত ও শাফকাত থাকা। সাথে আরো থাকতে হবে জোশ, হুশ এবং ইস্তিকামাত। আমি নিজের মনকে তৈরি করে ফেলেছি বুঝলে জাহিদ। ইনশাআল্লাহ! নাতী-নাতনীদের গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাবো।

-(হেসে) ইনশাআল্লাহ! আমিও আছি তোমার সাথে দুলাভাই। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নাতী-নাতনীদের গড়ে তোলাই হোক আমাদের বর্তমান জীবনের মিশন।

চলবে............(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

২৪৯৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File