দাদুর পাঠশালা-৪

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৪ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:৩৫:২৪ দুপুর



রিসাব সবসময়ই চেষ্টা করে অফিসের কাজ বাসায় না আনার জন্য কিন্তু আজ আবারো তাকে একগাদা কাজ নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছে। রাতের খাবার সেরে কাজ নিয়ে বসার আগে রিনিলার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। আত্মমগ্ন মেয়েটার দিকে পুর্ণ চোখে তাকাতেই কাজ করার ইচ্ছে উবে গেলো তার মন থেকে। জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ততা এতো বেশি বেড়ে গিয়েছে যে, দুজন মিলে আগের মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প করা হয়ে ওঠে না আর তেমন করে। রিনিলার কাছে গিয়ে বসে বলল, কি ভাবছো এমন আত্মমগ্ন হয়ে? রিনিলা হেসে বলল-

-বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন পাঠশালার সিলেবাস তৈরি করার। সেটা নিয়েই ভাবছি। বাবার অনেক পরিকল্পনা পাঠশালাকে ঘিরে তাই আমি সিলেবাসটা খুব আকর্ষনীয় করতে চাচ্ছি। যাতে দাদুরা অনেক আনন্দ নিয়ে শেখাতে আর নাতি-নাত্নীদের অনেক আনন্দ নিয়ে শিখতে পারে। তুমি ব্যস্ত না থাকলে তোমার কাছে পরামর্শ চাইতাম।

-পরামর্শও দিতে পারবো না এতোটা ব্যস্ত মনেহয় আমি নই। তাছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মুহুর্ত থেকে আগামীকাল সকাল পর্যন্ত আমার সবটুকু সময় আমি শুধু তোমাকে দেবো, ইনশাআল্লাহ। পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কি কি করা যায় বলো তো।

-(হেসে) কিছুক্ষণ পরপর ফোন রিসিভ করা যায়।

-(হেসে) আচ্ছা যাও মোবাইল বন্ধ করে দিচ্ছি।

-প্লিজ না। আমি তো এমনিতেই ফান করেছি। আমার জন্য তোমাকে দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে না। তোমার শত কাজের ভিড়ে যদি আমাকে দেবার জন্য এক মুহুর্ত সময় পাও, আমার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। ভালোবাসা বোঝানোর জন্য তো সময়ের আধিক্য জরুরী না। ভালোবাসা বোঝানোর জন্য ভালোবাসাই যথেষ্ট। আর আমি বুঝি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।

-(হেসে) কতটা ভালোবাসি?

-ভালোবাসা কি মাপা যায় নাকি যে বলবো তুমি আমাকে পাঁচ কেজি তিনশো গ্রাম ভালোবাসো। আর এখন ভালোবাসাবাসি বন্ধ। আমাকে পরামর্শ দাও পাঠশালার ব্যাপারে।

-কেমন হয় যদি আমরা কিছুক্ষণ পর পাঠশালা নিয়ে আলোচনাতে যাই?

-খুবই খারাপ হয়। এখনই আলোচনা করবো পাঠশালা নিয়ে।

-(হেসে) তোমার মাথায় একবার কিছু ঢুকে গেলে বিপদ। আচ্ছা চলো তোমাকে পরামর্শই দেই এখন। প্রথম পরামর্শ হচ্ছে বাচ্চাদের পড়তে হবে এমন কোন কিছু দাদুর পাঠশালার সিলেবাসে না রাখা।

-মানে শুধু খেলাধুলা করবে বাচ্চারা?

-না ঠিক তা না। বাচ্চারা বিভিন্ন জিনিস শিখবে, জানবে, বুঝবে কিন্তু সেসবই গল্প এবং খেলার ছলে। দেখো সপ্তাহে পাঁচদিন ওরা স্কুলে যায় সেখানে ওদের পড়াশোনাই করতে হয়। দাদুরাও যদি বই নিয়ে বসিয়ে দেয় ওরা তেমন কোন আনন্দ তো পাবেই না, উল্টো নতুন একটা বোঝা মনে করবে এটাকে। যার প্রভাব দাদু-নাতিদের সুন্দর সম্পর্কের উপরও গিয়ে পড়বে। সবকিছু মিলিয়ে পরিকল্পনা কাজ করবে না।

-গল্পে গল্পে শিক্ষার আইডিয়া অবশ্য আমারও ছিল। গল্পের মাধ্যমে খুব সহজেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়া যায় বাচ্চাদেরকে। খেলার ক্ষেত্রে কি কি করা যায়?

-(হেসে) তুমি ছোটবেলায় ফুল-ফল-নাম-দেশ ইত্যাদি এই খেলাটি খেলেছো? এর মাধ্যমে কিন্তু খুব সহজেই বাচ্চাদেরকে অনেক কিছুর নাম শিখিয়ে ফেলা সম্ভব। তারপর ছোট ছোট ধাঁধা বা কুইজ হিসেবে আমরা ওদেরকে শিখিয়ে ফেলতে পারি সাধারণ জ্ঞানের অনেক বিষয়। এছাড়া ছবি দেখে শেখা, বিভিন্ন মজার ও তথ্য ভিত্তিক বিষয় নিয়ে আলোচনা, সবাই মিলে মজার কোন কার্টুন দেখা।

-(হেসে) হুম... অনেক সুন্দর আইডিয়া।

-(হেসে) দাদুর পাঠশালার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্যের একটি হতে হবে বাচ্চাদের মধ্যের সৃজনশীলতার বিকাশ। কখনো ওদেরকে রং-তুলি দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে, তো কখনো হাতে ধরিয়ে দিতে হবে কাগজ আর পেন্সিল। যা ইচ্ছে হয় আঁকবে, যার মনে যা আসে লিখে ভরে ফেলবে কাগজ। মাঝে মাঝে গল্প-কবিতা-ছড়া লেখা বা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রাখা যায়।

-সুন্দর করে কথা বলতে পারাটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপুর্ণ। ছোটবেলা থেকেই যাতে সুন্দর করে কথা বলতে শেখে সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে। গল্প বা কবিতা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করানোর মাধ্যমে সুন্দর ভাবে নিজের বক্তব্য পেশ করার শিক্ষা দিতে পারি আমরা।

-সুন্দর বলেছো। কখনো ওদেরকে নিয়ে যেতে হবে প্রকৃতির মাঝে। ছয় মাস পরপর ওদেরকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া যায়। পিকনিক হয়ে যাবে আর সাথে নানা ইভেন্ট তো থাকবেই বিভিন্ন জিনিস শেখানোর।

-মাশাআল্লাহ! ফাটাফাটি সব আইডিয়া। এজন্যই তো আমি বলি তোমার কোন তুলনা হয় না।

-আলহামদুলিল্লাহ! এখন বলেন দেখি এতো গুলো ফাটাফাটি আইডিয়া দেয়ার বদলে আপনার অতুলনীয় হাসবেন্ডকে কি দেবেন আপনি?

-এক কাপ চা। চলবে?

-(হেসে)হুম....চলবে। তবে এখন না কিছুক্ষণ পর। এখন কথা বলি তোমার সাথে।

-একটা জিনিস ভেবে দেখেছো রিসাব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলে বাংলা, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম সহ যে কয়টা মৌলিক বিষয় পড়ানো হয় তাতে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন হয় ঠিকই কিন্তু নৈতিকতা, উন্নত মানসিকতা, সততা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরমত সহ্য করা এইসব গুণাবলী অর্জিত হয় না। অথচ জীবনের জন্য এগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ।

-এই শিক্ষাগুলো তো আসলে শুধু বই পড়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। বাচ্চাদেরকে করে দেখাতে হবে যে কিভাবে কথা বলতে হয়, বড় ও ছোটদের প্রতি কিভাবে আচরণ করতে হয়, অপরের প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, মিথ্যা বলার অপকারিতা, বাবা-মার সাথে কিভাবে উত্তম আচরণ করতে হয়, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, কোনটা নৈতিক, কোনটা অনৈতিক, কোনটা মানবিক, ত্যাগ কি এবং কেমন হওয়া উচিত, বন্ধুত্বের দাবী ও প্রকৃতি, সমঝোতা কাকে বলে।

-ভালোবাসাও তো শেখাতে হবে তাই না?

-(হেসে) ভালোবাসার উৎস তো আসলে মানুষের মনের অন্য কোথাও। চাইলেই যদি কাউকে ভালোবাসা শেখানো যেতো খারাপ হতো না। কিন্তু সেটা সম্ভব না। ঠিক তেমনি পারিবারিক বন্ধনেও ভালোবাসার জন্ম আপনা থেকেই হতে হয়। বুঝিয়ে, শুনিয়ে, শিখিয়ে, পড়িয়ে কারো মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করা যায় না। সিদ্ধান্ত নিয়ে, শর্ত আরোপ করে কিংবা সিলেবাস তৈরি করে আর সবকিছু হলেও ভালোবাসা হবে না।

-আমি জানি যে বাচ্চারা পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে যেভাবে যা কিছু পায়, সেভাবেই সবকিছু করতে চেষ্টা করে। আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম পাঠশালার পরিবেশটাকে ভালোবাসাময় করে গড়ে তোলার কথা।

-ঠিকআছে আমরা চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। তবে আরেকটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে বাচ্চাদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য, আমাদেরকে নিজেদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। একটা জিনিস যত ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা বাচ্চাদের সামনে সামনে পেশ করতে পারবো ওদের আগ্রহ তত বেশি বাড়বে এবং তত দ্রুত শিখবে।

-বুঝতে পেরেছি আমি। আচ্ছা আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।

-চলো আমিও যাই তোমার সাথে। তুমি ডিরেকশন দিবে আর আমি চা বানাবো। এই সুযোগে জীবনের শত ব্যস্ততার ভিড় থেকে একান্ততার কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে নেবো আমরা দুজন।

চলবে...........(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

২৭১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File