দাদুর পাঠশালা-৩

লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১২ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫০:৩৯ দুপুর



স্বামীকে বইয়ের মধ্যে নিমগ্ন দেখে টেবিলে চা রেখে চুপচাপ পাশে বসলেন মিসেস আরমান। কারণ এখন কথা বলতে চাইলেও কোন লাভ নেই। নিজেকে আদর্শ শিক্ষক রূপে গড়ে তোলার মিশন এখন আরমান সাহেবের মাথায়। পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালো করেই জানেন যে একবার তাঁর স্বামীর মাথায় কোন কিছু চাপলে সেটার শেষ না দেখে চুপ করে বসার পাত্র সে নয়। অনেকক্ষণ পর আরমান সাহেব বললেন, চুপ করে বসে না থেকে কিছু একটা পড়ো। নাতী-নাতনীদের গড়ার দায়িত্ব তো আমাদের দুজনেরই। আর নিজেরা ভালো মতো না জানলে তো ঠিকমতো কিছু শেখাতে পারবো না। তুমি যেন কি বলবে বলছিলে?

-আমি একটা পরামর্শ দিতে চাইছি তোমার পাঠশালার ব্যাপারে। সেটা হচ্ছে সারাক্ষণ শুধু বই না পড়ে নাতী-নাতনীদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো উচিত তোমার। তুমি যেমন শিক্ষক হবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছ, ওদেরকেও শিক্ষার্থী হবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে এখন থেকেই। নয়তো পরে ভারসাম্য ঠিক থাকবে না।

-(হেসে)দারুণ একটা পরামর্শ দিয়েছ তো। আমার মনেহচ্ছে বাচ্চাদের আমরা কি কি শেখাবো তার একটা লিস্ট করে নেয়া উচিত সবার আগে। যেসব গুণাবলী মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে সেসব শেখানোর জন্যই আমাদের এই পাঠশালা। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া এটা অসম্ভব। কারণ একমাত্র নৈতিক গুনাবলীর জোরেই মানুষ পারে নিজের ও পারিপার্শ্বিক সবকিছুর আসল সত্তাকে অনুধাবন করতে।

-(হেসে) তোমার মাথায় হঠাৎ পাঠশালার চিন্তাটা এলো কিভাবে বলো তো?

-বড় বৌমা অসুস্থ থাকার কারণে কয়েকদিন যে বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছিলাম চিন্তাটা তখনই মাথায় এসেছিলো। পড়াতে গিয়ে দেখলাম বাচ্চাদের বিবেক-বুদ্ধি, নীতিবোধ, মেধাশক্তি, চিন্তাশীলতা, সৃজনশীল শক্তিকে বিকশিত করতে পারে তেমন কোন কিছুই নেই শিক্ষাব্যবস্থায়। অথচ এইসব গুনাবলীর উৎকর্ষতা ছাড়া মানুষের সার্বিক উন্নতি সাধন অসম্ভব।

-তুমি যা করতে চাইছো সেটা কতোটা কঠিন একটি কাজ ভেবে দেখেছো তো ভালো মতো?

-কাজ মনে করলে অবশ্যই ভীষণ কঠিন। কিন্তু আমি এটাকে আমার করণীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখছি। কঠিন হোক আর সহজ দায়িত্ব সর্বদা পালনীয়। তাছাড়া খুব কম মানুষই আছে যারা সমাজের উল্টো দিকে গিয়ে নতুন কিছু করতে চেষ্টা করে। আর নতুন কিছু করতে চাইলে সবচেয়ে বড় বাঁধা হচ্ছে মনের মতো সঙ্গী সাথী তেমন একটা পাওয়া যায় না। আলহামদুলিল্লাহ! আমার তো এই বাঁধাটা নেই।

-(হেসে) এছাড়াও তো কত রকমের বাঁধা এসে হাজির হতে পারে।

-(হেসে) তা ঠিক। তবে আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি কিছু করতে চাইলে মনের মধ্যে সেই আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। উচ্চাশা থাকতে হবে। কারণ উচ্চাশা না থাকলে জীবনে গতি আসে না। উচ্চাশা যত বেশি হবে জীবনের উন্নতি তত দ্রুত হবে। আর বাঁধা সেতো আসবেই। সমস্যা, বিপদ, দুঃখ-কষ্ট এসব তো আসার জন্যই। এসবকে এড়িয়ে পথ চলতে পারলেই না আমরা পথিক হতে পারবো। তবে পথিক হবার সাথে সাথে গন্তব্য জানা থাকতে হবে। কারণ গন্তব্য না জেনেই যদি কেউ পথ চলতে শুরু করে তাহলে সে তার সঠিক সন্ধান পাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। আলহামদুলিল্লাহ! আমি আমার গন্তব্য জানি।

-কিন্তু উচ্চাশা মানুষের মনে অনেক সময় নিজ যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু করার স্বপ্ন তৈরি করে দেয়। যার ফল সবসময় মঙ্গলজনক হয় না।

-তুমি মনেহয় উচ্চাশার সংজ্ঞা জানো না। বলা হয়- জীবন হচ্ছে একটা গাড়ি আর উচ্চাশা হচ্ছে তার ইঞ্জিন। যে গাড়ির ইঞ্জিন যত শক্তিশালী, সে গাড়ি তত দ্রুতগামী। ঠিক তেমনি যার জীবনে উচ্চাশা থাকে, সে আশা বাস্তবায়নের জন্য দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে। তবে উচ্চাশা আর অতিরিক্ত আশা এক জিনিস না। জীবনে উচ্চাশা থাকতে হবে কিন্তু অতিরিক্ত আশা কিংবা নিরাশা থাকা চলবে না। তাই উচ্চাশা যদি না করি আমার পাঠশালার কার্যক্রমকে কিছুতেই এগিয়ে নিতে পারবো না সফলতার দিকে। কারণ উচ্চাশা না থাকলে কোনকিছুর উচ্চ শিখরে পৌছা সম্ভব হয় না।

-(হেসে) সবকিছুর সংজ্ঞা রেডি থাকে তোমার কাছে। তোমার ছেলে-মেয়েগুলোও এমন হয়েছে। এখন তো মনেহচ্ছে নাতী-নাতনীদেরকেও জ্ঞানের জাহাজ না বানিয়ে ছাড়বে না তুমি।

-(হেসে) আল্লাহ যেন তোমার কথা কবুল করেন। হতাশা, লোভ, ঘৃণা, ক্রোধ, ভয়, আত্মতৃপ্তি, নিন্দা-সমালোচনা, অহংকার মোটকথা মানুষের চরিত্র মাধুর্য নষ্ট করে, মানুষকে আত্মচিন্তায় বিভোর রাখে এমন সব নেতিবাচকতা থেকে যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেঁচে থাকার যথাযথ শিক্ষা দিতে পারি। কর্তব্যবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতাসম্পন্ন কল্যাণকামী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

চলবে............(ইনশাআল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File