শিশুরা যখন অভিভাবক
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ১৮ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৩২:৫৯ বিকাল
আমার ছেলের একটাই অভিযোগ “আম্মু একা কেন সবসময় সংসারের সব সিদ্ধান্ত নিবে?” ওর কথা হচ্ছে, সবাইকেই একদিন করে ঘরের কর্তা হতে হবে। তা না হলে অন্তত একদিন ওর বাবাকে আর একদিন ওকে এই ক্ষমতা দেয়া উচিত। অনেক আশা নিয়ে বাবার কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করলো। কিন্তু ওর বাবা বলল, সংসারের ব্যাপারে আমাদের দুজনের চেয়ে তোমার আম্মুর জ্ঞান বেশি। কতৃত্বের আসন তাই আম্মুরই থাক। তোমার শখ হলে তুমি আন্দোলন করো কিন্তু আমি এসবের মধ্যে নেই। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে রাজী করতে পারলো না ঠিকই কিন্তু দমে যাবার পাত্র সে নয়। এই দাবী নিয়ে রোজই আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান। একদিন পেটে ব্যথার কারণে ঔষধ খাচ্ছিলাম। বলল, আম্মু এমন কি কোন ঔষধ আছে যা খেলে মানুষের রাগ কমে যায়? প্রশ্ন করলাম, কেন? জবাব দিল, তাহলে তোমাকে একটা ঔষধ খাইয়ে দিতাম। তাহলে তুমি সবসময় হাসতে আর আমি যা বলতাম তাই মেনে নিতে।
এরপর আমাদের তিনজনের সংসারের ছোট্ট পারিবারিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে প্রতি শনিবার নাকীব(আমার ছেলে)হবে সংসারের কর্তা। শনিবার দিন ঘুম উঠে চোখ খুলেই আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, আম্মু আজকে কিন্তু সবকিছু আমার পছন্দ মতো হবে। বললাম, বলো কি কি করতে চাও তুমি? লাফ দিয়ে উঠে বসে বলল, আজ আমি যা যা বলব তোমাকে সব করতে হবে মানা করতে পারবে না। আজ তুমি সারাদিন আমার সাথে কাটাবে, ফোনে বা স্কাইপে কথা বলতে পারবে না কারো সাথে, পড়াশোনা করতে পারবে না, আমার সাথে বসে আমার প্রিয় গেমস খেলবে আর কার্টুন দেখবে, আজ আমি গোশত খাবো, আইসক্রিম খাবো, চিপস খাবো ইত্যাদি ইত্যাদি বিরাট লিস্ট বলে সে থামলো। ওর কথা শুনে আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কারণ আমার ধারণা ছিল আমি আমার বাচ্চাটিকে পর্যাপ্ত সময় দেই। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে আমার ধারণা ঠিক নয়। নিজেকে আরো ভালো মা হিসেবে গড়তে হবে উপলব্ধি করলাম।
বাচ্চার হাতে যখন ক্ষমতা দেয়া হবে তখন সে তার ইচ্ছে মতো সবকিছু করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে মনে রাখতে হবে কোন ব্যাপারে সরাসরি মানা না করে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে যে কেন কাজটি করা ঠিক হবে না এবং সিদ্ধান্ত নেবার ভার বাচ্চার উপরই ছেড়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র যদি ধৈর্য্য নিয়ে বুঝিয়ে বলা যায় তাহলে বাচ্চারা সঠিক কাজটি করতেই আগ্রহী হয় সবসময়। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে একদিনেই সব চাহিদার ভুল ধরিয়ে দেয়া যাবেনা। প্রয়োরিটি বুঝে ধীরে ধীরে বাচ্চাদের চাহিদাগুলোকে সংশোধন করতে হবে। তাহলে একটা সময় দেখা যাবে কোন কিছু চাইবার আগে নিজেই ভেবে দেখবে চাহিদাটা যুক্তিসঙ্গত কিনা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে যে মাঝেমাঝে বাচ্চাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেখা উচিত ওরা কিভাবে এটার প্রয়োগ করে। এবং এর মাধ্যমে খুব সহজেই বাচ্চাদের বুঝিয়ে দেয়া যায় ওর অন্যায় বা ভুল ইচ্ছেগুলোকে কখনোই মেনে নেয়া হবে না। তাই সঠিক-বেঠিকের জ্ঞানটাও বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা খুব দ্রুত ঢুকে যাবে বাচ্চাদের মধ্যে। ধীরে ধীরে জন্ম নেয় দায়িত্বশীলতা।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাচ্চারা যখন অভিভাবক হয়ে শাসন করে তখন নিজেদের ভুল পন্থা বা শব্দগুলোকে চিনে নেয়া যায়। আর সবচেয়ে মজা হচ্ছে, এই ছোট্ট ছোট্ট আব্বা-আম্মাদের শাসন-ধমক আবার শৈশবের সোনালী সেই দিনগুলোর আবেশ ছড়িয়ে যায় মনে। আর আমার মতো ঠাসবুনোটের কবিদেরকে দিয়ে যায় কিছু কাব্যের ছন্দ-
শিশুরা পারে ভিজাতে আনন্দানুভুতির বারিধারায়
রাঙাতে পারে মন যেমন আছে প্রজাপতির ডানায়
সুর্যগ্রহণের মতো গ্রাস করে মনের যত দুঃখ-ব্যথা
মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ায় আধো আধো বোলে কথা।
বিষয়: বিবিধ
১০৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন