হাসিনাকে সংলাপে বসার তাগিদ মোদির দুই প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন আলাপ : ক্রসফায়ার বন্ধে ভারতের চাপ : খালেদাকে গ্রেফতার না করার পরামর্শ
লিখেছেন লিখেছেন মামুন আব্দুল্লাহ ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৪:৩৫:৩১ রাত
আজকাল প্রতিনিধি: বাংলাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধে দেশজুড়ে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতি অবসানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ছে। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও ক্রসফায়ার বন্ধে শেখ হাসিনাকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। টেলিফোন আলাপে মোদি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করতেও প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। নরেন্দ্র মোদি বিরোধী জোটের সাথে সরকারকে সংলাপে বসারও তাগিদ দিয়েছেন। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্পর্শকাতর এ টেলিফোন আলাপ নিয়ে কোনো পক্ষই মুখ খুলতে রাজি নন। তবে, সরকারি একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র আজকালকে জানিয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের সামনে থেকে পুলিশী প্রহরা উঠিয়ে নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ দেয়ার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এই টেলিফোন সংলাপে বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত তথা ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের আজ ২৫ দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই ২৫ দিনে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা পাওয়া গেছে ৪১ জন। এর মধ্যে পেট্রোল বোমা ও আগুনে নিহত হয়েছেন ২০ জন। সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ১০। আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-সহ অন্যান্য ঘটনায় আরো ১১ জন নিহত হয়েছেন। যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। ৫ দফা নাশকতা হয়েছে রেলে। এই পরিস্থিতি শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হন। তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় অফিসের মূল ফটকে। টানা দুই সপ্তাহ অবরুদ্ধ থাকার পর শেষমেষ মুক্ত হন তিনি। জানা যায়, ভারতের পরামর্শে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের তালা খুলে দেয়। সরিয়ে নেয়া হয় ইট, বালির ট্রাক ও জলকামানের গাড়ি।
এ অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে শেখ হাসিনার টেলিফোন আলাপ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে চলছে কানাঘুষা। সরকারি একটি সূত্র জানিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে টেলিফোনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। টেলিফোনে মোদি খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ না রাখার আহ্বান জানান। তিনি বিএনপি নেত্রীকে গ্রেফতার না করতেও শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেন। সূত্র জানায়, দুই নেতার মধ্যে টেলিফোন আলাপে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও ক্রসফায়ার বন্ধেরও তাগিদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও সরকারকে চাপ দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসান করতে দেশের অভ্যন্তরেও নানা মহল থেকে ইতোমধ্যে দুই পক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সর্বস্তরের জনগণ, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়িক মহল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে সংলাপের দাবি উঠছে জোরেসোরে।
বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে লাগাতার এ অবরোধ কর্মসূচিকে দাবি আদায়ের কর্মসূচি বলা হলেও বিষয়টিকে রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে আমলেই নিচ্ছে না সরকার। তারা বলছে, এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, এটা নাশকতা ও সন্ত্রাস। এতে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে সরকার কিছুটা হলেও তার অবস্থা পাল্টেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর তার জানাজা ও দাফনে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিও সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জঙ্গীবাদী দল ও বিএনপিকে জঙ্গীবাদের সহযোগী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই বলে এতদিন যে দাবি করা হচ্ছিল কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকারের এ দাবিটি দেশে-বিদেশে যৌক্তিকতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার চাইছে বিএনপি’র সাথে সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিভাবে, কোন উপায়ে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
চলমান সহিংসতা বন্ধ করে দেশের স্বার্থে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিঠি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ। এছাড়া সহিংসতা বন্ধে এরশাদ ইতোমধ্যে অনশনও শুরু করেছেন।
বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী চলমান সঙ্কট নিরসনে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে সাত দিনের সময়সীমা বেধে দিয়েছেন। তিনিও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।
সাবেক এই দুই রাষ্ট্রপতি ছাড়াও সংকট নিরসনে দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রীয় অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকমী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেন, যত তড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ও জাতির উন্নতির কথা মাথায় রেখে দুই পক্ষকে সংলাপে বসতে হবে। চলমান নাশকতায় দেশের অধিকাংশ মানুষ চরম আতঙ্কে ভুগছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। দিন দিন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। গরীব মানুষের কষ্ট হচ্ছে। চরম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন দ্বগ্ধ ব্যক্তিরা। তিনি বলেন, এই বিষয়গুলো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা ভাবছেন না। তারা শুধু নিজের দল ও ব্যক্তি স্বার্থের কথা ভাবছেন। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু অন্তরে তাদের বিষ। রফিক উল-হক আরো বলেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কুলখানিতে যোগ দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিমন্ত্রণ করতে পারেন। কুলখানিতে দুই নেত্রী মুখোমুখি হলে অনেক বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। একটা সমাধানও হয়ে যেতে পারে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে একদল প্রকাশ্যে গুলির নির্দেশ দিচ্ছে অপরদিকে অন্যদল ক্ষমতায় আসার জন্য পেট্রোল বোমা হামলা চালাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য জাতীয় সংলাপের কোন বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা ক্ষমতায় আর যারা বিরোধী জোটে আছে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য। যদি দলগুলো এই আলোচনায় না বসে, আর এভাবে চলতে থাকে তাহলে খুব শিগগিরই এই দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেইন খালেদ বলেন, কোন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই তা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে, যাতে রাজনীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শুধুমাত্র বর্তমানের সমস্যা সমাধানের পথ বের করলেই চলবে না, যে কোন রাজনৈতিক সংকট এমনভাবে সমাধান করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের সংকট সৃষ্টির আর কোন সুযোগ না থাকে।
বিষয়: বিবিধ
১০৩৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন