ইয়াহুদিদের সর্বশেষ দুর্গ "দোমাত আল জান্দাল"। (ছবি ব্লগ)
লিখেছেন লিখেছেন ফখরুল ২৫ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:৫৯:২৯ সকাল
দাতা হাতেম তাঈ এর বাড়ী থেকে আমাদের গাড়ী ছুটে চলল আল জউফ অঞ্চলের সাকাকা শহরের দিকে। মুল উদ্দেশ্য ইয়াহুদিদের সর্বশেষ দুর্গ দোমাত আল জান্দাল দেখা।
সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিমে আল জউফ প্রদেশের সাকাকা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে এই দুর্গের অবস্থান।
তৎকালীন সময়ে এই স্থানটি আরবদের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকেই এই স্থানটি ছিল আরবদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুমাত আল জান্দাল এটি একটি আরবি শব্দ, আরবি শব্দ দুমাহ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি, দুমাহ একটি পাথরের নাম। এর পূর্ব নাম ছিল আদ্দুম্মাতু। হযরত ইসমাইল (আঃ) এর ১২ ছেলের মধ্যে ৬ষ্ঠ ছেলের নাম ছিল দুমাহ সেখান থেকেই এই স্থানটির নাম করন করা হয়েছিল। এই দুর্গটি আনুমানিকভাবে ১৮-২০ স্কয়ার কিঃ মিঃ হবে। দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল ইট, পাথর, কাদা মাটি, চুন এবং কিছু ক্ষয়িষ্ণু গাছ দারা। দুর্গের ভিতরে মোট ৩ টি কূপ এবং বাহিরে আরও ছোট বড় অনেকগুলো কূপ লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম পূর্ব যুগে এই স্থানটি তৎকালীন সময়কার আরবের ৫ জন শক্তিশালী রানী দারা শাসিত হয়েছিল। তথ্য সূত্র অনুযায়ী এই পাঁচ জন রানীর মধ্যেঃ- ক) জাবিবি খ) শামসি গ) তাবুয়া ঘ) তিলহুনু প্রমুখ ছিল অন্যতম। কিন্তু এই শহরটি হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মেরও প্রায় ১০ শতাব্দী পূর্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তৎকালীন সময়ে এই স্থানটি এসারিয়ান গোত্র দারা পরিচালিত ছিল।
ইসলামের প্রথম যুগে অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলেও এই স্থানটি ছিল ইয়াহুদিদের দখলে, তবে সেটা ছিল শর্ত সাপেক্ষে, পরবর্তীতে শর্ত ভঙ্গ করার কারণে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনামলে এসে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে এই স্থানে সৈন্য পাঠানো হয়। এবং ইয়াহুদীরা তাদের এই দুর্গটি ছেড়ে চলে যায়। এই হল খুবই সংক্ষেপে এই দুর্গের পূর্ব ইতিহাস।
এখানে এসে মেইন গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই হাতের ডানদিকটায় বেশ উঁচু এবং বড় যে দুর্গটি লক্ষ্য করা যায়, এটিই সেই ঐতিহাসিক দুমাত আল জান্দাল (মারিদ ক্যাসেল)। ঠিক এই দুর্গটির সামনে দুটি বোর্ড লাগানো আছে, যা সৌদি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক এখানে স্থাপন করা হয়েছে। বোর্ড দুটিতে আরবিতে এবং ইংরেজিতে যা লেখা আছে।
ওমর বিন খাত্তাব মসজিদ
এই মসজিদটি খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। হযরত ওমর (রাঃ) বাইত আল মাকদিস থেকে আসার পর মসজিদটি নির্মিত হয়। এই মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর নকশা ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদের অনুকরণে করা হয়েছিল। এই মসজিদটি বহু পুরনো একটি মসজিদ, এর মিনার এবং মূল নকশা ইসলামের প্রথম মসজিদের আদলে করা হয়েছিল। এটি এমন একটি মিনার যা ইসলামের ইতিহাসের পুরাতন মিনারগুলোর সাক্ষী বহন করে। এই মিনারটি দক্ষিণ পশ্চিম কর্নারে কিবলার দেয়ালে। এই মিনারটির ফাউন্ডেশন ৩ স্কয়ার মিটার লম্বা, পাথর দারা তৈরি এই মিনারটি আস্তে আস্তে সরু হয়ে একটি সেমি কোনের মত হয়ে সমাপ্তি হয়েছে। এই মিনারটি পুরো আরব দেশগুলোর মধ্যে বহু পুরনো একটি মিনার যা তৈরিতে আল জান্দাল পাথর ব্যাবহার করা হয়েছিল, এই মিনারটির উচ্চতা ৭.১২ মিটার। আর এটা তৈরির কারণ ছিল দুর্গ এবং আল দিরা শহর।
মারিদ দুর্গ
এই দুর্গের সবচেয়ে পুরাতন বর্ণনা উল্লেখিত হয় তৃতীয় শতাব্দিতে । যখন তাদ্মুরের রানী যানবিয়া দাওমাত আল-জান্দাল এবং তাইমায় আক্রমণ করেন,এবং দুর্গ জয় করতে অক্ষম হন । তখন তিনি তার বিখ্যাত বাক্যটি বলেছিলেন “বিদ্রোহী হয়েছে মারিদ আর মূল্যবান হয়েছে আল-আব্লাক”। আরবি ভাষায় মারিদ বলা হয় যাকে পরাজিত করা সম্ভব না ।
মারিদ দুর্গে বিভিন্ন সময়কালের ভবন রয়েছে ,এর মধ্যে আছে কিছু প্রাচীনতম ভবন যা সভ্য উন্নতিশীল যুগের , নাবাতিউন সময়কালের বলে ধারনা করা হয় , কারন এই দুর্গের ভিতরে এবং বাহিরে সেই সময়কার কিছু প্রাচীন মূর্তি পাওয়া যায় । কিছু ভবন যুক্ত হয়েছে অথবা নতুন করে নির্মিত হয়েছে ক্ষয়প্রাপ্ত ভবন গুলির পরিবর্তে যা ইসলাম আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়কার হবে। আরো কিছু ভবন আছে যা দুর্বল পদ্দতিতে কাদামাটি আর চুন দিয়ে নির্মিত ,পরবর্তী সময়ের আশি বৎসর পর নির্মাণ করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়
আমি আর সফর সঙ্গী মামুন এই দুর্গের বিভিন্ন নিদর্শনগুলো একটি একটি করে আমাদের ক্যামেরা বন্ধি করছিলাম। ইতিমধ্যেই আমাদের সাথে আসা ভ্রমণার্থিরা ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেল। আমি দুর্গটি ঘুরে দেখার সময় মনে হয়েছিল তৎকালীন সময়কার লোকজন খুবই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ ছিল। কারন দুর্গটি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে দেখা যাবে, কিভাবে তারা অনেক বৃহতাকার ইটের সাথে একেবারে ক্ষুদ্রাকার পাথরের সমন্বয় ঘটিয়েছিল।
এছাড়া এত বিশাল দুর্গের ভিতের পানি সরবরাহের জন্য যে কূপগুলো তারা সে সময় খনন করেছিল, সেগুলো থেকে এখনো পানি নির্গত হচ্ছে। অবশ্য কূপগুলো থেকে এখন আর পানি উত্তলন করা হয়না, কিন্তু একটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই কূপের তলদেশ থেকে পানির শোঁ শোঁ শব্দ কানে বাজে। এই দুর্গের ভিতরে ছোট বড় মোট ৩ টি পানির কূপ দেখা গিয়েছিল, বাহিরে আরও কয়েকটি কূপ ছিল চোখে পড়ার মত। ঘোড়ার আস্তাবলটি এখনো খুব সহজেই চেনা যায়। এই দুর্গের ভিতরে এখন অনেক বড় বড় সিঁড়ি রয়েছে তবে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এই সিঁড়িগুলো কি তৎকালীন সময়ে তৈরি করা হয়েছিল নাকি বর্তমানে ভ্রমণার্থিদের শুবিদার্থে করা হয়েছে, তবে এই দুর্গের সকল কারুকাজ দেখে খুব সহজেই আঁচ করে নেওয়া যায় যে, সে সময়কার মানুষগুলো অনেক বুদ্ধিমান ছিল।
দুর্গের ভিতরে পানির কূপ।
দুর্গের পাশ ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল মুসলমানদের যুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্যাবাস এবং হযরত ওমর (রাঃ) মসজিদ। এই সৈন্যাবাসগুলো ছিল খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। মুসলমানদের সৈন্যাবাসের একটু পরেই অনেক বড় আকারের একটি খেজুরের ঝাড় দেখা যায়, যা উল্লেখ করার মত।
আমরা পুরো সৈন্যাবাসটা ঘুরে দেখতে পারিনি। যোহরের আযান হয়ে গেছে তাই আমরা সবাই অজু করে এসে হযরত ওমর (রাঃ) এর মসজিদেই নামাজ আদায় করি। পরিশেষে আমরা যখন রিয়াদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ঠিক তখন আমাদের চোখে আরও একটি সাইন বোর্ড দেখতে পেলাম। দূর থেকে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল এটি সৌদি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে লাগানো হয়েছে। দেরি না করে গাড়ী থামিয়ে ছুটে গেলাম দেখার জন্য।
ভিতরে ঢুকে আমরা সেখানকার দায়িত্বরত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম এটার ভিতরে প্রবেশ করতে হলে কি করতে হবে? আর কি কি দেখা যাবে? সে আমাদেরকে জানালো এখানে প্রবেশ করতে হলে ২০ রিয়াল করে টিকেট কিনতে হবে (জন প্রতি)। আর এর ভিতের সেই সময়কার নানান জিনিস দেখা যাবে। আমরা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সবাই প্রবেশ করলাম। ভিতরে প্রবেশ করেই পূর্বের নেয় আমরা সবকিছু ক্যামেরাবন্ধী করা শুরু করে দিলাম।
জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করতেই হাতের বাম দিকে একটি কক্ষ, যেখানে তৎকালীন সময়ে ব্যাবহৃত বহু জিনিসের পাশা পাশি হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের যুদ্ধে ব্যাবহৃত পোশাকটি সবার নজরে পড়ল। অবশ্য আমাদের ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি এই সব জিনিসগুলো ছিল গ্লাসের ভিতরে। এই পোশাকের নিচে একটি কাগজে আরবিতে লিখা ছিল এই সেই পোশাক যা পরে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ যুদ্ধ করেছেন। এই গ্লাসের ভিতরেই রয়েছে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের যুদ্ধে ব্যাবহৃত তলোয়ার। যে পবিত্র জিনিসগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসে। এই পোশাকটি দেখলেই বুঝা যায় হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ অনেক লম্বা চওড়া দেহের অধিকারি ছিলেন।
আমরা পুরো যাদুঘরটি ঘুরে ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, দুই মস্তকওয়ালা ছাগলের অংশবিশেষ। পুরনো ঘটি বাটি, যুদ্ধে ব্যাবহৃত কিছু ঢাল, তীর, গুলি, বিভিন্ন প্রাণী। তৎকালীন ও বর্তমান মুদ্রার সমন্বয়ে ছিল ৩ টি বক্স। হস্ত অংকিত দুমাত আল জান্দাল দুর্গ, রাসুল (সঃ) এর ব্যাবহৃত সেই পবিত্র পাগড়ী, চাদর, লাঠির একটি ছবি। সেই সময়কার ব্যাবহৃত কিছু হাঁড়ি, পাতিল। হাতে লিখা পবিত্র কোরআন মাজিদ, কিছু দাঁড়িপাল্লা ইত্যাদি। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে ব্যাবহৃত কিছু বোরখা ছিল বেশ চোখে পড়ার মত।
অবশেষে ৩ দিনের সফর সংক্ষেপ করে আমাদের গাড়ী ছুটে চলল রিয়াদের দিকে।
বিষয়: বিবিধ
২৮২৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোস্ট টি স্টিকি করার জোর দাবী জানাচ্ছি।
আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নাই।
বিশেষ করে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর পোষাকটির ছবির জন্য। মনে হচ্ছে এটি চেইমমিল বা ধাতুর টুকরায় তৈরি বর্ম। একটু ভালভাবে বিবরন দিলে বুঝা যেত।
খালিদ (রাঃ) এর তরবারির ছবি টি দেখার আসা করি।
দুমাতুল জন্দল এর এই দুর্গ সম্ভবত হযরত উমর (রাঃ) এর আমলে প্রথম জুনদ বা নিয়মিত সেনাবাহিনির কেন্দ্র ছিল।
খালিদ বিন ওয়ালিদের তরবারিটি এখন তুরস্কের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামের প্রথম যুগে অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলেও এই স্থানটি ছিল ইয়াহুদিদের দখলে, তবে সেটা ছিল শর্ত সাপেক্ষে, পরবর্তীতে শর্ত ভঙ্গ করার কারণে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনামলে এসে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে এই স্থানে সৈন্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে মুসলিম যোদ্ধাগন দীর্ঘ এক মাস ইয়াহুদিদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এবং খাদ্য সংকট দেখা দিলে ইয়াহুদিরা আত্মসমর্পণ করে। এবং ইয়াহুদীরা তাদের এই দুর্গটি ছেড়ে চলে যায়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
দেখি কবে রাজি হয়। অবশ্যই দাওয়াত পাবেন
মন্তব্য করতে লগইন করুন