বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং! চুপ থাকাই শ্রেয়!
লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:১৫:৫৩ রাত
আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন স্বপ্নের বাংলাদেশ। আমরা স্বাধীনতাত্তোর উত্তর প্রজন্মের বাসিন্দা। তাই আমরা দেখিনি ৭১ পূর্ব পরাধীনতার শৃঙ্খল। বৈষম্যের তিক্ততা। প্রতি পদে পদে পাকিস্থানি শাসক ও তাদের শোষণে নিষ্পেষিত বাঙালির দীর্ঘশ্বাস। তবে আমরা জেনেছি আমাদের পূর্বসূরিদের বিরত্বগাঁথা ইতিহাস। তাঁরা অন্যায়কে বেশিদিন সহ্য করে থাকতে পারেনি।
পাকিস্থানি শাসকদের জুলুমের শৃঙ্খল তাঁদেরকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীনতার। শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত একটি সুখি সমৃদ্ধিশালী স্বপ্নের বাংলাদেশের। নিজেদের জীবন দিয়ে তাঁরা সেটা বাস্তবায়ন করে গেছে। আমাদেরকে উপহার দিয়ে গেছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
কিন্তু হায়! দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর অজস্র ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এদেশকে আমরা আবার স্বাধীনতাপূর্ব যুগে নিয়ে যেতে প্রবৃত্ত। আগে যেখানে পাকিস্থানিরা তৈরি করতো বৈষম্যের শৃঙ্খল আর আজ সেই ভূমিকায় আছি আমরা নিজেরাই। চাকুরি ক্ষত্রে বৈষম্য করা হতো জন্মস্থান বিবেচনা করে। আজ আমরা করছি রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে। দেশের সকল নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে আমাদেরকে অন্যায়ভাবে দাবিয়ে রাখা হতো। আজ কী আমরা সেই কাজটিই করছিনা নিজেদের বিরুদ্ধে?
বরং আমরা পাকিস্থানি শাসক ও শোষকদের অন্যায় আর জুলুমের ধরণের মাত্রাকে অনেকখানিই ছাড়িয়ে গেছি। আমাদের নিজেদের সরকার কর্তৃক আমরাই আজ চরমভাবে নির্যাতিত। দেশে এখন এক চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যা করছে করে যাক। দেশ যেভাবে চলছে চলুক। কেউ সমালোচনা করতে পারবেনা। আপনার প্রিয় মুখটি যদি গুম হয়ে যায় তবে আপনি কারও কাছ থেকে কোন সহায়তা পাবেননা। থানা পুলিশ অস্বীকার করবে। বিচারবিভাগ নীরবে দর্শকের ভূমিকা পালন করবে। একদা রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভখ্যাত সংবাদমাধ্যম সময় নিবে গুম হওয়া ব্যক্তির পন্থা যাচায়ের। মুক্তমনা হলে হেভি কাভারেজ পাবে নয়তো এভারেজে যাবে। আপনি এই স্বাধীন দেশেই সবচেয়ে অসহায় অনুভব করবেন। আল্লার কাছে কান্নাকাটি করবেন আর গুম হওয়া প্রিয়জনের লাশটি পাওয়ার একবুক আশা নিয়ে থাকবেন।
আমি আপনি তো আমজনতা আর চুনোপুটি। এদেশের কত প্রভাবশালীদের দেখেননি কথা বলতে গিয়ে, সমালোচনা করতে গিয়ে, মতের বাইরে কিছু দেখাতে গিয়ে কীভাবে নাকানি চুবানি খেল এবং কেউবা এখনো খেয়ে যাচ্ছে। দেশের কয়জন এখন আত্মসম্মানবোধ আর আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে চলে ফিরে থাকতে পারছে? কতটুকু পারছে নিজের মেধা, যোগ্যতা, ও দক্ষতা অনুযায়ী সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের দায় থেকে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নিতে? দেশের বেশীরভাগ সংবাদ মাধ্যম আজ প্রকাশ্যভাবে এবং নির্লজ্জ নজিরবিহীনভাবেই সেল্ফ সেন্সরড। কিছু কাপুরুষোচিত ভয়ে। কিছু হয়রানির তিক্ত স্বাদ নিয়ে। আর কিছু প্রচলিত স্রোতের সাথে মিশে গিয়ে।
তাইতো পূর্বে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ পেয়ে এবং তার কিছুটা সদ্ব্যবহার করে সময়ের ব্যবধানে উঠে আসা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আজকের প্রধান সারির পত্রিকা হলেও পারছেনা স্বকীয়তা ধরে রাখতে। ৯৬ থেকে ২০০০ সালের সেই ঝাঝ আজ আর নেই। এদেরই একজন কিছুদিন আগে সবার অলক্ষ্যে স্রোতে মিশতে গিয়ে খোশমেজাজে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি আচ করে অতীত কর্মকান্ড নিয়ে সরকারের চোখে নিজের বিতর্কিত চেহারা শুদ্ধ করার প্রয়াসেই এটি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাহবা প্রাপ্তির পরিবর্তে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও নজিরবিহীনভাবে যা পেলেন তাতে শুধু হতভম্ভই হলেননা মনে মনে হয়তো ফ্রাঙ্কেইস্টাইনের ট্রাজেডির কথা জপ করছিলেন। যাহোক তাকে সেই ট্রাজেডির স্বীকার হতে হয়নি। হয়তো গোপনে আপসরফা করেই এখন তাঁর স্বাধীন (?) বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে যাচ্ছেন। সর্বোচ্চ আদালতের যুগান্তকারি এক রায়ের মাধ্যমে যে নাটকের পরিসমাপ্তি আমরা দেখতে পেলাম। যাহোক গোটা প্রেক্ষাপটে নাকানি চুবানি শুধু উনি একাই খাননি সেই সাথে পরোক্ষভাবে খেয়েছেন এদেশের সুশীল দাবিদার সকল এনজিও, থিংকট্যাংক, মিডিয়া, এবং সেক্যুলারবান্ধব গোষ্ঠিগুলো। ডানপন্থি মিডিয়া ও সংবাদিক গুলোর প্রসংগটা বাদই দিলাম। কারণ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে তো অনেক আগেই। এদেরই অনেকেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে।
দেশের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ। সেই বিভাগ কি মুক্ত থাকতে পারছে সরকারের প্রভাব বলয় থেকে। কয়েকদিন আগেই তো দেখলাম সরকারের বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের তর্জন গর্জন আর সব ভয়ঙ্কর হুঙ্কার এই বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তাকে কেন্দ্র করে। আর আমরা তো আমজনতা! দেশে আজ প্রতিদিন ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে আর বিচারালয় নীরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যেন দোষীদের আজ বিচার করার কোন দায় নেই বা আদালতের কাছে বিচার পাওয়ার কোন অধিকার নেই। শুধু কি এই? গুটি কয়েক রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ও দূর্নীতিগ্রস্থ পুলিশ, র্যাব কর্মকর্তার প্রনিয়ত শিকার হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের কর্মী সমর্থক। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই পাওয়া যাচ্ছে খালে বিলে গুম হওয়া ব্যক্তির লাশের খবর। স্বাধীন বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, জাতির বিবেক নাগরিক সমাজ কি পারছে এগুলোর লাগাম টেনে ধরতে!
দেশের সাংবিধানিক কোন প্রতিষ্ঠানই পারছেনা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে এখতেয়ারভুক্ত কর্মসম্পাদনের। দেশে এখন ভোট হয় কিন্তু ভোটাধিকার নেই। ভোটের দিন যেন জীবন নিয়ে হোলিখেলার মহড়া চলে। চোখের সামনে কেন্দ্র দখল, জালভোট, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, চাপ দিয়ে প্রার্থিদের বসিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানান অনিয়ম ঘটে গেলেও এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের গাট নেই সেগুলো স্বীকার করে বা নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে পদত্যাগ করা। সবাই আজ যেন কোন একটা গোষ্ঠির কাছে বিবেক বন্ধক দিয়ে দিনাতিপাত করছে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! আমরা না স্বাধীন জাতি! আমরা কীভাবে পারি আমাদের নীতির কাছে, আমাদের নৈতিকতার কাছে, আমাদের দায়িত্ববোধের কাছে, আমাদের চেতনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে!
এখন এমন একটা সময় চলছে যেখানে আমরা না চাইলেও বাধ্য হচ্ছি। কারন বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং। কে চাই গুম খুন হতে! আমরা ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি। চুপ থাকলেই যেন শ্বাস নিতে পারবো। বেশী চেচামেচি করলেই বিপদ। চারিদিকে যা ঘটে ঘটে যাক। চোখ বন্ধ করে থাকায় শ্রেয় মনে হয়। কিন্তু সবাইকেই তো একদিন মারা যেতে হবে। মৃত্যু যেখানে সবার জন্য অবধারিত সেখানে মৃত্যু ভয়ে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া আজ শত অন্যায়ের সামান্যতম প্রতিবাদ না করে প্রকারান্তরে দেশকে এক ভীতিকর জঙ্গলে পরিণত করার সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যতের মহাবিপদের প্রতীক্ষায় থাকা কতটুকু শ্রেয় সেটাই ভাবার বিষয়।
বিষয়: বিবিধ
১৩০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন