বাংলাদেশের আরেকটা ব্যাংক জালিয়াতি

লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৫৯:১৮ রাত

বাংলাদেশের একের পর এক ব্যাংক লুট এবং আর্থিক খাতের নানা অব্যাবস্থাপনা নিয়ে দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে এক চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে এখানে অনুবাদ করে দিলাম।



গত ফেব্রুয়ারী মাসের চার তারিখে বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার তার নিউইয়র্কে অবস্থিত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে চুরি হয়ে গেল। এ পর্যন্ত কেবলমাত্র ২০ মিলিয়ন উদ্ধার হয়েছে এবং আজ অব্দি অজানায় রয়ে গেছে কে টাকাগুলো সরিয়েছে অথবা এর শেষ গন্তব্যস্থলই বা কোথায়। টাকা লুটের এই ঘটনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যাংক ডাকাতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা যে এটাই প্রথম এটা বলা দুষ্কর। হ্যাকিং এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রেজার্ভের এত বড় জালিয়াতি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকে নিত্যনৈমিত্তিক অর্থলুট ও এর সাথে অভিযুক্ত হোতাদের কর্মকান্ডের সাথে তুলনা করলে বলা যায় তেমন কিছুই না।

রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ টি বানিজ্যিক ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংক গুলোর মোট সম্পদের এক চতুর্থাংশের মতো নিয়ন্ত্রন করে থাকলেও সরকারের সাথে সংযোগ থাকার কল্যানে অর্থনীতিতে এই ব্যাংকগুলোর প্রভাব ধারণার চেয়েও অনেক বেশী। উদাহরণস্বরূপ, আইএমএফ এর ভাষ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক গুলোর অপরিশোধিত লোনের উপর উচ্চমাত্রার সুদযুক্ত থাকে এবং আধুনিক অর্থনীতিতে যেটা ৪% এর মতো সেখানে তার তুলনায় এ সমস্ত ব্যাংকগুলোর গড় সুদের হার “মাত্রাতিরিক্ত বেশী” যেটা প্রায় ১১% এর মতো।

এ অবস্থার একটা ব্যাখ্যা হতে পারে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের অপরিপক্ক ব্যাবস্থাপনা, কিন্তু প্রধান কারণ হলো এগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়ার দেশীয় সংস্কৃতি।

দেশের স্বরণকালের সবচেয়ে বড় অর্থ জালিয়াতি ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক। ঢাকা ট্রিবিউনের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখাই অবৈধভাবে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলারের ছাড় দিয়েছিল লোন হিসাবে যার মধ্যে প্রায় ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত ছিল টেক্সটাইল ব্যাবসার সাথে সম্পর্কিত হল মার্ক গ্রুপ। হলমার্কের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক তানভির মাহমুদ একজন শাখা ম্যানেজারের সাথে যোগসাজশ করে ভুয়া একটা কোম্পানি দেখিয়ে লোন হাতিয়ে নিয়েছিল।

জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরও সোনালী ব্যাংক উচ্চমাত্রায় এধরণের ঝুকিপূর্ণ ঋণ দেওয়া অব্যহত রেখেছিলোঃ বর্ণিত আছে ২০১৪ অর্থবছরের শেষের দিকে সেটা ৩৭% চেয়েও উপরে ছিল। সেইসাথে বাংকটি রাষ্ট্রায়াত্ত অন্য ৫ টি বানিজ্যিক বাংকের সাথে সাথে সরকার কর্তৃক নিয়মিত পুনঃ অর্থবরাদ্দ পেত- ২০১৪ অর্থবছরে পরিমাণে তা ৬৪০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটি অনুমেয় ছিল যে ২০১৫ অর্থবছরে তা ছিল ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ও উপরে।

এসব ব্যাংকগুলোর বার বার বিবেচনাহীন লোন দেওয়ার প্রবৃত্তি – একই সাথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেগুলো আদায়ে রাষ্ট্রের পুনঃ পুনঃ অবিবাচনাপ্রসূত উদ্যেগ- এসবের পেছনে আংশিক জড়িত ব্যাবসায়ীদের সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের মিলিত দুরভিসন্ধি।

ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ২০০৮-১১ সনে রাষ্ট্রায়ত্ত বানিজ্যিক ব্যাংক জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য ছিলেন যিনি সেনাসমর্থিত তত্বাবাধয়ক সরকার যেটি ২০০৭-০৮ সনে দেশকে শাসন করেছিল কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ঢাকাতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ২০০৮ সালে দেশ বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার পর থেকে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা ও যোগ্যতা যাচাইয়ে তার ব্যাবসায়িক সম্ভবনাকে না দেখে দেখা হইয়েছে প্রভাব প্রতিপত্তি অথবা প্রভাবশালীদের সাথে যোগশাযসকে।

মিসেস খাতুন বিশেষভাবে যোগ করেন, যে ঋণগুলো ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যাংক পরিচালকদের অনুমোদন দেওয়া সেগুলোই প্রায় সর্বদাই খেলাপি হয়েছে।

উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং বেক্সিমকো নামক ওষুধ ও কাপড় রপ্তানিতে বিষেশায়িত একটা বড় ব্যাবসায়িক গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমানের কথা। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ২০০৭ সালের প্রেরিত এক তার বার্তায় মিঃ রহমানকে “আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ঋণখেলাপি ব্যক্তি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল যেটা পরবর্তিতে উইকিলিক্‌সের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অর্থ জালিয়াতির জন্য ২০০৭-০৮ সনে তত্ত্বাবাধয়ক সরকারের সময়ে তিনি কারাভোগ করেছিলেন।

গতমাসের প্রথম দিকে তার ঢাকা অফিসে বসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিঃ রহমান আমাকে বলেছিলেন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক গুলো কাছে তিনি প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋনী। ঋণ পরিসেবা না দেওয়ার জন্য তিনি বিগত সরকারকে দোষারোপ করলেন যা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামিলিগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল কর্তৃক পরিচালিত ছিল।

আমরা যে সময় তার সাথে সাক্ষাৎ করছিলাম সেই সময়ে তিনি অবশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামিলিগের সভাপতি শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা হিসাবে কর্মরত। তিনি এও বলেন বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তার ঋণ “কিছুটা কাঁটছাঁট ও নবায়ন করছে।”

মিঃ রহমানই একমাত্র ব্যাতিক্রম নয়। ২০০৯ এবং ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাসিক ব্যাংক থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে যদিও এই জালিয়াতির সন্দেহভাজন মূল হোতা ঐ ব্যাংকেরই সাবেক চেয়ারম্যান যাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে এখন পর্যন্ত কোন ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নাই। কানাঘুষা রয়েছে যে সেটি সম্ভব হয়েছে তার রাজনৈতিক যোগসাজশের কারণেই। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন রাজনীতিবিদদের করয়াত্বে।

রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান গুলোর দূর্বলতা এবং পরিচালনায় অপ্রতুল অনুদান প্রাপ্তি এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। বিশেষজ্ঞ, অডিটর, আদালত- যারা কিনা দেশের প্রচলিত রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ্‌দের নিয়ন্ত্রনে রাখতে এসব প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত জনবল অথবা শক্তি সামর্থ কোনটায় নেই।

এটা প্রকারান্তরে এজন্য যে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম কম ট্যাক্স ও জিডিপির অনুপাতধারী দেশ, যার অনুপাত ১০% এর চেয়েও কম। দক্ষ জনবল ও সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা কর আদায়ের পথে অন্তরায়। ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুলোর উপর প্রচুর কর ধার্য করা আছে কিন্তু ঘুষের মাধ্যমে এগুলো ফাঁকি দেওয়া যে কারো পক্ষে খুব সহজ। ফলশ্রুতিতে আমদানির উপর মাত্রাতিরিক্ত টাকা ধার্য করা থাকে যা কেবলমাত্র আমদানিকারকদের প্ররোচিত করে কৌশলে কর ফাঁকি দিতে।

তারপর আসে মুদ্রা পাচারের বিষয়টি। তুমি যদি বাংলাদেশের ন্যায় রাষ্ট্রিয় সম্পদ চুরি কর তবে তুমি স্বভাবতই সেই সম্পদ অন্যকারো খপ্পরে পড়ে হারানো বা সরকার কর্তৃক জব্দ হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইবেনা। আর সেই কারণে তুমি টাকাগুলো পাঠিয়ে দিবে সুদুর বিদেশে, দেশের কর সংগ্রাহকদের শিকারি দৃষ্টি থেকে নিরাপদ দুরত্বে, এমনসব দেশে যেখানে করের পরিমান কম কিংবা স্বচ্ছতা নিরুপনে আইনি বাধ্যবাধকতা স্বল্প।

গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি নামক এনজিও’র ভাষ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯.৭ বিলিয়ন ডলার মুল্যের অবৈধ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে যা কিনা ২০০৪ সালে পাচার হওয়া ৩.৩ বিলিয়ন ডলার থেকে অনেক বেশী। এই অর্থ ঐ বছরের অর্জিত জিডিপি’র শতকরা ছয়ভাগেরও বেশী এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রাপ্ত বৈদেশিক সহাহয়তার ৩.৫ গুনেরও বেশী।

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এই অর্থগুলোর উপর কর আরোপিত হওয়ার দরকার ছিল। যদি কর ধার্য করা হতো তাহলে ব্যাংক জালিয়াতির পরিমাণ ও কমে যেত এবং অপেক্ষাকৃত কম টাকা বিদেশে পাচার হতো।

এই জন্য কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যগুলোকে অবশ্যই আরো স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হতে হবে। সেইসাথে বাংলাদেশকে তার নিজের অংশে অবশ্যই অবৈধ অর্থ পাচারের টুটি চেপে ধরতে হবে এবং অনেক বেশী অর্থ সংগ্রহ ও আয় করার জন্যে এর করবিভাগের ব্যাপারে পূনর্বিবেচনা করতে হবে।

এসব পরিবর্তনের অর্থই হলো বড় ধরণের সংস্কার সাধন, অবশ্যই করবিভাগের, আইনি প্রক্রিয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর এক্ষেত্রে যে সব প্রভাবশালী মহল বর্তমান অবস্থা থেকে উপকৃত হচ্ছে এটা সম্পাদন করতে খুব কমই উৎসাহী হবেন সেটাও স্পষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশের একটা একটা যুগোপযোগি রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র দরকার যদি এটা লোভী রাজনীতিবিদ্‌দের লাগাম টেনে ধরতে চাই।

মূল প্রতিবেদনের লিংকঃ

null

http://www.nytimes.com/2016/04/12/opinion/bangladeshs-other-banking-scam.html?partner=IFTTT&_r=1

বিঃদ্রঃ অনুবাদে ত্রুটি (যদি থাকে) এবং ভুল বানানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

রোজবাড

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

365587
১৩ এপ্রিল ২০১৬ সকাল ০৯:২৭
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : রায়, মুখার্জী, ব্যানার্জী, দাস, পালরা জায়গামত বসে আছে। লুট হবে না তো কি হবে?
365737
১৪ এপ্রিল ২০১৬ বিকাল ০৫:১৩
চিন্তিত পথিক লিখেছেন : চুনোপুটিতে আর হচ্ছেনা।
এখন
মারি তো গন্ডার;
লুটি তে ভান্ডার...

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File