যুগে যুগে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” নামক পরশ পাথরের স্বার্থক ব্যাবহার আর বর্তমানের যুদ্ধাপরাধী খতমের উন্মাদনা!

লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ০৬ মার্চ, ২০১৩, ১২:২৭:১০ রাত

এদেশে সাম্প্রতিক কালের গজিয়ে উঠা বেশীরভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শ, মালিক পক্ষের ব্যাবসায়িক স্বার্থ, সরকারের রক্তচক্ষুর উপরে উঠে দেশের গণমানুষের সত্যিকারের কল্যানে ভূমিকা পালন করতে ব্যার্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো কাদাছুড়াছুড়িতে তারাও কম যাননা। সাংবাদিকতার নীতিমালাকে তোয়াক্কা না করে একপেশে সংবাদ পরিবেশনে এরা যথেষ্ঠ পারঙ্গম। এদের অনেকের কাছেই আজ মানবাধিকারের বিষয়টি চিহ্নিত হচ্ছে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংখ্যালঘু নামক দুটি অদ্ভুত পরশ পাথরের স্পর্শ দ্বারা। তাই কিছু কিছু মিডিয়া আজ দশ হাজার গাছ হারিয়ে শোকে বিহবল হয়ে গেলেও জনগণের করের টাকায় পালিত পুলিশ বাহিনীর দ্বারা সেই একই জনগণের উপর চালানো নির্মম হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব!

কয়েকদিনের ব্যাবধানে ঝরে যাওয়া ১৪৩ টি প্রাণ এসব মিডিয়ার বিবেকের কাছে মানবতাবোধের চরম লঙ্ঘনরূপে ধরা দেইনি। হয়তোবা তাদের বিবেকে লালিত মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত চেতনা নামক পরশ পাথর এদেরকে মানুষ হিসাবে সনাক্ত করতে পারেনি! তথাকথিত বললাম এজন্যই যে এটা এমন একটা অদ্ভুত চেতনা যা স্বাধীনতা প্রাপ্তির একেবারে প্রারম্ভে ১৯৫ জন পাকিস্থানী আর্মীকে যারা কিনা হত্যা, ধর্ষন, লুটপাটের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল তাদেরকে ক্ষমা করে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেই ক্ষান্ত হয়নি বরং "বাংলাদেশ জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়" মর্মে ঘোষণা দিয়ে জাতিকে ইতিহাসের পাতায় চরম ক্ষমাশীলতার মানদন্ডরূপে উপস্থাপিত করে ঐতিহাসিক অধ্যায় সূচিত করে রেখেছে।

এটা এমনই একটা চেতনা যা স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঐ সময়ে হাজার হাজার মানুষকে পাকিস্থানের ঐ হানাদারদের নৃসংশ কাজের সহযোগিতার দায়ে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারলেও আজকে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর যাদেরকে হত্যা, ধর্ষন ও লুটতরাজের সাথে সম্পৃক্ততা দেখিয়ে রগরগে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে তাদেরকে আশ্চার্যজনকভাবে ঐসময় একটা মামলার আওতায়ও আনতে পারেনি।

যে চেতনা আজ মানবাধিকারের চিরাচরিত ধারণাকে পরিবর্তন করে জাতির একটা অংশকে খতম করার জন্য আরেকটি অংশকে উন্মাদ করে ফেলেছে সেই একই চেতনার ঝাঝ এক সময় নিষ্ক্রিয় ছিল যখন কিনা আজকের এই উন্মাদগ্রস্থদের কাছে জাতির ওই একই অংশ পরম বন্ধু ও রাজনৈতিক মিত্র রূপে সহাবস্থানে ছিল।

সময়ের ব্যাবধানে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেমন এই চেতনার লালনকারীদের স্বীকৃতি দিতে মুক্তিযুদ্ধ সনদের ছাপাখানার চাপ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে তেমনি রাজনৈতিক বক্তব্য বিবৃতিতেও এই চেতনার পরিপন্থীদের সংখ্যাও বেড়েছে আনুপাতিক হারে। নব্যরাজাকার শব্দটির স্বার্থক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ব্যবহারের দ্বারা শেষোক্তদের সংখ্যার আনুপাতিক বৃদ্ধিকে লগারিদমিক প্রবৃদ্ধির রূপ দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত সফলভাবে।

আর এই প্রবৃদ্ধির ঝাপটায় আজ যে দিকে তাকায় সেদিকে দেখা যায় শুধু স্বাধীনতার তথাকথিত দুশমনদের। হয়তো এজন্যই স্বাধীনতার ঐ অদ্ভূত চেতনার ধ্বজাধারীরা আজ ৪২ বছর পর নির্মূল নামক নেশা দ্বারা এতোটা উন্মাদ্গ্রস্থ। নতুন প্রজন্মের একজন হিসাবে আমি কিছুতেই মিলাতে পারিনা কীভাবে আজকের এই উন্মাদ গ্রস্তরা একসময়ের জামায়াত শিবির নামক সদ্য অঙ্কুরিত চারা গাছের দু তিনটা পাতা থেকে ব্বিচ্ছুরিত স্বাধীনতার চেতনা বিধ্বংসী এরোসোল জাতীয় গন্ধ সহ্য করে গেছে। কেনইবা প্রবল শক্তিতে শক্তিয়মান থাকা সত্বেও ঐ সেসময় ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি ঐ দু’তিনটা পাতা।

অথচ এরপর স্বাধীনতার ৪২ টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। প্রতিটি বসন্তেই সেই বৃক্ষে গজিয়েছে নতুন নতুন পাতা। সেই সময়ের সেই চারাগাছটি পত্র পল্লবে বিকশিত হয়ে আজ বিশাল বট বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সারা দেশ খুঁজে যে জামায়াত শিবিরের দু'তিন হাজার নেতা কর্মী খুঁজে পাওয়া দুস্কর ছিলো আজ সারা দেশে সেই জামায়াত শিবিরে তৈরী হয়েছে লাখ লাখ নেতা কর্মী। দেশের সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আজ তাদের রয়েছে শক্ত রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক। দেশের গনতান্ত্রিক রাজনীতিতেও তাদের ভূমিকা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

তাই আমরা আজ নতুন প্রজন্মের অনেকেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যখন দেখি যে গোষ্ঠীটি সেই সময়ের চারাগাছটির দু'তিনটি পাতা না ছিড়ে বরং সেই পাতার সুঘ্রান নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে সেই পাতার রসকে পলিটিক্যাল টনিক রূপে ব্যাবহার করে গেছেন সেই একই গোষ্ঠীটি আজ কেনইবা এই বিশাল বটবৃক্ষকে ধ্বংস করতে এতো উন্মাদ। কেনইবা নতুন প্রজন্মের মধ্যে আজ ঘৃণার বিষবাস্প ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে খতম করো, নির্মূল করো, জবাই করো, নিষিদ্ধ করো জাতীয় প্রচারণা দিয়ে!

তারা ভালো করেই জানে বিশাল এই বৃক্ষের কর্তিত ধ্বংস স্তুপের চাপায় নিজেদের ঘর ভেংগে তছনছ হয়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। তারপরো তারা উন্মাদ। দেশের বর্তমান সহিংসতা ও ঝরে যাওয়া শতাধিক প্রাণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই বিকৃত উন্মাদনারই ফসল। দেশের প্রধান প্রধান মিডিয়া, বুদ্ধিজীবিদের একটা বড়ো ও দলবাজ অংশও আজ একই উন্মাদনাই আক্রান্ত।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বার্থান্বেষী উন্মাদনায় এসব বাতিকগ্রস্থরা আজ দেশের বিচার ব্যাবস্থার উপর দৃশ্যমান হস্তক্ষেপ করেই স্থির থাকতে পারছেনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খতমের এই বাতিক তারা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে শাহবাগে স্থাপন করিয়েছে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ। অন্যায় ভাবে নির্মূলের মিশনে তারা ট্রাইবুনালের উপর আস্থা না রাখতে পেরে সুকৌশলে ঐ মঞ্চ থেকে পরোক্ষভাবে প্রেসার দেওয়া হচ্ছে বিচারকদের কার্যাবলীর উপর। আর এর সুফল পাওয়া মাত্রই স্থায়ী করার উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে ঐ মঞ্চ। স্থায়ী রূপ দেওয়া হচ্ছে নির্বাচিত সরকারের প্যারালালে একটা অনির্বাচিত সরকার রূপ শক্তিকে। যেখান থেকে ডিক্টেট করা হচ্ছে কী করতে হবে আর কী হবেনা। প্রতিনিয়ত ছড়ানো এই জাতীর মধ্যে ঘৃণার বিষবাস্প। যার ভাবসা গরমে দেশ আজ বিভক্তির গভীর ক্ষতে ক্ষতবিক্ষত। পুলিশ মারছে নিরপরাধ নারী পুরুষ ও শিশুকে। নির্যাতিত বিক্ষুব্ধ জনতা আক্রমন করছে পুলিশকে। ভাংচুর চলছে দেশের বিভিন্ন অংগ প্রতিষ্ঠানে। পরিণতিতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড স্থবির হয়ে গেছে। প্রবল হয়ে উঠেছে গৃহযুদ্ধের আশংকা।

এমতাবস্থায় সময় এসেছে সব কিছু নতুন করে ভেবে দেখার। দরকার জাতীর মধ্যে একটা প্রবল ঐক্যমত্যের। নির্মূল বা হানা হানি নয় সব কিছুর ব্যাপারে একটা গঠনমূলক উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আর এর জন্য জাতীর সুস্থ বিবেক সম্পন্নদেরই অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সবাইকে বার বার ভেবে দেখতে হবে যে চেতনা দ্বারা তাড়িত হয়ে যাদেরকে নির্মূল করার জন্য পুরা জাতী ঐক্যবদ্ধ বলে প্রবল প্রচারণা চালানো হচ্ছে তাদের সাথে দেশের প্রধান বিরোধী দল বর্তমানে রাজনৈতিক কোয়ালিশনের দ্বারা আবদ্ধ। কাজেই আইনের বাইরে গিয়ে তাদেরকে নির্মূল করা এতোটা সহজ নয়। আর দেশের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করাটা গণতন্ত্র বিকাশের পথে সহায়ক কিছু নয়। আর নিষিদ্ধ করাও কোন স্থায়ী সমাধান নয়। তাই সব মিলিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে আমরা কি হানাহানির পথে পা বাড়াবো না ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসাথে নিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।

বিষয়: বিবিধ

১৪১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File