একুশের ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১০:৫৪:১৬ রাত
আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি হিসাবে এই দিনটি একদিকে যেমন আমাদের শোকের অপরদিকে তেমনি গর্বেরও। ১৯৫২ সালের এই দিনে আমরা হারিয়েছিলাম সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অনেক ভাষা সৈনিক কে যারা কিনা আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাকে মাতৃভাষা করার দাবিতে নিজেদের জীবনের চরম ত্যাগের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাদের জীবনের বিনিময়েই আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে। ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের সেই অর্জন শুধু আমাদের মাতৃভাষার প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং সেটাকে ছাপিয়ে পরবর্তিতে আমাদের মধ্যে স্বাধীন সত্বার এক নতুন স্বপ্নবীজ গ্রথিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের পথের সাহস ও প্রেরণাও যুগিয়েছিল ভাষা শহিদ্দের আত্মত্যাগের এই মহিমা। যারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের আলো বাতাসে বেঁচে আছি। হাসছি, কাঁদছি। এছাড়াও একুশ আজ আমাদের জন্য পরম গর্বেরও, এজন্য যে তাঁদের ত্যাগের ঐ মহাত্মকে আমরা আজ বিশ্বের নিপীড়িত হাজারো ভাষাভাষী মানুষের অনুভবের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। বিভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন রঙ এ। বছরের একটা দিনে অন্তত তারা হৃদয় দিয়ে বিশেষভাবে অনুভব করে নিজদের মাতৃভাষাকে। মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠত্বকে। এই ভাবনার মাঝে কেউ কেউ আমাদের মতোই খুঁজে পায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির পানে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে যাওয়ার শক্তি, সাহস ও প্রেরণা। তাই জাতি হিসাবে এই দিনটি আমাদের জন্য একটু আলাদা গুরুত্ব বহন করে।
প্রতি বছরই ঘুরে ফিরে একুশ আসে আমাদের মাঝে। সারা বিশ্ব বিভিন্ন আঙ্গিকে উদ্যাপন করে এই দিবসের তাৎপর্যকে তুলে ধরে। প্রাসঙ্গিকভাবেই সেখানে চলে আসে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বাংলাদেশের নাম। তারা কথা বলে আমাদের দেশ নিয়ে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে। আমাদের দেশের সেই সন্তানদেরকে নিয়েও যারা তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে উদ্ধার করে দিয়েছিল পাকিস্থান কর্তৃক ছিনতাই হয়ে যাওয়া আমাদের মুখের কথাকে। সারা বিশ্ব যেখানে এই দেশ, এই দেশের ভাষা, এই দেশের সন্তানদের ভাষা নিয়ে বীরত্বগাঁথার গুনর্কীতণ করছে সেখানে এই একুশের পটভূমিতে আমাদের বর্তমান ভাবনা, ভূমিকা, ক্রিয়া কর্মের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনার আলাদা তাৎপর্য বহন করে বৈকি! যে একুশ আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদেরকে মেলে ধরার-নিজের দেশকে, নিজের ভাষাকে, নিজের সংস্কৃতিকে- সেই সুযোগের কতটুকুকে কাজে রূপান্তরিত করতে পারছি এবং পেরেছি তা বিশ্লেষণ করার। সর্বোপরি যে ভাষার জন্য এদেশের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে, চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে জানান দিয়ে গেছে ভাষার অধিকারের যে মহাত্ম, আজ সময় এসেছে একটু ভেবে দেখার আসলে প্রাপ্তির বিচারে বাংলাভাষী জাতি হিসাবে আমরা কতটুকু পেরেছি তাদের ঋণের এই বোঝা পরিশোধ করতে।
ভাষার অধিকারের জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, অধিকার বঞ্চিতদের সংগ্রামের পথের প্রেরণা হয়েছি সত্য কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে এই ভাষাকে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু সমুন্নত, সমৃদ্ধ, এবং ব্যবহারের বিস্তার ঘটাতে পেরেছি সেটা একটু আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে ভেবে দেখা দরকার। দেশের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষাঙ্গনে বাংলা আজ আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। যে কয়েকটিতে আছে সেখানেও অত্যন্ত হতাশাজনক ভাবে উপেক্ষিত। বাংলা সেখানে অনেকটা পরিচর্চাহীন শয্যাশায়ী মুমূর্ষু রোগীর নিঃশব্দের অব্যক্ত উচ্চারণ। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির ছেলে মেয়েদের শিক্ষার মাধ্যমে, হিন্দি এবং ইংরেজির দাপটে প্রভাবিত এবং উগ্র আধুনিকতার ভড়ং-এ সজ্জিত তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশের মনিকোঠায় এ ভাষার গুরুত্ব হতাশাজনকভাবে মৃয়মান। শিল্প সাহিত্যের পুথির গণ্ডী পেরিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখায় এ ভাষার উপস্থিতি একেবারে প্রায় শুন্যের কোঠায়। বলা যায় এসব পরিমন্ডলে বাংলাকে আমরা অনেকটা অস্পৃশ্য করে রেখেছি। ধরা যাবেনা, ছোঁয়া যাবেনা টাইপের কিছু। সর্বোপরি বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক চেতনাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববাসীকে এর থেকে কিছুটা সুফল কুড়ানোর সুযোগ করে দিতে সক্ষম হলেও নিজেদের প্রেক্ষাপটে সমাজের সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রচলন ও প্রসারতার মাধ্যমে এ অর্জনকে এখনো সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারিনি। সরকারী বা বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এ ভাষার সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধনে এখন পর্যন্ত নিতে পারিনি স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী বড় ধরণের কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ।
রূঢ় বাস্তবতা হলো বিশ্বায়নের এই যুগে এবং নব্য আধুনিকতার স্পর্শে আমাদের জীবনযাত্রার মানের অনেক পরিবর্তন এসেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা এখন শিখরে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈল্পবিক পরিবর্তন। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের অকল্পনীয় প্রসারতায় একবিংশ শতাব্দির এই গ্রহবাসিরা এখন দুরুত্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোর মধ্যে। বিশ্বায়নের ঝাপটায় বিশ্ব এখন এই গ্রহের অধিবাসীদের মধ্যকার দেশ-জাতি, ধর্ম-বর্ণ, ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার সীমানা ছাপিয়ে একটা বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়ে গেছে। অধিবাসীদের টিকে থাকার জন্য ও নিজ নিজ স্বকীয়তা রক্ষার জন্য যে গ্রামের পরতে পরতে রয়েছে তুমুল প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে কোন কোন জাতির নিজস্ব সত্তা, স্বকীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি। কখনো বা আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে প্রতিযোগিতার দৌড়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা কোন জাতি বা তাদের সংস্কৃতি দ্বারা। কেউ চাইলেও এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই। আর জাতি হিসাবে আমরাও এই স্বকীয়তার লড়াইয়ের সীমানা বহির্ভূত নই।
তাই এমতাবস্থায় টিকে থাকতে হলে সর্বাগ্রে দরকার একটা ঐক্যবদ্ধ জাতির। যে জাতির শিক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতি হবে সমৃদ্ধ, রুচিশীল ও কল্যাণময়। সৃজনশীলতা হবে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। গতিশীলতা হবে অভাবনীয়। আদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি উন্নয়নে থাকবেনা পরমুখাপেক্ষিতা। নেতৃত্ব হবে সাবলীল। ভালো কিছু গ্রহণে সকলে হবে উদার, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে থাকবে সজাগ আর রক্ষায় হবে কঠোর। তাহলেই সম্ভব জাতি হিসাবে নিজেদের স্বকীয়তা রক্ষার, সমৃদ্ধ ভাষা আর সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ একটা আদর্শ দেশ গঠনের। আর এটাই হোক আজকের মহান একুশের অঙ্গীকার। এই মুলমন্ত্রকে ধারণ করে উন্নত সমাজ গঠনের নিমিত্তে কাজে ঝাপিয়ে পড়ি আমরা সকলে। সম্পূর্ণ করি ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহিদদের মহান আত্মত্যাগের লক্ষ্য ও উদ্দেশের অসম্পাদিত কাজগুলো।
বিষয়: বিবিধ
১২৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন