বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। তাহলে চাকরী পেতে আমাকে কেন মেধাবীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে!
লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ১৩ জুলাই, ২০১৩, ১২:৫৮:৫৪ রাত
বিসিএস এ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ত্রিশ পার্সেন্ট! ভাবছেন এটা বুঝি সদ্য স্বাধীন হওয়া কোন দেশের হাত হারানো, পা হারানো বা সম্ভ্রম হারানো মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ পুনর্গঠনে অংশগ্রহনের ভিআইপি টিকিট! হয়তোবা যুক্তি খুঁজছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতিকে যারা মুক্ত করেছে তাদের জন্য মাত্র ত্রিশ পার্সেন্ট! তারা দেশ স্বাধীন না করলে তো পাকিস্থা্নিদের বৈষম্যের যাতাকলে পড়ে সবাই বঞ্চিতদের দলে পড়ে থাকতাম। তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ত্রিশ পার্সেন্ট নয় সত্তর পার্সেন্ট করা উচিৎ।
আপনার ভাবনাতে অস্বাভাবিকতা ছিলনা যদিনা দেশ স্বাধীনের পর এতটা বছর পেরিয়ে না যেত। অথবা আপনি যদিনা ১৬ই ডিসেম্বরের পাকিস্থানের হানাদার বাহিনীর দলে দলে আত্মসমর্পণ করতে দেখে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে যেতেন। আর রিপভ্যান উইঙ্কিল স্টাইলের একটা দীর্ঘ নিদ্রা শেষ করে এই ভাবনাটা ভাবতেন। কিন্তু স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পার হওয়ার পরও এখন যদি কেউ দাবী করে “বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, তাহলে চাকরী পেতে আমাকে কেন মেধাবীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে” তখন নিজের কাছে এটা মামার বাড়ীর আবদার বলেই মনে হবে।
হ্যাঁ কোটার কথায় বলছি। সময় অনেক গড়িয়েছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম আজ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতার সেই সুফল প্রকৃতভাবে অর্জন করতে পারিনি। যেটা পেরেছি সেটা হলো ঘৃণ্য রাজনৈতিক পরিচর্যার মাধ্যমে দেশকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে দিতে। জাতির মধ্যে বিভক্তি তৈরী করতে। একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি অন্যদিকে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে কুন্ঠিত হইনাই। একদিকে জাতির একটা অংশকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও অপর অংশকে বিপক্ষের শক্তি ট্যাগ দিয়ে পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে। যখন যারাই ক্ষমতায় এসেছি সর্বান্তকরণে চেষ্টা চালিয়েছি এই ব্যাবসার প্রসার ঘটাতে। ফলশ্রুতিতে সফলও হয়েছি বটে। তাইতো স্বাধীনতার এতদিন পরও দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। আগে অতটা না থাকলেও এখন ডাইনে তাকাইলে মুক্তি যোদ্ধা, বাইয়ে তাকাইলে মুক্তিযোদ্ধা। ভাবখানা এমন এই বিয়াল্লিশ বছরে একজন মুক্তিযোদ্ধাও মারা যায়নি। বরং প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা স্বাভাবিক মৃত্যুকে জয় করে অমরত্বের সাথে সাথে নিজেদের ক্লোন তৈরী করে চলছে। তাই চারিদেকে শুধু মুক্তি যোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধা। আর যেখানেই মুক্তিযোদ্ধা দেখা যায়না সেখানেই যেন রাজাকার আর স্বাধীনতা বিরোধী। এমতাবস্থাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা এখনো বহাল রাখার যৌক্তিকতা খোজার মধ্যে যথেষ্ট অস্বাভাবিকতার গন্ধ পাওয়া স্বাভাবিক।
আসলে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আর অবৈধ সুবিধা চরিতার্থ করতেই দেশে মুক্তিযোদ্ধা বুম করেছে। কিন্তু ভাগ্য ফেরেনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। তাইতো এখনো পত্রিকায় ক্যাপশন সহ ছবি আসে অমুক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কারো বা থাকার জন্য ঘর নেই, জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্ম নেই। অপরদিকে তথাকথিত সার্টিফিকেট ধারী নব্য মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের দোহায় দিয়ে তিন পুরুষের আয়েশি জীবন নিশ্চিত করে চলেছে।
হ্যাঁ যে জাতি তাদের বীর সন্তানদের সম্মান করতে জানেনা তারা তো স্বাধীনতার মর্ম বোঝেনা। তাই জাতি হিসাবে আমরা যখনই স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে শুরু করেছি তখন থেকেই আমাদের উপর ঋণের বিশাল বোঁঝা চেপে গেছে। এই ঋণ খুব সহজেই পরিশোধিত নয়। যে স্বাধীন দেশের আলো বাতাস খেয়ে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠছে ভুলে গেলে চলবেনা সেই স্বাধীনতার পেছনে এদেশের সন্তানদের ত্যাগের মহিমা। তাইতো দেশ তাদেরকে দিবে সর্বোচ্চ সম্মান। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাবে সর্বোচ্চ ও সর্বাগ্রে। মুক্তিযুদ্ধের পর বেঁচে থাকা জাতির বীর সন্তানদের ঋণ পরিশোধের এটাই হওয়া উচিত একমাত্র পন্থা।
কিন্তু জাতি হিসাবে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পরেও আমাদের সেই সব জীবিত বীর সন্তানদের চিহ্নিত করতে পারিনি। তৈরী করতে পারিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাংগ তালিকা। আর এরই সুযোগ নিয়েছে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো। যুগে যুগে যখন যারাই ক্ষমতাই এসেছে তখন তারা তাদের পছন্দমত লোকদেরকে এই তালিকাভুক্ত করেছে। কালক্রমে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে নিজেদের পছন্দমত লোক দিয়ে এই তালিকা বর্ধিতকরণে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রকৃত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর তাদের এই সুবিধাগুলো লুফে নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশেষ প্রেস থেকে বেরিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ধারীরা।
কোটা শব্দটা শুনলেই যে বিষয়টা সর্বাগ্রে মাথায় আসে সেটা হলো সমাজের সুবিধা বঞ্চিত, নাজুক, অসহায় কিছু পিছিয়ে পড়াদের কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে সামনের দিকে টেনে তুলার একটা বিশেষ পদ্ধতি। একটা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের সুমহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই যেটা সাধারণত রচিত হয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে তাদেরকে একটু সুবিধা দেওয়া। তারা যাতে প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সমাজের সম্পদে পরিণত হতে পারে। একসময় নারীরা বিভিন্ন ভাবে সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার হতো এবং এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে। তাই বৈষম্যের স্বীকার এই নারীদেরকে সমাজ গঠনে পুরুষের সমান্তরালে আনার প্রয়াসে তাদেরকেও এই কোটার আওতায় আনা হয়।
কোটা প্রনয়নের আসল উদ্দেশ্য যত মহানই হোক বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা নিঃসন্দেহে তার আসল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এটা এখন যেন একটা বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই বৈষম্য পূর্বে বিদ্যমান কোটামুক্ত সমাজের বৈষম্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আগে প্রতিবন্ধি বা দরিদ্র্য নারীরা সমাজ গঠনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন থেকে বঞ্চিত হত আর এখন বঞ্চিত হচ্ছে সৎ, কর্মঠ, দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি। কোটার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অযোগ্য ও অমেধাবীদের কাধে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব। তাই প্রতিবন্ধি ছাড়া অবিলম্বে সকল প্রকার কোটা প্রথার রহিত করা প্রয়োজন। কোটার পরিবর্তে সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্ট করতে হবে যেখানে প্রতিযোগিতায় কাউকে সুবিধা দিয়ে নয় বরং অংশ গ্রহনের সুযোগ সকলের জন্য সমান করে ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
২৫১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন