নারীর সোন্দর্যের একাল সেকাল- রহস্যময়ী নারী, ছলনাময়ী নারী, আর পণ্যরূপী নারী

লিখেছেন লিখেছেন রোজবাড ০৩ জুন, ২০১৩, ০৪:১২:১২ বিকাল



তারুন্যের দ্বীপ্ত শিখায় প্রজ্জ্বলিত অপরুপ চেহারার মেয়েটি। শরীরের গঠন, হাটার ভংগী, চোখের চাহনী আর কথা বলার সময় মুখের অভিব্যক্তি সব ক্ষেত্রেই যেনো সুন্দরের স্বৈর্গিক স্ফুরন। অবচেতন মনে যার দিকে একবার চক্ষু বুলিয়ে গেলেই ফিরে পায় চেতনার প্রাণ। চক্ষুলজ্জা উপেক্ষা করেও ইচ্ছা হয় বার বার তাকাতে। মুহুর্তেই কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়াতে থাকে রঙ্গিন ফানুস। কোন কারণ ছাড়াই হৃদয় মনে খেলে যায় আচমকা এক আনন্দের হিল্লোল। এ যেনো দক্ষিণা বাতাসের ঝাপটায় সবুজের বুকে একে দেওয়া ঢেউ খেলানো অল্পনা।

না এই কয়েকটি বাক্য দিয়ে বোঝানো যাবেনা নারীর সোন্দর্যে পুরুষের দুর্ণিবার আকর্ষণের প্রকৃত মাত্রাকে। যেটা সম্ভব করতে পারেনি পৃথিবীর বাঘা বাঘা সব রোমান্টিক কবি সাহিত্যিকরা। সিনেমা, নাটক বা মিউজিক ও কি পেরেছে পুরুষের চোখে ধৃত নারীর বিমূর্ত সোন্দর্যের রহস্যের উন্মোচন করতে? সম্ভবত না। আর এ জন্যই হয়তো এধরণের উপন্যাস, নাটক, সিনেমার আবেদন রয়েই গেছে ঠিক আগের মতোই। কমেনি এতটুকুও। ভালোলাগা অনুভবের অতৃপ্ত রাজ্যে ভালোবাসা রহস্যের নতুন নতুন আবৃত অংশের স্বাদ নিতে কে না চাই।

যুগে যুগে নারীর ভালোলাগা ও ভালোবাসার মায়াবী জালে আটকা পড়ে কেউবা হয়েছে আত্মহারা আবার কেউবা দিশাহারা। ভালোবাসার পূর্নতা দিতে শাহজাহান গড়েছেন তাজমহল। অন্যদিকে একই প্রয়াসে খেই হারিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন নারীর অন্তরের রহস্য নাকি বিধাতারও অজানা। ভালোবাসার ঘূর্ণিপাকে আশা নিরাশার স্বরূপ যুগে যুগে অমর রাখতে সৃষ্টি হয়েছে লাইলী-মজনু, শিরী-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট আর দেবদাসের মতো উপাখ্যান। ভালোবাসার টানে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড এর সিংহাসন ছেড়ে দেওয়া আর গ্রীক মিথোলজিতে হেলেনের জন্য বিখ্যাত ট্রয় ধ্বংস করে ফেলার কাহীনি আমরা কে না জানি।

তারপরও নারীর সোন্দর্য পুরুষের অনুভবের রাজ্যে আকর্ষণের যে টর্ণেডো সৃষ্টি করে তার গতিবেগ আমরা কী পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিমাপ করতে পেরেছি? না বললে কমপক্ষে অশুদ্ধ হবেনা। আর পারবোই বা কী করে! যুগে যুগে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তো সেইরকম কোন মাপযন্ত্র রেখে যাননি। যা দিয়ে গেছেন তা হলো পাতার পর পাতা গল্প উপন্যাস আর ইতিহাসের অমর প্রেম কাহীনি। হাল আমলের বিবেচনায় এগুলো তো ভালোবাসা পরিমাপের মরিচা পড়া সব অ্যানলগ যন্ত্রপাতি। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে এগুলো বড়জোর অনুভূতিতে একটা নস্ট্রালজিয়া ভাব জাগাতে পারে বৈকী।

সময়ের বিবর্তনে আমরা এখন ডিজিটাল দুনিয়ার বাসিন্দা। অবসরের ভিতরে কিম্বা বাইরে এখন আমাদের বেশীরভাগ সময় কাটে ভার্চুয়াল জগতে। তাবৎ পৃথিবীর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতিনিয়ত যে রাজ্যের অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে। তাই এই দুনিয়ার আলো বাতাসে বেড়ে উঠা প্রজন্মের আবেগ অনুভূতিতে বিবর্তনের ডিজিটাল ছাপ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। আর দৈনন্দিন বাস্তবতা স্পষ্টতই সেই অস্বাভাবিকতাকে উড়িয়ে দিয়েছে। ফিজিক্সের ভাষায় অনেকটা মুক্তি বেগে।

প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য ছোঁয়া আমাদের চিন্তা চেতনা, চলা ফেরা, রুচি অভিরুচিতে এবং ভালোলাগা ভালোবাসার অনুভূতিতে এনেছে বিস্তর পরিবর্তন। একদিকে গ্লোবালাইজেশনের কল্যানে আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা অপরদিকে ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারে ভার্চুয়াল দুনিয়ারও পর্যটক। ফলশ্রুতিতে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে আবেগ অনুভূতির প্রকাশের বিচিত্র মাধ্যমগুলো এখন ক্রমান্বয়ে বৈচিত্র হারিয়ে একীভূত হয়ে পড়ছে। অনুকরণ আর অনুসরণের বাঁধভাংগা জোয়ারের প্লাবনে সিক্ত হৃদয়ে আজ স্থান নিচ্ছে জগাখিঁচুড়ী মার্কা বৈচিত্রহীন নীরস অনুভূতি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সেই অনুভূতির মাত্রা জিএম ফুডের আকার আয়তনের মতো হলেও স্বাদ ও স্বার বস্তুতে নির্ভেজাল প্রকৃতির সন্ধান মেলা ভার।

কিন্তু ডিজিটাল প্রজন্ম এটা মানতে নারাজ। কেননা তাদের অনুভূতিতে নারীর চিরাচরিত পবিত্র সোন্দর্যের জায়গায় এনেছে ডিজিটাল পরিবর্তন। স্বাদ ও রুচির অ্যানালগ চরিত্র পরিবর্তনের অভিপ্রায়ে নারীকে আজ তারা ব্যাবহার করেছে বৈচিত্রময় সব উপায়ে। যেখান থেকে একটা তুলনামুলক বিশ্লেষনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রতি ভালোবাসার ধরণ ও মাত্রা। কর্পোরেট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গুলো এই জায়াগাটিই দখল করে নিয়েছে। তাদের বিজনেসে ব্যাবহৃত বিজ্ঞাপনগুলো নিরন্তর দেখিয়ে দিচ্ছে ভালোলাগা কীভাবে পরিমাপ করতে হয়। একেবারে কাটায় কাটায়। ঠিক যেনো অনুভূতি প্রকাশের ডিজিটাল থার্মোমিটার। পণ্যের চাহিদার পারদে তৈরী এ থার্মোমিটারের একটা বিশেষত্ব হল তাপমাত্রা নয়, নারীর সোন্দর্যের প্রভাব যেখানে পারদের উঠানামা নির্দেশ করে। দামী ব্রান্ডের ক্ষেত্রে আবার এই পারদের উঠানামা যেনো নারী দেহের অনাবৃত অংশের সমানুপাতিক। গণিতের এই সহজ নিয়মটি যারা বুঝে তাদের কাছে গাড়ী, ঘড়ি বা মোবাইলের বিজ্ঞাপনে লাস্যময়ী ললনাদের নগ্ন উপস্থিতিতে মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়না। খুব সহজেই এসব পণ্যের ক্রয়মূল্য থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিসটার মূল্য হিসাব করে ফেলা যায় আরকি। শুধু তাই নয় আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো এসব নারীদের মূল্যবান সোন্দর্যকে বিকিয়ে মূল্যহীন তলানী হওয়ার আগ্রহ দেখে নতুন করে বলতো নারীর রহস্যের অন্তর্ভেদ পণ্য বিক্রয়ের অব্যাবহতি পরেই।

[বিঃ দ্রঃ বাসায় বাচ্চারা এখন তাদের মায়ের অভাব অনুভব করেনা। বরং মায়ের থেকে দূরেই থাকে। কারণ তারা এখন অ্যালপেনলিবে’র জাস্ট জেলি খায়। স্ত্রীর ভালোবাসার দরজা এখন শুধু আমার জন্যই উন্মুক্ত নেই। তার মনের রাজ্যে এখন অনেকেরই আনাগোনা এবং বেশ নির্ভয়েই সে তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। বাসর রাতে তখন বুঝিনাই কীভাবে সে এটম খেয়ে মুহূর্তেই হাতে অঙ্কিত অমুককে আমাকে বানিয়ে ফেলল! তবে এখন ভালোভাবেই বুঝি। কারণ সে এখন নিয়মিতই এটম খায়। তয় বুঝতেই পারছেন বিজ্ঞাপনের কল্যানে বউ, বাচ্চা নিয়ে বেশ সুখেই দিনাতিপাত করছি!- ফ্যান]

বিষয়: বিবিধ

৩৩৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File