দেখছি সম্ভাবনাঃ প্রয়োজন ‘মতানৈক্য সহ ঐক্য’ বজায় রাখা
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:০০:০০ রাত
মানুষে মানুষে মতবিরোধ থাকবেই। এটা অতি স্বাভাবিক। সৃষ্টির শুরু থেকেই এটা চলে আসছে। পৃথিবীর বুকে মানুষের শ্রেষ্ঠ জামায়াত ছিল সাহাবায়ে কেরামগন। আর তাঁদের মধ্যেও মতানৈক্য ছিল। সুতরাং সবাই একই মতের অনুসারী হবে এটা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব না।
কিন্তু মহান আল্লাহ আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার নির্দেষ দিয়েছেন।
“তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না” (সূরা আল ইমরান- ১০৩)
তাহলে কিভাবে হবে সে ঐক্য? যেখানে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মতের! আলেম ওলামাগন এ ঐক্যের একটি নতুন নাম দিয়েছেন-“আল-ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ” অর্থাৎ ‘মতানৈক্য সহ ঐক্য’।
আমাদের দেশে ‘মতানৈক্য সহ ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেসব আলেম ওলামা কাজ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী কায়েদ সাহেব হুজুর (রহঃ) অন্যতম। এ ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর ভ্রমণ করেছেন। জামায়াতে ইসলামী, তাবলীগ, চরমোনাই, জৈনপুরী, ফুরফুরা প্রভৃতি বিভিন্ন দল ও সংগঠনকে তিনি যেসব বিষয় নিজেদের মধ্যে এক, সেসব বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একত্রে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যেখানেই এ ধরনের ঐক্য সাধিত হয়েছে সেখানে আল্লাহ বিজয় দিয়েছেন। ১৯৫১ সালে করাচীতে শিয়া সুন্নী নির্বিশেষে সর্বদলীয় উলামা ও মাশায়েখ সন্মেলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বলেই পাকিস্থানের ২২ দফা মূলনীতি রচনা করা সম্ভব হয়েছিল।
এ ধরনের ঐক্যের ফলেই ভারত সরকার মুসলিম পারিবারিক আইন পরিবর্তন করতে পারে নি। যখনই ভারত সরকার মুসলিম পারিবারিক আইনে হস্তক্ষেপ করতে চাইলো, তখনই বিশ্ববিখ্যাত আলেম আল্লামা আবুল হাসান আলী আন-নাদভীর (রহঃ) নেতৃত্বে সব ইসলামিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করে এ অবৈধ হস্তক্ষেপ।
কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য, মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে মুসলমানরা ঐক্যের শক্তিতে যা অর্জন করতে পেরেছে, শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ মুসলমানের যে দেশে বসবাস, সে দেশে আমাদের অনৈক্যের কারনে মুসলিম পারিবারিক আইনেও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় আইন পাশ করা হয়েছে ফতোয়ার বিরুদ্ধে। ইসলামী পোষাকের বিরুদ্ধেও করা হয়েছে আইন। পাঠ্য বইতে আল্লাহকে দেব দেবীর সমান্তরালে বিবেচনা করা হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহর সন্তানের (নাউযুবিল্লাহ) কথা বলে শিরকী শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্রদেরকেও।
এসবের বিরুদ্ধে আমরা যে আন্দোলন করছি না তা নয়! আমরা কিন্তু আন্দোলনও করে যাচ্ছি। তবে আলাদা আলাদাভাবে। জামায়াত, চরমোনাই প্রভৃতি বিভিন্ন সংগঠন এসবের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথকভাবে আন্দোলন করেছে। মিছিল করেছে। সমাবেশ করেছে।
[ইসলামের নামধারী উলামায়ে ছু চক্রের কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে; নানান রকম খোঁড়া যুক্তি বলে তারা এগুলোকে জায়েয প্রমান করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে এখানে আলোচনা করতে চাই না।]
পৃথক পৃথক ভাবে আন্দোলন না করে যদি তারা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তো, তাহলে হয়তো ইসলাম বিরোধী কোন আইন প্রনয়ন করা প্রায় ৯৫ভাগ মুসলিম দেশে সম্ভব হতো না।
স্মরণকালে ইরান, মিশর, তিউনেশিয়ায় যে ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয়েছে তার মূলেও ছিল ইসলাম পন্থীদের মাঝে ঐক্য।
ইসলাম পন্থী সবাই সব দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তাদের কেউ হয়তো ছিল হানাফী, কেউ শাফেই, কেউ মালেকী, কেউ হাম্বলী, আবার কেউবা শিয়া। এতসব অনৈক্যের পরেও ইসলামকে বিজয়ী করার বিষয়ে তাদের মাঝে ঐক্য ছিল। তাই শত অনৈক্য মনের মাঝে লুকিয়ে রেখে যে বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ সে বিষয়ে একত্রে কাজ করেছে। আর আল্লাহও তাদের বিজয় দিয়েছেন।
পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফের আমলে সরকার বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী আইন প্রনয়নের চেষ্টা করলে বিভিন্ন ইসলামী গ্রুফ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিরোধ করে।
আমার নিজ জেলা চাঁদপুরে একবার মহিলা সাঁতার প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছিল। এবং এতে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযোগীরাও চাঁদপুর এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু চাঁদপুরের সর্বদলীয় ওলামায়ে কেরাম নিজেদের মধ্যাকার সকল বিভেদ ভুলে গড়ে তুলেছিলেন চরম আন্দোলন। তাঁদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে সকল প্রস্তুতি শেষ করার পরও অবশেষে এ নির্লজ্জ কাজটি সম্পন্ন করতে পারে নি আয়োজকরা(আলহামদুলিল্লাহ)। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গাছতলার পীর সাহেব খাজা ওয়ালিউল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বে সমবেত হয়েছিল জামায়াত, চরমোনাই, জৈনপুরী প্রভৃতি বিভিন্ন দল ও সংগঠন। নিজেদের মধ্যকার অনেক মতানৈক্য থাকলেও যে বিষয়ে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ সে বিষয়ে তাঁরা এক হয়ে কাজ করেছিলেন আর মহান আল্লাহও তাঁদের বিজয় দিয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে মুসলমানরা চরমভাবে নির্জাতিত। মাথায় টুপি আর মুখে দাঁড়ি দেখে গ্রেফতার করা হয়েছে আমাদের অনেক নিরপরাধ ভাইকে। অথচ ডিজুচ টাইপের পোষাক পরিহিতরা আছে জামাই আদরে। স্কুল কলেজে ইসলামিক শালীন পোষাক পরিধান করে হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে আমাদের অনেক বোনকে। অথচ যৌন উত্তেজনাকর পোষাক যারা পরছে তাদের বিরুদ্ধে কারো কোন বক্তব্য নেই। মসজিদে যেতেও ভয় পায় আজ অনেকে। কারন কে জানি কখন সন্দেহ ভাজন হতে হয়!!! ইসলাম, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে অবমাননাকর কথাবার্তা যারা বলছে তাদের জামাই আদর করা হচ্ছে, তাদের কেউ নিহত হলে তাকে শহীদ উপাধিতে ভূষিত করা হয় আর তাদের এসব ইসলামী বিদ্বেষী কর্মকান্ডের কথা প্রচার করায় নির্ভীক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের প্রতি বিষোদাগার করা হচ্ছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে আমাদের অনৈক্যের কারনে। আমাদের অনৈক্যের কারনে ইসলামী ফাউণ্ডেশন, জাতীয় মসজিদ, দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ প্রভৃতির দায়িত্বও দেয়া হয়েছে উলামায়ে ছু চক্রের সদস্যদের।
এসবের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হলেও সব আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতে পায় নি। কারন বিভিন্ন সংগঠন পৃথক পৃথকভাবে একই দাবীতে আন্দোলন করেছে। যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করতেন। ইতিহাস থেকে আমরা এ শিক্ষাই পাই।
তবে এখন আমাদের সামনে নতুন এক স্বপ্ন। আমরা দেখছি নতুন এক সম্ভাবনা। কারন আমাদের আলেম উলামারা আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মুফতী আহমদ শফীর নেতৃত্বে আজ মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ। বিভিন্ন মতের সংগঠন প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে এ আন্দোলনকে। যেসব বিষয়ে তাদের মাঝে ঐক্য রয়েছে, সেসব বিষয়ে আজ তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে চায়। আর এ ফলে ইতিমধ্যেই ভীতি সৃষ্টি হয়েছে জালিমদের মনে। উলামায়ে ছু চক্রের কিছু লোককে দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির। এতেও সফল না হয়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে তাদের আন্দোলনকে দমাতে। আগামী ৬ তারিখের লং মার্চ যেন না হয় সে জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটিই মনে হয় তারা বাদ দিচ্ছে না। কিন্তু আমীরুল মু’মিনীন মুফতী আহমদ শফীর নেতৃত্বে মুসলমানদের মধ্যে যে মতানৈক্য সহ ঐক্য স্থাপিত হয়েছে সে ঐক্যে তারা এখনো ফাটল ধরাতে পারে নি। এ ঐক্য বজায় থাকলে জালিমের পতন ও ইসলামের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ইরানে যেমন ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং ইসলামের বিজয় সাধিত হয়েছে সে অবস্থা ইনশাআল্লাহ আমাদের দেশেও হওয়া সম্ভব। ইমাম খোমেনীর যেমন তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল আম জনতার মধ্যে তেমন জনপ্রিয়তা আছে আহমদ শফীরও। মুসলমানদের মধ্যে যদি এ মতানৈক্য সহ ঐক্য বর্তমান থাকে তাহলে ইসলামী বিপ্লব আর বেশি দূরে নয়।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন