প্রসঙ্গঃ সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে থেমিস মূর্তি
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ০২ মে, ২০১৭, ১১:৩৫:১৭ সকাল
সুপ্রিম কোর্ট এদেশের সর্বোচ্চ আদালত ভবন। এখান থেকে মানুষ ন্যায় বিচার আকাঙ্ক্ষা করবে, এটাই স্বাভাবিক। ন্যায় বিচারের জন্য প্রতীক স্বরূপ এর সামনে কোন ভাস্কর্য স্থাপন করাও অত্যন্ত যৌক্তিক। এ ভাস্কর্য একদিকে যেমন ন্যায় বিচারের প্রতীকি প্রকাশ হবে, তেমনি সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করবে। ১৯৪৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। তখন থেকে বিগত ৬৮ বছর ধরেই ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ছিল দাঁড়িপাল্লা। এই ৬৮ বছরে কেউ এর বিরূদ্ধে কোন প্রতিবাদও করেনি। এই নিয়ে কোন কথাও উঠেনি। কিন্তু হঠাত করে এখানে কেন বিতর্কিত গ্রীক বেদীর মূর্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো, সেটাই ভাববার বিষয়! অহেতুক শান্তিময় পরিবেশকে অশান্ত করে তোলাই কি এর উদ্দ্যেশ্যে!! কবে, কারা, কোথায়, কেন- এই মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তা আজও জাতির কাছে স্পষ্ট নয়।
যুক্তির নিরিখে সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রীক মূর্তি স্থাপন কিছুতেই শোভনীয় নয়। এদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে। এর মধ্যে কি গোটা দশেকও হবে যারা গ্রীক ধর্ম অনুসরন করে!!!!! তাহলে যে দেশে গ্রীক ধর্মাবলম্বী একজনও নাই, সেদেশে কোন যুক্তিতে গ্রীক দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
ন্যায়বিচারের জন্য প্রাচীন গ্রিকরা একজন দেবীর কল্পনা করেছিল। দেবীর নাম দিয়েছিল থেমিস।
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে ১২ জন টাইটান দেবদেবীর একজন ছিল থেমিস। অনুরূপভাবে খ্রিস্টীয় ১ম শতকে এসে রোমানরা ন্যায় বিচারের দেবীর নাম দেয় জাস্টিসিয়া। দেবী থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তিটি একজন নারীর। তার ডান হাতে আছে একটি তরবারি। বাম হাত আছে একটি দাঁড়ি পাল্লা। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় দাঁড়ি পাল্লাকে ন্যায়ের প্রতীকরূপে ব্যবহার করা হতো। মিশরীয় ধারণা থেকেই দাঁড়িপাল্লা গ্রিসে এসে দেবী থেমিসের হাতে ওঠে।
গ্রিক-রোমান দেবী থেমিস বা জাস্টিসিয়ার চোখ ছিল খোলা। কবে থেকে চোখ বাঁধার প্রথা চালু হলো তা সুনির্দিষ্ট নয়। তবে যতদূর জানা যায় যে ১৫৪৩ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্নেতে স্থাপিত লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য ছিল চোখ বাঁধা। ধারণা করা হয় যে, ১৫ শতকের শেষ দিক থেকে চোখ বাঁধা থেমিস বা জাস্টিসিয়ার মূর্তি নির্মিত হতে থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে যে দেশের ১% লোকও থেমিস দেবীকে ন্যায় বিচারের দেবী হিসেবে সম্মান করেনা, সেদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে তার মূর্তি কেন স্থাপন করা হলো!!!!
সুপ্রিম কোর্টের সাথেই জাতীয় ঈদগাহ। রাষ্ট্রপতি সহ জাতীয় গূরত্বপূর্ন ব্যক্তিবর্গ এখানে ঈদের স্বলাত আদায় করেন। নিয়ম অনুসারে যোগ্যতা থাকলে সরকার প্রধানই এখানে ঈদের খুতবা দেয়ার কথা।
ঈদের স্বলাতে মুসল্লিরা ডান দিকে সালাম ফিরালেই চোখে পড়বে এ মূর্তি। এটি ধর্মীয় কাজে বাধা দেয়ার শামিল। জাতীয় ঈদগাহ দেশের সম্পদ। এখানে যে ঈদের জামায়াত হয়, তা দেশের ঐতিহ্য। ঈদের খুৎবায় জাতীয় উদ্দ্যেশ্যে ভাষন দেয়া হয়। অথচ এই ঈদের মাঠের পাশেই মূর্তি স্থাপন ধর্মীয় কাজে বাধা দেয়ার শামিল। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তিতেও এ মূর্তি কিছুতেই এখানে শোভা পায়না।
ধর্মনিরপক্ষতায় যারা বিশ্বাসী, তারা এর ব্যাখ্যা করে- এর মানে হচ্ছে যে যার ধর্ম পালন করবে, কেউ তাকে বাধা দেবেনা। কিন্তু এখানে ধর্ম পালনে সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাও আবার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত জাতীয় ঈদের মাঠে গিয়ে ধর্ম কর্ম করার সময়ে।
হিন্দুরা তাদের মন্দিরে যতো মূর্তিই রাখুক, কোন মুসলিম তাতে বাধা দেবেনা। আর বাধা দেবার অধিকারও তার নাই।
কিন্তু যখনই আপনি এমন কোথাও মূর্তি স্থাপন করতে যাবেন, যা ধর্মপ্রান মুসলিমদের আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক, তখনই তারা এতে প্রতিবাদ জানাবে। এটাই স্বাভাবিক। এদেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলমান। এ মূর্তি স্থাপনে যে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা আসছে কোত্থেকে!!! যারা এ মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টাকাটা তাদের পকেটের!!!! এ টাকাটা এসেছে ট্যাক্স সহ সরকারের বিভিন্ন আয়ের উৎস থেকে, যা প্রদানকারীদের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলিম। মুসলিমদের কষ্টার্জিত অর্থের অংশ বিশেষ প্রদান করতে হয় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, যা দিয়ে রাষ্ট্র তার ব্যয় নির্বাহ করবে। আর সেই অর্থ দিয়ে গূরত্বপূর্ন জায়গায় অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টিকারী এমন কিছু নির্মান করবেন যা মুসলিমদের আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক, তা মানায় না।
পাচীন গ্রীকরা ন্যয়বিচারের প্রতীক হিসেবে যে দেবীর মূর্তি বানিয়েছিলো, তার পরনে শাড়ি ছিলোনা। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত এ মূর্তির মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীকদের ধর্মকেও অবজ্ঞা করা হয়। যারা সকল ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন দাবি করেন এবং বলেন সব ধর্মই কল্যানকর, তাদের অনুভূতিতে এ অবজ্ঞাটি আঘাত দেয়ার কথা, যদি তারা সত্যিই সব ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন।
বিতর্কিত মূর্তিটি যেভাবে স্থাপন করা হয়েছে, তাতে সুস্পষ্ট অশ্লীলতা ফুটে উঠেছে, যা ধর্ষন সহ বিভিন্ন অপরাধের উদ্দীপক।
যারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, তারাও দেখুন- এখানে পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক কাজ করা হয়েছে। দেশের ৯/১০ পার্সেন্ট মানুষ হয়তো মূর্তি পূজার সাথে জড়িত (তাও গ্রীক দেবীর মূর্তি নয়)। সুপ্রিম কোর্ট সবার জন্যই। ৯০% মানুষের বিশ্বাস পরিপন্থি মূর্তি নির্মান এক সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িকতা, যেখানে নির্যাতিত সংখ্যাগুরূরা।
১৯৪৬ সালে ইরানে এক স্বৈরশাসক এ ধরনের মূর্তি নির্মান করে। এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট কোন দেশেই আজ পর্যন্ত এ নজির দেখা যায়নি।
এ উপমহাদেশে এটিই হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে স্থাপিত প্রথম মূর্তি। ভারত, নেপালের মতো মূর্তি পূজক সংখ্যাগরিষ্ট দেশেও এ ধরনের কোন মূর্তি স্থাপন করা হয়নি। শ্রীলংকা ও মায়ানমারেও করা হয়নি। তাহলে কেন দাঁড়িপাল্লাকে বাদ দিয়ে এ মূর্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো!!!!!
দাঁড়িপাল্লার বিরূদ্ধেতো কেউই কোন ‘টু’ শব্দ করেনি। বড় আকারের ভাস্কর্য স্থাপন করতে চাইলে দাঁড়িপাল্লার একটি বিশাল ভাস্কর্য স্থাপন করা যেতো, যা কারো অনুভূতিতেই আঘাত করতোনা।
এদেশে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে এ মূর্তি সুস্পষ্ট গনতন্ত্র বিরোধী, কারন বেশিরভাগ মানুষই এ মূর্তি তো চায়ই না, বরং এর তীব্র বিরোধী। গূরত্বপূর্ন জায়গায়, সরকারী অর্থে ও ব্যবস্থাপনায় স্থাপিত কোন কিছু যদি গনতন্ত্রের বিরোধী হয়, তবে তা আফসোসের বিষয়। দেশের বেশিরভাগ জনগনের মতের তোয়াক্কা না করে এ মূর্তি স্থাপন গনতন্ত্রের বুকে ছুরি মারা।
অনতিবিলম্বে এ মূর্তি অপসারন করে এখানে অসাম্প্রদায়িক ও গনতান্ত্রিক কোন স্থাপনা নির্মান অতীব জরূরী, কারন বিশ্বাসের উপর আঘাত মানুষ সহ্য করেনা। আমরাও চাইনা, এ মূর্তিকে কেন্দ্র করে দেশে অশান্তকর কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। সেজন্যই এমন কোন স্থাপনা এখানে স্থাপন করা অতীব জরূরী, যা হবে অসাম্প্রদায়িক ও গনতান্ত্রিক; যাতে কারোই থাকবে না কোণ আপত্তি। দাঁড়ি পাল্লাই ছিলো এমন এক উৎকৃষ্ট প্রতীক। আর তাই বিগত ৬৮ বছর ধরে এ প্রতীকের বিরূদ্ধে কোন কথা উঠেনি। ভাস্কর্য যদি নির্মান করতেই হয়, তবে মূর্তিটি অপসারন করে এ স্থানে একটি বড় আকারের ও সুদৃশ্যমান দাঁড়িপাল্লার ভাস্কর্য নির্মান করা যেতে পারে, যা কারোই অনুভূতিতে আঘাত করবে না।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন