ড্রাগ পরিচিতি: লিনাগ্লিপটিন
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:১৮:৪০ দুপুর
আজ ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো একটি এন্টিডায়াবেটিক ড্রাগ নিয়ে।
এক সময় ডায়াবেটিস রোগের জন্য ব্যবহৃত হতো- রোসিগ্লিটাজোন ও পায়োগ্লিটাজোন। কিন্তু মারাত্মক পাশ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কারনে US-FDA (United States Food and Drug Administration) এ ড্রাগগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ হয় এগুলো। এরপর এন্টিডায়াবেটিক ড্রাগ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় গ্লিপটিনের।
Gliptin গ্রুফের যত ড্রাগ আছে সবগুলোই ইন্টিডায়াবেটিক। এগুলোর মধ্যে সাক্সাগ্লিপটিন বেশ জনপ্রিয় হতে থাকে, কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে এর দাম নিয়ে। সাক্সাগ্লিপটিনের API (Active Pharmaceutical ingredient)এর দাম খুবই চওড়া, যা আমাদের মত দেশের আমজনতার জন্য সুবিধাজনক নয়। তাই এক্ষেত্রে জনপ্রিয় হতে শুরু করে লিনাগ্লিপ্টিন। এর API (Active Pharmaceutical ingredient)’র দাম খুবই কম। এন্টিডায়াবেটিক ড্রাগ সাধারনত দীর্ঘদিন খেতে হয়। তাই লিনাগ্লিপ্টিনের কার্যকারিতা, সেফটি ও কম মূল্যের কারনে তা খুব দ্রূত গতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
মূল আলোচনায় যাবার আগে ডায়াবেটিস রোগটি কিভাবে হয় তা জেনে নেই।
চিত্রটি লক্ষ্য করূন-
বামপাশে আমাদের পাকস্থলী ও নাড়িভুড়ি (ইন্টেসটাইন) দেখানো হয়েছে। পাকস্থলীর নীচে চারপাশে মোটা করে যে ইন্টেসটাইন সেটাকে বলে লার্জ ইন্টেস্টাইন। আর ভেতরের পেঁছানোগুলোকে বলে স্মল ইন্টেসটাইন। আমরা যখন খাবার খাই, তখন সেগুলো পাকস্থলী থেকে ইন্টেসটাইনে আসে। ইন্টেসটাইনে যখন খাবারগুলো আসে, তখন এখানে থেকে বিভিন্ন Incretin Hormone নিঃসৃত হয়। এ হরমোনগুলোর আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। এখানে এতো গভীরে যাবার প্রয়োজন মনে করছি না।
এই হরমোনগুলো অগ্ন্যাশয়ে যায়। উপরের চিত্রে হালকা হলুদ রংয়ের পাতার মত যেটি দেখছেন সেটিই প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়। এ হরমোনগুলো এখানে এসে ইনসুলিনের নিঃসরন বাড়িয়ে দেয় এবং গ্লুকাগোনের নিঃসরন কমিয়ে দেয়। (এখানে ইনসুলিনের কাজ সম্পর্কে একটু বলে রাখি। এর মূল কাজ হচ্ছে ইনসুলিন গ্লুকোজকে আমাদের শরীরের কোষের ভেতরে প্রবেশ করায়। ইনসুলিনের পরিমান কমে গেলে গ্লুকোজ কোষের ভেতরে ঠিকভাবে প্রবেশ করতে পারবেনা। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যাবে) অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন এবং গ্লুকাগোন অনবরত নিঃসৃত হতেই থাকে। Incretin Hormone গুলো এসে ইনসুলিনের নিঃসরণটাকে বাড়ায় ও গ্লুকাগোনের নিঃসরণটাকে কমায়। তবে যাতে করে ইনসুলিন খুব বেশি নিঃসৃত না হয় এবং গ্লুকাগোনের নিঃসরন একেবারে কমে না যায়, সেজন্য আরেকটি এনজাইম এখানে কাজ করে, যাকে বলে DPP-4 (Dipeptidyl Peptidase-4) । এটি একটি চমৎকার কাজ করে। শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইনসুলিন যাতে তৈরী না হয় এবং গ্লুকাগোন যাতে এতো বেশি পরিমানে কমে না যায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতির কারন- সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রন করে এ DPP-4. এজন্য সে শরীরের প্রয়োজনের ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক Incretin Hormone কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ফলে শরীরের প্রয়োজন অনুসারে ইনসুলিন ও গ্লুকাগোন নিঃসৃত হতে থাকে।
আল্লাহামদুলিল্লাহ! আমাদের যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটিই ঘটে যাচ্ছে অনবরত। কিন্তু যদি কোন কারনে DPP-4 এর এক্টিভিটি বেড়ে যায় অর্থাৎ এটি হাইপারএক্টিভ হয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। তখন অধিক পরিমান গ্লুকাগোন নিঃসৃত হয় এবং ইনসুলিনের নিঃসরন তখন কমে যায়। এবার আসুন গ্লুকাগোন সম্পর্কে জেনে নেই।
গ্লুকাগোন গ্লাইকোজেনকে গ্লুকোজে পরিনত করে। এখন আবার প্রশ্ন আসতে পারে- গ্লাইকোজেন কি?? এটা হচ্ছে শর্করা জাতীয় খাবারের একটা স্টোর। এখানে শর্করা জাতীয় খাবারগুলো জমা থাকে। এগুলো থেকেই গ্লুকাগোন গ্লুকোজ উতপন্ন করে।
তাই যদি গ্লুকাগোনের পরিমান বেড়ে যায়, তবে একই সাথে পাল্লা দিয়ে গ্লুকোজের পরিমানও বেড়ে যাবে।
আর একেই আমরা বলি- ডায়াবেটিস।
আমরা দেখলাম ডায়াবেটিস রোগের কারন হচ্ছে DPP-4 এর এক্টিভিটি বেড়ে যাওয়া। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের জন্য আমাদের এ হাইপার এক্টিভ DPP-4 এর কিছু অংশকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। একাজটিই করে গ্লিপটিন গ্রুপের সকল ড্রাগ। এজন্য এ ড্রাগগুলোকে বলে DPP-4 inhibitor.
এতে করে DPP-4 এর হাইপারএক্টিভিটি কমে যায়। এবং ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রনে থাকে।
গ্লিপটিন গ্রুপের অনেকগুলো ড্রাগ রয়েছে। সবগুলোই মোটামুটি একই সিস্টেমে কাজ করে, যেমন-
Sitagliptin
Vildagliptin
Saxagliptin
Linagliptin
Anagliptin
Teneligliptin
Alogliptin
Trelagliptin
Gemigliptin
Dutogliptin
আজ ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো লিনাগ্লিপটিন নিয়ে।
অন্যান্য গ্লিপটিনের মধ্যে লিনাগ্লিপটিন সাধারনত অধিকতর নিরাপদ ও কার্যকরী বলে বিভিন্ন গবেষনায় প্রমানিত। আর এর দামও অনেক কম।
সাধারনত ডায়াবেটিস রোগের চিকিতসার সময় এরোগ ছাড়াও আরো বেশ কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হয়। কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিক একা আসেনা। এই রোগীর একই সাথে কিডনী, লিভার প্রভৃতিতে সমস্যাও দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, এই রোগীর ওজন অনেক সময়ই হয়ে থাকে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি। সেজন্য ডায়াবেটিস রোগীর জন্য যেকোন ঔষুধ নির্বাচনে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়।
লিনাগ্লিপটিন এসব সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।
আমি আরেকটু ক্লিয়ার করার ট্রাই করছি।
যেসব ড্রাগের মেটাবলিজম লিভারে হয়, সেসব ড্রাগ এমন রোগীদের দেয়া যাবেনা, যাদের লিভারে সমস্যা আছে। কিন্তু লিনাগ্লিপটিনের মেটাবলিজম লিভারে হয়না। তাই লিভার সমস্যায় আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এ ড্রাগ নিরাপদ।
যেসব ড্রাগ তার কাজ শেষ করে পস্রাবের মধ্য দিয়ে বের হয়ে যায়, সেসব ড্রাগ এমন রোগীদের দেয়া যায়না, যাদের কিডনীতে সমস্যা আছে। কারন কিডনীর সাহায্যেই পস্রাব তৈরী হয়। কিডনীতে সমস্যা থাকলে এ ড্রাগগুলো ব্যবহার করলে, সেগুলো তাদের কাজ শেষ করে শরীর ত্যাগ করতে পারবে না ঠিকমত, যা শরীরের জন্য হতে পারে মহা ক্ষতির কারন।
লিনাগ্লপিটিন তার কাজ শেষ করে শরীর থেকে যখন বের হয়ে যায়, তখন এর মাত্র ৫% পস্রাবের মধ্য দিয়ে বের হয়, যা অন্য গ্লিপটিনের চাইতে অনেক কম। নীচের ডায়াগ্রামে বিভিন্ন গ্লিপটিনের পস্রাবের মধ্য দিয়ে বের হবার অনুপাত দেখানো হয়েছে।
এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, যেসব ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনীতেও সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে লিনাগ্লিপটিন অন্যান্য গ্লিপটিনের চাইতে নিরাপদ।
সাধারনত শরীরের ওজনের উপর লিনাগ্লিপ্টিনের কোন ইফেক্ট নেই। তবে যদি এর সাথে আরেকটি ড্রাগ মেটফরমিন ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করবে।
আমরা হয়তো সবাই জানি ডায়াবেটিস যার একবার হয়, তার এটা আর সহজে ভালো হয়না। ঔষুধ প্রয়োগে নিয়ন্ত্রন করে রাখা যায়। অনেক ড্রাগই দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের পর তা নানান রকমের সাইড ইফেক্ট সৃষ্টি করে থাকে। আবার দির্ঘদিন ব্যবহারের পর হঠাত করে ব্যবহার বন্ধ করে দিলেও ঘটে নানান বিপত্তি। লিনাগ্লিপ্টিন এক্ষেত্রেও বেশ নিরাপদ।
বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগীদের আর একটা সাধারন প্রবলেম থাকে। পস্রাবের সংগে এলবিউমিনের উপস্থিতি। এলবিউমিন হচ্ছে একটা প্রোটিন। প্রস্রাবের সংগে এ প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়া রোগীর জন্য আরো অধিক ক্ষতিকর। লিনাগ্লিপটিন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের সাথে সাথে প্রস্রাবে এলবিউমিনের পরিমানও কমিয়ে দেয়।
রক্তের মধ্যে একটা উপাদান থাকে হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিনের কারনেই রক্ত লাল দেখায়। হিমোগ্লোবিন রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ করে। শরীরে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে গেলে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ এ হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়। একে বলে গ্লাইক্লেটেড হিমোগ্লোবিন। এর প্রভাবে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন প্রবাহে বাধাগ্রস্থ হয়। লিনাগ্লিপ্টিন এ গ্লাইক্লেটেড হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকেও কমিয়ে দেয়।
যেসব ডায়াবেটিক রোগীদের হার্টে সমস্যা, তাদের ক্ষেত্রে এ লিনাগ্লিপ্টিন অন্যান্য অনেক এন্টি ডায়াবেটিক ড্রাগের চেয়ে অধিকতর উপকারী।
৫ মিগ্রামের একটি ট্যাবলেট দিনে একবার খেলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে।
এ ড্রাগ সেবনের ফলে ছোটখাটো কিছু সাইড ইফেক্ট, যেমন- নাকের ভেতরে প্রদাহ, ডায়রিয়া, কাশি প্রভৃতি দেখা যেতে পারে।
তবে কার্যকারীতা এবং মূল্য থেকে শুরূ করে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে এটি একটি ভালো ও সবার জন্য উপযোগী এন্টিডায়াবেটিক ড্রাগ। আর সে কারনেই এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে খুব দ্রুত গতিতে।বাংলাদেশের অনেকগুলো কোম্পানি এ ড্রাগটি বাজারজাত করে আসছে। যেমন-
Linaglip- Aristopharma
Linax-Ibn Sina
Linatab-Incepta
Linita-Square
Lijenta-Nipro JMI
বিষয়: বিবিধ
৫৩৬৯ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ
ডাক্তার এর মতে এখনও আক্রান্ত না হলেও আমি ডায়াবেটিক এর ঝুঁকিতে আছি!! তাই উপকার হলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন