যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন, তাদেরকে বলছি- সত্য দ্বীনকে মিথ্যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ১০ মার্চ, ২০১৩, ০২:০৯:৫৬ রাত
যারা সমাজে ইসলাম কায়েম করতে চায়, যারা চায় দেশে কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, তাদের সকল কথা ও কাজ হতে হবে এমন, যা সন্দেহ মুক্ত। লোকেরা তাদের কথা বিশ্বাস করবে বিনা দ্বিধায়।
হ্যাঁ, পুরোপুরি ধোয়া তুলশি পাতা হওয়া হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব না, হয়তো আমলে কিছুটা ঘাটতি থাকতেও পারে, কারন বর্তমানে পৃথিবীতে যারা আছেন তাদের কেউই নবী-রাসূল না; সবাই সাধারন মানুষ। তাই একটু আধটু আমলে ঘাটতি থাকা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এজন্য মহান আল্লাহ তওবার দরজাও খোলা রেখেছেন।
কিন্তু এ ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে স্ব-জ্ঞানে, ঠান্ডা মাথায়, ফটোশপের সহযোগিতায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালান, তাহলে তা বড়ই দুঃখজনক।
সম্প্রতি ইসলামপন্থী কিছু ভাইয়েরা নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার জন্য এজাতীয় মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। আর ফটোশপের সহযোগীতায় নেয়া এসব মিথ্যা প্রকাশ হয়ে যাবার পর অনেকের কাছেই তাদের সত্য কথাও সন্দেহ যুক্ত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আমি আজ অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করেছি, কিভাবে ইসলামের নামকে সাথে যুক্ত করে আমাদের এক শ্রেনীর ভাইয়েরা বহু আগের ছবিকে ফটোশপের মাধ্যমে নাসিক্যবাদীদের কথা বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন। তারা হয়তো ভাবছেন এগুলোর মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ইসলামের পক্ষে মানুষকে টেনে আনতে। কিন্তু এটা কি স্টাইল! নবী রাসূল ও পীর আউলিয়াগন কি আমাদেরকে এ মিথ্যাচার শিক্ষা দিয়ে গেছেন! যদি না হয়, তাহলে আমরা কার অনুসরণ করে এ জাতীয় কাজে লিপ্ত হচ্ছি? নিশ্চয়ই শয়তানের। আর শয়তানের অনুসরনের মাধ্যমে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়, সে কত বড় বোকা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পবিত্র কুরআনের ঘোষনা- “তোমরা মিথ্যা দিয়ে সত্যকে পোষাক পরিয়ে দিয়ো না এবং সত্যকে জেনে বুঝে লুকিয়েও রেখো না” (সূরা বাকারা, আয়াত-৪২)।
হাদীসে এসেছে- ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে’।(বুখারী)।
সূরা আল ইমরানে আছে- “যে মিথ্যাবাদী হবে তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক”৷ (আয়াত-৬১)
তবে এমন কিছু বাস্তবতা আছে, যেখানে অসত্য বলার অনুমতি রয়েছে। যেমন যেসকল ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার ব্যাপারে কেউ অপারগ হয়ে পড়ে। মিথ্যা বলা ছাড়া তার অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। মিথ্যা না বললে নির্মম অত্যাচারের শিকার হতে হবে, যা সহ্য করা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় শরিয়ত অসত্যের আশ্রয় গ্রহণকে অনুমতি দিয়েছে। এখানে কথা হচ্ছে প্রথমত, সরাসরি অসত্য বলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে, বরং এমন ঘোর-প্যাচমূলক শব্দ বলতে হবে যাতে এ মুসিবত দূর হয়ে যায়। যাকে শরিয়তের পরিভাষায় তা'রীজ এবং তাওরিয়া বলা হয়। যার উদ্দেশ্য হল এমন শব্দ প্রয়োগ যাতে বাহ্যত শব্দটি অন্য অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ প্রশ্নকারীর দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরে যায়। আর বাস্তবে মনে মনে শব্দের মূল অর্থকেই চিত্রিত করে রাখতে হবে।
যেমন হিজরতের সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মদীনার পানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মক্কাবাসীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরে নিয়ে আসার জন্য সর্বত্র গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিল এবং এ ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরে এনে দিতে পারবে তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে। ফলে মক্কার প্রায় সকল মানুষই, এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এমতাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চেনে এমন এক লোকের সাথে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু ঐ ব্যক্তিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনত না। আগত ব্যক্তিটি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনার সাথী লোকটি কে? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু চাচ্ছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিচয় কেউ না পাক, শত্রুরা তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত না হোক। এমতাবস্থায় তিনি যদি সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিচয় দিয়ে দেন তবে মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর যদি পরিচয় না দেয়া হয় তাহলে অসত্য বলা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় থাকে না।
তাই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত কৌশলে বললেন, "তিনি আমার পথ প্রদর্শক, যিনি আমাকে পথ দেখান ।"
এখানে প্রশ্নকারী উত্তর শুনে ভাবল, সাধারণত ভ্রমনের সময় যেমন পথপ্রদর্শক থাকে ঐ লোকটিও তাই। কিন্তু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মনে মনে অর্থ করলেন যে তিনি আমায় দ্বীনের পথ দেখান, জান্নাতের এবং মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অর্জনের পথ দেখান।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, সরাসরি মিথ্যা বলা থেকে কিভাবে নিজেকে হিফাজত করা হয়েছে। এখানে এমন শব্দ বলা হয়েছে যাতে উপস্থিত সমস্যাও দূর হয়ে গেল এবং অসত্যও বলা হলো না। সার কথা এই যে, কেউ যদি ইচ্ছা করে যে সে অসত্য বলবে না তাহলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন।
সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। সত্যবাদী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
“আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকার করবে। তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে; যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নদী। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল”(সূরা আল মায়েদা : ১১৯)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো ‘জান্নাতের আমল কী’? উত্তরে তিনি বললেন,‘সত্যবাদিতা’ (আহমদ)।
পরিশেষে বলতে চাই, গোঁজামিল এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। বরং তা ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে নিয়ে যাবে আরো বহু দূরে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন, তাকওয়াবান কিছু জনশক্তি। কোন মিথ্যাবাদী দিয়ে তা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহর ঘোষনা-
“তোমরা হতাশ হয়োনা, চিন্তিত হয়োনা, তোমরা যদি মুমিন হও তাহলে তোমরাই বিজয়ী হবে” (আল- ইমরানঃ১৩৯)।
“মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব”।(সুরা রুমঃ৪৭)
“আল্লাহ মুমিনদের রক্ষা করেন”।(সুরা হাজঃ৩৮)
“আল্লাহ মুমিনদের সঙ্গে আছেন”।(সূরা আনফালঃ১৯)
“সম্মান ও মর্যাদাতো কেবল আল্লাহর আর তার রাসুল ও মুমিনদের” (সূরামুনাফিকুনঃ৮)
“আর আমি পূর্ববতী উপদেশের (তাওরাত) পর যবূর-কিতাবেও লিখে দিয়েছি যে, সৎকর্মপরায়ণ বান্দাগণই অবশেষে পৃথিবীর অধিকার ও কর্তৃত্ব লাভ করবে।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৫)
“আমার বান্দা ও রাসূলগণের ব্যাপারে আমার এ সিদ্ধান্ত অনেক আগে থেকেই হয়ে আছে যে তাদেরকে নিশ্চয়ই (আমার পক্ষ থেকে) সাহায্য করা হবে এবং আমার বাহিনীই (সর্বশেষে) বিজয়ী হবে।” (সূরা সাফফাত, আয়াত ১৭১-১৭৩)
“নিশ্চয়ই এই পৃথিবী আল্লাহর। তিনি তাঁর বান্দাদের মাঝে যাকে খুশি কর্তৃত্ব দান করেন, তবে চূড়ান্তভাবে মুত্তাকীগণই এর কর্তৃত্ব লাভ করবে।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ১২৮)
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সত্যবাদীদের দলভুক্ত করুন। কথায়-কাজে-আচরণে আমাদের সবাইকে সততার পরিচয় দেয়ার তাওফীক দান করুন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে সত্যাশ্রয়ী হয়ে জীবনযাপনের তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে মিথ্যা থেকে হিফাযত করুন। কপটতা ও মুনাফিকী থেকে হিফাযত করুন। আমীন ।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন