ক্যালসিয়ামের আদ্যোপান্তঃ সংক্ষিপ্ত বর্ননা
লিখেছেন লিখেছেন শরফুদ্দিন আহমদ লিংকন ১২ আগস্ট, ২০১৫, ০৪:৫০:৫৮ বিকাল
মহান আল্লাহ বলেন- (স্মরন করো) যখন তোমার মালিক ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি মাটি থেকে মানুষ বানাতে যাচ্ছি। (আল কুরআন ৩৮:৭১)
“----- এ মানুষদেরতো আমি আঠালো মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছি”। (আল-কুরআন ৩৭:১১)
“আমি মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি”। (আল কুরআন ২৩:১২)
মাটির অন্যতম একটা উপাদান- ক্যালসিয়াম। মাটি হতে সৃষ্টি হওয়ায় তাই মানুষের শরীরে বিভিন্ন উপাদাগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম অন্যতম। ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমান ১.৫%, যা প্রায় ১,১০০ গ্রাম।
ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে। পেশির সংকোচন ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ ঠিক রাখে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। হরমোন নিঃসরণ ও দেহের বিভিন্ন কোষের বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেহের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না এবং কোথাও কেটে বা ছিঁড়ে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। রাসায়নিক দূষণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া থেকে দেহকে বাঁচাতে ক্যালসিয়াম অন্যতম উপাদান। ঢাকার মতো যেসব শহরের বাতাসে প্রচুর সিসা ঘুরে বেড়ায়, সেসব শহরের মানুষের নিয়মিত ক্যালসিয়াম খাওয়া প্রয়োজন। ক্যালসিয়াম শরীরের জন্য এতটাই দরকারী যে- যদি স্বাভাবিকভাবে দেহের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম পাওয়া না যায়, তবে বাহির থেকে ঔষুধ আকারে হলেও তা দেহে দেয়ার প্রয়োজন হয়।
রজঃনিবৃত্ত মহিলা ও যারা হরমোন প্রতিস্থাপন বিশ্রামে আছেন তাদের প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়। গর্ভধারণ ও সন্তানকে স্তন্যদানের সময় প্রত্যেহ ১৫০০ থেকে ২০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়ানো প্রয়োজন।
দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিবে। স্বাভাবিকভাবে নিয়মিত সুষম খাদ্য খেলে শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা মিটে যায়। বাইরে থেকে ক্যালসিয়াম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বেড়ে উঠার সময় অর্থাৎ ১৫ বা ৩০ বছর পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়।
দেহের ভিতর ক্যালসিয়ামের মূল আবাস হলো হাড় ও দাঁত। রক্তেও কিছু পরিমান ক্যালসিয়াম থাকে। বাহিরের খাবার বা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট থেকে এ ক্যালসিয়াম প্রথমে ইসিএফ (Extra Cellular Fluid) এ যায়। এখানে থেকে তা হাড়ে গিয়ে নিজের জন্যে জায়গা করে নেয়। ইসিএফ- এ সর্বদা নির্দিষ্ট পরিমান ক্যালসিয়াম প্রেজেন্ট থাকতে হয়। এখানে ক্যালসিয়ামের পরিমান কমে গেলে ব্রেন তখন সিগন্যাল প্রদান করে এবং ক্যালসিয়ামের স্বল্পতার কথা জানায়। এ স্বল্পতা দূরীকরনার্থে তখন হাড় থেকে ক্যালসিয়াম আবার ইসিএফ এ ফিরে আসে। ফলে হাড়ে ক্যালসিয়ামের স্বল্পতা দেখা দেয়। এতে হাড়ে ক্ষয় শুরু হয়। হাড়ে ছিদ্র হয়ে যায়। হাড় দূর্বল হয়ে যায়।
কৈশরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করলে প্রাপ্ত বয়সে ক্যালসিয়ামের স্বল্পতা জনিত প্রবলেম খুব কম হয়। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম যৌথভাবে কাজ করে। তাই ক্যালসিয়াম বেশি গ্রহণ করলে ম্যাগনেশিয়ামের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই দুটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত সমস্যাগুলোয় সাধারণত মেয়েরাই বেশি ভোগে। বয়স একটু বেড়ে গেলে যখন শারীরবৃত্তীয় কিছু পরিবর্তন হয়, তাদের তখন ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়। ফলে হাড়ে ছিদ্র হয়। ধীরে ধীরে হাড় দূর্বল থেকে দূর্বল হয়ে যায়। দূর্বল হাড় একটু আঘাতেই ভেঙ্গে যায়। আর বয়স বাড়লে ভাঙা হাড় জোড়া লাগাটাও খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। আর গর্ভাবস্থায় এর চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুনে। এ সময় মা পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম না পেলে তাঁর সন্তানের হাড় ও দাঁতের গঠন সঠিকভাবে হয় না। তাই মহিলাদের ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া খুবই প্রয়োজনীয়।
ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন দুধ, মিল্ক প্রডাক্টস, সবুজ শাকসবজি নিয়মিত খেলে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরন হয় অনেকাংশে। পালংশাক, ধনেপাতা, মেথি, মুলাশাক ইত্যাদি সালাদ হিসাবে খাওয়া যেতে পারে। সালাদের সঙ্গে তিল মিশিয়ে খেলে আরো বেশি উপকার পাওয়া যায় এবং খেতেও ভালো লাগে। খাওয়ার পর ডেজার্ট হিসাবে ডুমুর বা কমলালেবু উপকারী। গ্রিন টি, আদা, হলুদ ইত্যাদিও ক্যালসিয়ামের উৎস হিসাবে ভালো।
ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার শরীরে পুষ্টি জোগায় ঠিকই, তবে ক্যালসিয়াম শোষণ করার জন্য ও ক্যালসিয়ামের উপকার পেতে হলে ভিটামিন ডি দরকার। ডিমের কুসুম ও তৈলাক্ত মাছের মধ্যে ভিটামিন ডি মজুদ আছে।
ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট যিনি খাচ্ছেন, তাঁকে হয়তো কোনো কারণে আয়রন ট্যাবলেটও খেতে হচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন এ দুটি ওষুধ একই সঙ্গে খাওয়া না হয়। কেউ হয়তো দুপুরে আয়রন ট্যাবলেট খাচ্ছেন, তাঁকে সকালে ও রাতে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হবে। এ দুটি ওষুধ একই সঙ্গে খেলে আয়রন ট্যাবলেট থেকে খানিকটা কম উপকার পাওয়া যাবে।
ক্যালসিয়ামের সাথে ভিটামিন ডি খাওয়া অপরিহার্য। কারন ভিটামিন ডি না থাকলে ক্যালসিয়ামের Absorption এবং Bone Mineralization ঠিক মত হয়না। শুধু তাই নয়, ভিটামিন ডি না থাকলে শরীরের চামড়া ও পস্রাবের মধ্য দিয়ে আনচেঞ্জড অবস্থায় প্রচুর ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায়।
বর্তমানে অবশ্য ক্যালিসয়াম ও ভিটামিন ডি একসাথে একই ট্যাবলেটে পাওয়া যাচ্ছে।
আর এখন এমন ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও আবিস্কৃত হয়েছে যা ভিটামিন ডি ছাড়াই পূর্ন কার্যকরী। এ সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
নিয়মিত বেশি পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এক গবেষনায় দেখা গেছে- পঞ্চাশোর্ধ বয়সে যারা নিরামিষ খান, আমিষ ভোজীদের চেয়ে তাদের দেহে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ভাল থাকে।
সোডিয়াম (খাবার লবন), খাবার সোডা, সফট ড্রিংক্স ইত্যাদি খাবার এবং এ্যাকজিমা জাতীয় চর্মরোগ, মানসিক অস্থিরতা, অল্পতেই মেজাজ খারাপ হওয়া, ভঙ্গুর নখ, মাংস পেশীর খিঁচ ধরা, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি রোগ হলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়।
এ্যান্টসিড, অবসাদ কমাবার ওষুধ, ইপিলেন্সির ওষুধ, বেদনানাশক ঔষুধ প্রভৃতি খেলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। জন্মবিরতীকরন ফিল ক্যালসিয়ামের স্বল্পতার কারন হতে পারে। তাই এসব ঔষুধ খেলে সাথে অবশ্যই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হবে।
কোষ্ঠাকাঠিন্যে ভুগলে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাজারে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম আরোটেট, ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট এবং ক্যালসিয়াম সাইট্রেট সবচেয়ে ভাল। এগুলোর প্রায় ৪০% ক্যালসিয়াম দেহে আত্তীকৃত হয়। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে ভালো হলো- ক্যালসিয়াম ওরোটেট। এর প্রায় ৯৫% ই শরীরে absorb হয়। ক্যালসিয়াম ওরোটেট নিয়ে পরে ইনশাআল্লাহ আলাদাভাবে আলোচনা করার আশা রাখি।
ক্যালসিয়ামের কার্বোনেট ততটা কার্যকর নয়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের জন্য ক্যালসিয়াম কার্বোনেট কোনো কাজেই আসে না।
হাড় দেহের অতীব গূরুত্বপূর্ন একটি উপাদান। ক্যালসিয়ামের অভাব এ মহামূল্যবান সম্পদকে নষ্ট করে দিতে পারে অনায়াসে। আমাদের একটু সচেতনতাই পারে মহ্যামূল্যবান এ জিনিসটিকে সুস্থ ও সবল রাখতে।
বিষয়: বিবিধ
২৩৯৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের দেশে একটি বয়সে সবারই প্রায় হাড়ের সমস্যা হয়,ক্যালসিয়াম কম খাওয়াই যার কারন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন